স্বাগতম হিজরি নববর্ষ

 

অধ্যাপক আবু তালেব বেলাল

কালের পরিক্রমায় নানা সুখবহ ও দুঃখজনক ঘটনাকে স্মৃতিতে রেখে আমাদের থেকে বিদায় নিল ১৪৩৮ হিজরী। অন্যদিকে সুখ-শান্তি সাফল্য আর সমৃদ্ধির এক স্বপ্নিল বার্তা নিয়ে হাজির হল ১৪৩৯ হিজরি।

হিজরি সন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মকাল থেকে গণনা হয়নি তবে, তাঁর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের তাৎপর্যময় ঘটনার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি-ই হিজরি সন-এ স্মারক হয়ে আছে।

অন্যান্য যে কোন নববর্ষ আয়োজনের জমকালো উৎসবের আমেজ থাকলেও হিজরি সন-এ সেই ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ কোন উৎসবের আয়োজন থাকে না। কারণ, হিজরি সন একদিকে ত্যাগের মহিমাকে ভাস্বর করে রেখেছে অন্যদিকে সাফল্য, সমৃদ্ধ এবং মানবতাবোধকে জাগিয়ে তুলছে। ত্যাগের মহিমা এ জন্যই বলা হচ্ছে, হিজরত বিশ্বমানবতার নবী হুজুর সৈয়দ আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লার জীবনে নয়; শুধু ইসলামের ইতিহাসে এক পট পরিবর্তনকারী অধ্যায়। ঐতিহাসিক ফিলিফ কে. বলেন,

The hijrah, with which the Makkan period ended and the Madiness period began, proved a turning point in the life of mohammad. The History of the Arab

এ হিজরতের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত মিশন ‘আল ইসলাম’কে পূর্ণতা দানের প্রত্যয়ে নিজ মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে তৎকালীন ইয়াসরিবে পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং অলুক্ষণের দেশ ইয়াসরিব মুহূর্তেই বিশ্বের পবিত্র ও শান্তির দেশে পরিণত হল এবং নতুন নামকরণ হয় মদিনাতুন্নবী (নবীর শহর) এবং মদিনাতুল মনোয়ারা(আলোকিত শহর) । কিন্তু নবী করিম রউফুর রহিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সময়ে এ হিজরি সনকে মাস গণনায় স্মারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি; তবে হিজরতের আগে ও পরে শব্দ ব্যবহার হত । আরবের যে কোন ঘটনা বিচারে হিজরতের আগে বা পরে উল্লেখ করা হত । পবিত্র কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় নির্ণয়ে হিজরতের আগে-পরে বা মাক্কী-মাদনী ব্যবহার করা হয় ।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা-আলা আনহু’র খিলাফতকালে এই হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। ইসলামের মহান বাণী এবং মুসলিম সাম্রাজ্য আরবের সীমা পেরিয়ে রোম ও পারস্য পর্যন্ত সম্প্রসারণের ফলে রাষ্ট্রসমূহের শাসক কাজী বা বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করে সদর দফতর থেকে বিভিন্ন নির্দেশ সম্বলিত চিঠি ইস্যু করা হত। আর সরকারি সুনির্দিষ্ট সন তারিখ না থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভ্রান্তের শিকার হতো । এ ধরনের এক সমস্যার অভিযোগ করে তৎকালীন কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু খলিফা হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খিমদতে এ মর্মে লিখলেন যে, আমীরুল মুমিনীন; আপনার পক্ষ থেকে আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ সম্বলিত যে সব চিঠিপত্র আমরা পেয়ে থাকি, তাতে কোন তারিখ উল্লেখ না থাকায় সময় ও কাল নির্ধারণের যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হয় । ফলে কখনো ঐসব নির্দেশ যথাযথ পালন করতে গিয়ে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হই । পূর্বাপরের নির্দেশনাবলীর সাথে পার্থক্য করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে ।

চিঠিখানা পেয়ে হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বিশিষ্ট সাহাবীদের নিয়ে মজলিশ-এ খাস এর এক জরুরি সভার আহবান করলেন । উক্ত সভায় উপস্থিত বিজ্ঞ সাহাবা-ই কেরাম এ মর্মে উপলব্ধি করলেন যে, একটি ইসলামী স্মারক সম্বলিত সনের প্রবর্তন অতীব প্রয়োজন । কিন্তু কোন মাস থেকে এর সূচনা হবে এ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা দেয় । কারণ তৎকালীন প্রচলিত সন যেহেতু খ্রিস্টান ধর্মাবম্বীদের উদ্ভাবিত; হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) -এর পবিত্র জন্মের স্মৃতি স্মারক সন এবং এটি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করছে । তাই মুসলমানদের উচিত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর স্মরণীয় কোনো ঘটনাকে গ্রহণ করে সন প্রবর্তন করা । কেউ কেউ খ্রিস্টীয় সনের ন্যায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের মাস (রবিউল আউয়াল) থেকে তারিখ সূচনার প্রস্তাব করেন । কিন্তু হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর বিরোধিতা করে বলেন, নবীজীর শুভাগমন বা নবুয়ত প্রকাশের মাস থেকে ইসলামি সন গণনা করা যাবে না । কারণ, খ্রিস্টান সম্প্রদায় যেহেতু হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম (যীশুখৃস্ট)-এর জন্মমাস থেকে খ্রিস্টাব্দ সনটি গণনা করে সেহেতু তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন অপছন্দনীয় । সুতরাং সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয় যে, ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যসময় এমন একটি ঘটনা দিবসকে কেন্দ্র করে হিজরি সন গণনা হবে যা ইসলামের ইতিহাসকে সাফল্য এবং সমৃদ্ধর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে । এসব বিচেনায় মজলিশে উপস্থিত সকলই ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের জন্য নিজ জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত সময়কালকে হিজরি সন গণনার যুক্তিযুক্ত বলে মত দেন । ফলে, ইসলামের তাৎপর্যময় তথা ত্যাগ ও সাফল্যের এক সেতুবন্ধনকারী এই হিজরত-ই হযরত ওমর ও সাহাবা-ই কেরামের বিবেচনায় হিজরি সনের সূচনা হয়। আর হিজরতের প্রারম্ভিক নির্দেশ যেহেতু মুহাররম মাসে হয়েছিল, তাই মুহাররমকেই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবেই নির্ধারণ করা অধিকার যুক্তিযুক্ত । এভাবে সূচনা হয় হিজরি সনের।

হিজরতকে কেন্দ্র করে ইসলামী বর্ষপঞ্জির সূচনা করার মধ্য দিয়ে সাহাবায়ে কেরামের দূরদর্শিতার পরিচয় মিলে । কারণ ইসলাম ও মুসলমানদের জীবনে ‘হিজরত’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । হিজরতের মধ্য দিয়ে ইসলামের উন্নতি ও অগ্রগতির সূচনা হয় । ইসলামের প্রচার-প্রসারে গুণগত পরিবর্তন আনে ‘হিজরত’ । মক্কার নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে ইসলামের দাওয়াত সমগ্র আরব এমনকি বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পথ উন্মুক্ত হয় হিজরতের সূচনা দ্বারা । হিজরতের মধ্য দিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসী মুহাজির ও মদীনাবাসী আনসারদের নিয়ে মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হন । তাই হিজরত ছিলো ইসলামের পূর্ণতার সূত্রপাত ও ইসলামের প্রত্যয়ের প্রতিষ্ঠা । হিজরতের ঘটনা দিয়ে ইসলামি বর্ষবঞ্জির সূত্রপাত হয়। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তার ‘রাসূলে রহমত’ পুস্তকে লিখেছেন-

‘তখনকার জাতি-গোষ্ঠির ইতিহাস ও সন-তারিখ পর্যালোচনার পর সাহাবায়ে কেরামগণের সামনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র জন্ম ও নবুয়্যত প্রকাশের দিনগুলো সাল নির্ধারণের বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল । কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুদিবসের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে পরবর্তীদের মধ্যে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কার দরুণ তাঁরা অন্য এক প্রসিদ্ধ ঘটনা অন্বেষণ করেছিলেন । ফলে হিজরতের ঘটনাই সকলের নিকট বেশি প্রতিভাত হয়ে উঠল । যা ছিল সকল সম্প্রদায় থেকে বিপরীত ও ব্যতিক্রমধর্মী একটি পদক্ষেপ । পৃথিবীর প্রত্যেক সভা জাতির বিজয় ও সফলতার কীর্তি দিয়ে তাদের ইতিহাস ও সন তারিখ নির্ধারণ করে, কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম মজলুম, অসহায় ও সর্বহারার দেশত্যাগের প্রতীক হিসেবে সূচনা করেছিলেন মিল্লাতের ইতিহাস । জগতের ব্যক্তি চায় তাঁদের শ্রেষ্ঠ কর্ম দিয়েই । যুদ্ধের ময়দানে শুধু বিজয় নয়, কঠিন নির্যাতন, নিপীড়ন, বিশাল শক্তির মোকাবেলায় ধৈর্য সহিঞ্চুতা ও দৃঢ়তার বিজয় দিয়ে আমাদের ইতিহাস আরম্ভ হবে । অন্যান্য জাতির বিশ্বাস-রাষ্ট্র ও ক্ষমতার প্রসার দ্বারা নিজেদের শক্তি ও খ্যাতির ভিত রচনা হয় । পক্ষান্তরে সাহাবায়ে কেরামের বিশ্বাস ছিল ভিন্ন; দেশ পদানত নয়, স্বদেশ মাতৃভূমি ত্যাগ করার দিন থেকে তাদের শক্তি, খ্যাতি ও আত্মত্যাগের দুয়ার খুলে গিয়েছিল । নিঃসন্দেহে সাহাবীদের এ উপলব্ধি অন্য সব জাতির অনুকরণ থেকে ব্যতিক্রম, দূরদর্শিতার পরিচায়ক ও এবং নিজস্ব সংষ্কৃতির অঙ্গনে সৃষ্টিশৈলীর বহিঃপ্রকাশ । সাহাবায়ে কেরামগণ উন্নত ইসলামী চিন্তা ও কর্ম দ্বারা গড়েছিলেন মিল্লাতের ভিত । অতএব, হিজরি সন ও তারিখ গণনার মাধ্যমে আমরা যেন ইসলামের ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি ইসলামের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠার এবং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের একট সহ অবস্থানের । তবে আবারো বলছি ইসলামী নববর্ষ হিজরি সনে কোন উল্লাস ও উচ্ছ্বাসের মাস নয়; এ মাস ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ও সত্যের বিজয়ের মাস । সত্যান্বেষীদের হাজারো ঘটনার স্মারক এ মাস মূলত ইবাদত, বন্দেগী ও ইসলামী সংস্কৃতি, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে হিজরি নববর্ষকে বরণ ও স্মরণ করাটাই হবে সকলের জন্য কল্যাণকর ।

 


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

উভয় জগতের ঈদ

প্রফেসর ড. আল্লামা মাসঊদ আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান  কখন হতে মাহফিল চলে আসছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading