সাম্প্রতিক আপডেটঃ

জুমআর দিবসের গুরুত্ব

 

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عَنْ اوس بن اؤسٍ قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : اِنَّ من افضل ايّامكم يوم الجمعة فيه خلق ادم ـ وفيه قبض وفيه النفخة وفيه الصعقة فاكثروا على من الصلاة فيه فان صلاتكم معروضة على ـ قال قالوا يارسول الله وكيف تعرض صلاتنا عليك وقد ارمت ـ يقولون بليت؟ فقال ان الله عزوجل حرم على الارض ـ اجساد الانبياء [رواه ابوداود]

অনুবাদ : হযরত আউস বিন আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয় তোমাদের দিবসসমূহের মধ্য থেকে জুমআর দিবসই সর্বোত্তম। সেদিন হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সৃজন করা হয়েছে। সেদিনই তিনি ওফাত হয়েছেন। সেদিনই সিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। সেদিনই বিকট শব্দ প্রকাশিত হবে। অতএব তোমরা আমার উপর সেদিনে অধিকহারে দরূদ শরীফ পাঠ কর। কেননা তোমাদের দরূদ শরীফ আমার উপর পেশ করা হয়। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের দরূদ শরীফ আপনার উপর কিভাবে পেশ করা হবে? ওফাতের পর আপনার দেহ মোবারক কি মাটিতে মিশে যাবে না? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা ভূপৃষ্ঠের জন্য সম্মানিত নবীগণের দেহ (শরীর মুবারক ভক্ষণ করা কিংবা কোনরূপ ক্ষতি সাধন করা)কে হারাম করে দিয়েছেন। [আবু দাঊদ শরীফ]

 

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

يوم الجمعة বর্ণিত (ইয়াওমুল জুমআ) অর্থ একত্রিত হওয়ার দিবস। সপ্তাহান্তে এ দিবসে মুসলমানরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনার জন্য একত্রিত হওয়ার কারণে এ দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমআ’ বলা হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও সমগ্র সৃষ্টিরাজিকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এ ছয়দিনের শেষ দিন ছিল জুমআর দিবস।
জাহেলী যুগে শুক্রবারকে ‘ইয়াওমে আরূবা’’ বলা হত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পূর্বপুরুষদের অন্যতম কা’ব ইবনে লুয়াই সর্বপ্রথম এর নাম ইয়াওমুল জুমআ রাখেন। এ দিনে কুরায়শরা সমাবেশ করতো সেই সমাবেশে কা’ব ইবনে লুয়াই ভাষণ দিতেন, ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় এটা ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ পৃথিবীতে শুভাগমনের পাঁচশত ষাট বছর পূর্বের ঘটনা। ইসলাম পূর্বকালেও শুক্রবারকে গুরুত্ব দেয়া হতো। [তাফসীরে মাযহারী]

এ দিবসের অন্যতম তাৎপর্য হচ্ছে, মহান আল্লাহ্ তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে স্বতন্ত্র্য একটি সূরা নাযিল করেন, যার নাম ‘সূরা জুমআহ’। এটা মদীনায় অবতীর্ণ ও ২৮তম পারায় অন্তর্ভুক্ত। এ সূরায় এরশাদ হয়েছে-

يا ايها الذين امنوا اذا نودى للصلوة من يوم الجمعة فاسعوا لى ذكر الله وذروا البيع ذلكم خير لكم ان كنتم تعلمون ـ

অর্থ: হে মুমিনগণ জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে তওবা কর এবং ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ। [সূরা জুমআহ, পারা-২৮, আয়াত-৯]

নির্ভরযোগ্য অভিমত হচ্ছে জুমআর আযান হওয়া মাত্রই ক্রয় বিক্রয় হারাম হয়ে যায়। জুমআর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা ওয়াজিব হযে যায়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা হতে হিজরত করে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল শরীফ সোমবার মদীনা মনোয়ারায় পৌঁছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্বোবায় অবস্থান করেন। জুমআর দিন মদীনা নগরীর দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে বনী সালেম ইবনে আওফের বত্বনে ওয়াদীতে (উপত্যকার মাঠ) জুমআর সময় হয় সেখানেই জুমআর নামায আদায় করেন। এখানেই সর্বপ্রথম জুমআহ্ আদায় করা হয়।
[তাফসীরে নুরুল ইরফান]

জুমাবারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। তাহাভী শরীফে বর্ণিত আছে-

عنْ ابن عباس رضى الله عنه مرفوعًا الجمعة حج المساكين وفى رواية حج الفقراء

অর্থাৎ জুমআর দিবস মিসকীন ও ফকিরদের জন্য হজ্জের দিন।

  • জুমআর দিন মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ

কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যাকারী এক শ্রেণির ভ্রান্ত মতবাদী পবিত্র ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দুই ঈদ ছাড়া অন্য কোন ঈদ স্বীকার করতে নারাজ। অথচ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পবিত্র জুমআর গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে এরশাদ করেন,

يا معشر المسلمين ان هذا يوم جعله الله عيدًا فاغسلوا ومن كان عنده طيب فلا يضره ان يمس منه وعليكم بالسواك [رواه ابن ماجه]

ওহে মুসলিম সমাবেশ এটা এমন এক মহান দিন যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা ঈদ স্বরূপ সাব্যস্ত করেছেন। এ দিবসে গোসল করবে, এ দিবসে সুগন্ধি ব্যবহারে ক্ষতি নেই, তোমরা নিশ্চয় মিসওয়াক করবে। [ইবনে মাযাহ্] হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে-

  • জুমআর দিবস ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার চেয়েও শ্রেষ্ঠ

عن ابى لبابة بن عبد المنذر رضى الله عنه قال قال النبى صىلى الله عليه وسلم ان يوم الجمعة سيد الايام واعظمها عند الله وهو اعظم عند الله من يوم الاضحى ويوم الفطر [رواه ابن ماجه]

অর্থ: হযরত আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জুমআর দিন হলো দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন, আল্লাহ পাকের নিকট মহাসম্মানিত দিন এমনকি আল্লাহর নিকট ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (ইবনে মাযাহ)

জুমআ দিবসের আমল এক বছর নফল রোজা ও নামাযের সমান: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-

وعن اوس بن اوسٍ رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من غسل يوم الجمعة واغتسل وبكر وابتكر ومشى ولم يركب ودنا من الامام واستمع ولم يلغ كان له بكل خطوة عمل سنة اجر صيامها وقيامها [رواه الترمذى]

অর্থ: হযরত আউস ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিবসে গোসল করবে এবং কাপড় চোপড় ধৌত করবে, সকাল সকাল প্রস্তুতি গ্রহণ করত: প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে উপস্থিত হবে, কোন বাহনে আরোহন না করে পদব্রজে রওয়ানা হবে মসজিদে ইমামের সন্নিকটে বসবে মনোযোগে খোতৎবা শ্রবণ করবে, কোন অনর্থক কথা বলবেনা বা বাজে কাজ করবেনা, তার প্রত্যেক কদমে এক বছরের নফল রোজা ও নফল নামাযের সাওয়াব হবে। [তিরমিযী শরীফ]

  • জুমআহ পরিত্যাগের পরিণতি

এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলল, অমুক ব্যক্তি মারা গেছে, সে জুমআ ও জামাতে উপস্থিত হতো না, এখন তার অবস্থা কি হবে? হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন সে দোজখী। এভাবে হাদীস শরীফে জুমআ পরিত্যাগকারীর কঠিন শাস্তি ও ভয়াবহ পরিণতির বর্ণনা এসেছে। এরশাদ হয়েছে-

عن ابن عباس رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من ترك الجمعة من غير ضرورة كتب منافقًا فى كتاب لايمحى ولايبدل

হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বিনা ওজরে যদি কোন ব্যক্তি জুমআ পরিত্যাগ করে মুনাফিকরূপে এমন দপ্তরে তার নাম লিপিবদ্ধ হবে, যা কখনো রহিত হবে না ও পরিবর্তন হবে না।

  • জুমআর দিবসে দরূদ শরীফ পাঠের ফজিলত

عن على رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله ملائكة خلقوا من النور لايهبطون الا ليلة الجمعة ويوم الجمعة بايديهم اقلام من ذهب ودوى من فضة وقرا طيس من نور لايكتبون الا الصلوة على النبى صلى الله عليه وسلم [سعادة الدارين]

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহর এমন কিছু ফেরেশতা রয়েছে যারা নূরের সৃষ্টি, এরা জুমআর দিবস-রজনী ব্যতীত জমীনে অবতরণ করে না। তাঁদের হাতে স্বর্ণের কলম রৌপ্যের কালি ও নূরের কাগজ থাকে। এগুলো দ্বারা কেবল রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর পঠিত দরূদ শরীফ লেখা হয়। [সাআদাতুদ্ দারাইন]

হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে,

حديث ابى هريرة رضى الله عنه مرفوعًا من صلى على يوم الجمعة ثمانين مرة غفرالله ذنوب ثمانين سنة [رواه دارقطنى]

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিবসে আমার উপর আশি বার দরূদ শরীফ পাঠ করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার ৮০ বছরের গুনাহ্ (সগীরা) ক্ষমা করে দেবেন। [দারে কুতনী: আস সুন্নাহ্, ২/১৫৪পৃ]

  • জুমআর দিবসে কবর জিয়ারতের ফজিলত

عن ابى بكر رضى الله عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول من زار قبر والديه فى كل جمعة او احدهما فقرا عندهما او عنده (يس) غفرله

হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁর পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার পিতামাতা উভয়ের বা একজনের জুমাবার দিবসে যিয়ারত করবে এবং তাদের কবরের নিকট সূরা ফাতেহা পাঠ করবে, তাদের ক্ষমা করা হবে। [ইমাম মাদি: আল কামিল:৫/১৫১পৃ. হাদীস-১৩৬০]

আরো এরশাদ হয়েছে-

عن ابى هريررة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من زار قبر ابويه او احدهما كل جمعة غفرله وكتب براـ [رواه الطبرانى]

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক জুমাবার তার পিতামাতা উভয়ের বা একজনের কবর যিয়ারত করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন, তার নাম নেক্কাররূপে লিপিবদ্ধ করবেন। আল্লাহ্ তা’য়ালা আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

Check Also

উভয় জগতের ঈদ

প্রফেসর ড. আল্লামা মাসঊদ আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান  কখন হতে মাহফিল চলে আসছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *