সাম্প্রতিক আপডেটঃ

দ্বয়ীফ হাদীসকে অস্বীকার করা একটি মারাত্মক ফিতনা

মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান

দ্বয়ীফ হাদীসকে অস্বীকার করা বর্তমান সময়ের একটি বড় ফিতনা আর হাদীস অস্বীকারকারীদের নতুন চেহারাও বটে । হাদীস চর্চার প্রাথমিক যুগে এই ফিতনার অস্তিত্ব ছিলনা বললেই চলে, কিন্তু আজ এই ফিতনার পালে হাওয়া দেয়ার লোকজন সর্বত্র বিরাজমান । বিশেষ করে নাসির উদ্দীন আলবানী সাহেব যিনি এই ফিতনার আগুনকে দাবানলে পরিণত করেছেন আর তার মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে বর্তমানে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । এমনি প্রভাবিত হয়ে ‘আল হাদীস’ নামক মাসিক পত্রিকা (পাকিস্তানি) এই ফিতনাকে আরও বাড়িয়ে নিচ্ছে । এর সম্পাদক পত্রিকার শেষে এই মন্তব্য স্পষ্টভাবে ছাপায় যে, আমাদের পন্থা হল ” দ্বয়ীফ (দূর্বল) ও মারদুদ (মিথ্যা) বর্ণনা তথা হাদীস হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকা । আর এই স্লোগান সর্বত্র ছড়িয়েও দেয়া হচ্ছে । সম্পাদক নাসির উদ্দীন আলবানীর মত অনুসরনকরত সুনানে আরবা’আ হতে দ্বয়ীফ বর্ণনাসমূহ একত্রিত করে একটি কিতাবও রচনা করেন যার নাম দেন- (انوار الصحیفہ فی الاحادیث الضعیفہ من السنن الاربعۃ) ‘আনওয়ারুস সহীফাহ ফিল আহাদীসিদ দ্বয়ীফাহ মিন আস সুনানিল আরবাআ’ ।

এমনিভাবে আরও একটি মাসিক পত্রিকা ‘দ্বরবে হক্ব’ (ضرب حق) এর সম্পাদকও এরূপ স্লোগান ছড়িয়ে দেন । তার পত্রিকার শেষেও লেখা থাকে যে, “দ্বয়ীফ হাদীস হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকা”। এদের দেখাদেখি কিছু সুযোগ সন্ধানী আলেম আলবানীর অনুসরনে দ্বয়ীফ হাদীস অস্বীকার করে চলে । আর এমনিভাবে হাদীস অস্বীকারকারীদের এই নতুন রুপ আমাদের সামনে প্রকাশ হয় । তাদের অনুসৃত নব্য পদ্ধতি একদম পূর্বেকার হাদীস অস্বীকারকারিদের ন্যায় । তারা হাদীস পুরোপুরি অস্বীকার করত আর নিজেদের মত প্রচার ও প্রমাণের জন্য নিজেদের পছন্দনীয় বর্ণনাকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করত । এমনিভাবে এই দলের লোকেরাও, এরা দ্বয়ীফ হাদীস পুরোপুরি অস্বীকার করে আবার নিজেদের প্রয়োজনে নানা বাহানায় দ্বয়ীফ হাদিসকে দলীলরূপে গ্রহণও করে । যদিও এই দলের লোকেরা শুরু থেকেই বিভিন্ন নামে নিজেদের প্রকাশ করে আসছে, সময়ে সময়ে তারা নতুন নতুন নাম গ্রহণ করে । কখনো তারা সালাফী তো আবার তাওহীদি, আবার কখনো ওহাবী আবার নাম পরিবর্তন করে হয় আহলে হাদীস, আবার নাম নেয় মুহাম্মদী । মোটকথা, গিরিগিটির ন্যায় নাম পরিবর্তন করতে করতে এই দল আজ নতুন এক রূপ নিয়ে মানুষের সামনে এসেছে, তা হল ‘দ্বয়ীফ হাদীসকে সম্পূর্নভাবে অস্বীকারকারীরূপে ‘ । মানুষকে তারা এই বলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে যে, দ্বয়ীফ হাদীস এবং মাওযু-মারদুদ হাদীসের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । যদিও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সালফে সালেহীনগণ, মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিকগণের এই পন্থা ছিলনা । দ্বয়ীফ হাদীস সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হাদীস অস্বীকারকারীদের ন্যয় পুরোপুরি হাদীস অস্বীকার করারই নামান্তর । দ্বয়ীফ হাদীসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হাদীস অস্বীকার করারই আরেকটি পন্থা এবং হাদীস অস্বীকারকারীদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করা । মুহাদ্দিস কেরামগণ রাহিমাহুমুল্লাহু তা’আলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার প্রতিটি কথা, কাজ এক এক সুন্নাতকে প্রথমত নিজেদের হৃদয়ে ধারণ করেন, তারপর গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে সমগ্র উম্মাতের জন্য শরীয়তের উপর আমল করার পথকে মসৃন করে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লালামকে ধন্য করেন । এই কাজে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন, যা কল্পনাও করা যাবেনা এখন, এক একটি হাদীসের জন্য তারা দিন রাত এক করে ফেলেছেন, মরুভূমি ও সাগর পেরিয়ে দেশে বিদেশে সফর করেছেন, সম্পদ বিলিয়ে দেন, ক্ষুধার্ত থাকেন । আর এই সব কষ্ট-পরিশ্রম এই জন্যে করেছেন যে, তারা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে ভুল ও বিভ্রান্তিকর কথা ছড়িয়ে দিবেন, সঙ্কলন করবেন ? আল্লাহ মাফ করুন, এই সকল লোক তো মুত্তাকী, পরহেযগার , একত্তবাদে বিশ্বাসী সত্য রাসূল প্রেমিক ছিলেন এবং তার প্রেমে মত্ত ছিলেন । এই সকল মুহাদ্দিসগণের প্রতি এই ধারণা করাও গুনাহের কাজ যে, তারা জেনেশুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে সংশ্লিষ্ট করে সামান্যতম কথাও সঙ্কলন করেন । যেখানে এই সকল লোকই তাদের কিতাবে হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ সঙ্কলন করেন, যে ব্যক্তি জেনেশুনে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে জাহান্নামকে তার ঠিকানা নির্ধারন করল । তাহলে কি ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ রাহিমাহুমুল্লাহ ও তাদের ন্যয় অন্য মুহাদ্দিসগণের ব্যাপারে এই মন্তব্য দেয়া যাবে যে, তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট করে যে মিথ্যা রচনা করা হয়েছে তাকে তাদের কিতাবে স্থান দিয়ে গুনাহের কাজ করেছেন । আল্লাহ মাফ করুন অবশ্যই তা নয় । যদিও এ সকল মুহাদ্দিস হাদীসসমূহের স্তর নির্ধারণ করেছেন । কিন্তু দ্বয়ীফ হাদীসসমূহের ব্যাপারে তাদের কি অবস্থান ছিল তা সামনে ব্যক্ত করা হবে, যাতে করে ঐ ফিতনা হতে বাঁচা যাবে যা সালাফ নামধারী ভ্রান্ত লোকেরা ছড়াচ্ছে ।

মুহাদ্দিস কেরামগণ হাদীসের স্তর কেবল হাদীস বুঝার জন্য নির্ধারন করেছেন এবং মিথ্যা বর্ণনাসমূহকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলেছেন, কিন্তু বর্তমান সময়ে কতেক ভ্রান্ত লোক দ্বয়ীফ বর্ণনাসমূহকে মিথ্যা বর্ণনার সাথে মিশিয়ে উভয়কে একই স্তরে নামিয়ে ফেলে । যদিওবা মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদীস গ্রহণের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ছিল । আলিমগণ জানেন যে, কোন মুহাদ্দিসের নিকট একটি বর্ণনা সহীহ নয় তো তা অন্য মুহাদ্দিসের নিকট তার শর্তানুসারে সহীহ, তাহলে কি যার নিকট তা সহীহ নয় তিনি কি পথভ্রষ্ট ভুল ? আমাদের বক্তব্য হল দ্বয়ীফ হাদীসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা, তাকে হাদীসের পর্যায় থেকে বাদ দেয়া এবং তাকে মারদুদ মিথ্যা অপবাদ দেয়া, এসবই সালফে সালেহীনগনের নীতি ও আমলের পরিপন্থী । এসব হাদীসের সাথে বন্ধুত্ব নয়, শত্রুতা পোষণ । এটা দ্বীন নয়, বেদ্বীনি । এটা সালাফিয়্যাত নয়, রাফেযিয়্যাত । এটা সুন্নাত নয় বিদ’আত । এটা মু’মিনের পথ নয় বরং অস্বীকারকারীদের । এটা মুহাদ্দিসীনগণের পন্থা নয়, সালাফ নামধারী ও আলবানীদের পন্থা । সালফে সালেহীনগণের পন্থা ছিল যে, তারা দ্বয়ীফ হাদীস গ্রহণ করতেন এবং তার উপর আমল করতেন । ইমাম আজম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এই নীতি ছিল যে, যদি কোন ব্যক্তির আদালতে ত্রুটি থাকে তবুও তার বর্ণনা নেয়া যাবে এমনকি তার থেকে বর্ণনাকারী এক বা একাধিক হয় । আর এর বুনিয়াদ কুরআনে পাকের এই আয়াত হতে পাওয়া যায় ।

হে ঈমানদারগণ ! যখন তোমাদের নিকট কোন ফাসিক ব্যক্তি কোন সংবাদ নিয়ে আসে তাহলে তা বিচার বিবেচনা কর । [১]

এদ্বারা জানা যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি ফাসিক না হয় তবে তার কথা গ্রহণ করা যাবে । এখান থেকে এ কথাও বোঝা যায় যে, এমন অনেক বর্ণনা আছে যেগুলোকে মুহাদ্দেসীন কেরাম দ্বয়ীফ হুকুম দিয়েছেন ইমাম আজম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট তা সহীহ ছিল । এখন নব্য নামসর্বস্ব মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিসীন কেরামের মতানুসারে ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাসয়ালা সমূহকে নিরীক্ষা করতে থাকি আর দেখি তাঁর দলীলসমূহ কতটুকু শক্তিশালী ও সহীহ । আহলে হাদীস লেখক যেহেতু তার জামে তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থের নাম ‘ফুয়ুযুন নববী’ রেখেছেন, সেহেতু জামে তিরমিযি শরীফ হতেই কিছু দলীল উপস্থাপন করছি । আর দেখি যে, সালফে সালেহীনের দ্বয়ীফ হাদীসের উপর আমল ছিল –

  • বর্ণনা নং-১

হযরত আদী ইবনে হাতিম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত-

سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَيْدِ البَازِي، فَقَالَ:مَا أَمْسَكَ عَلَيْكَ فَكُلْ

অনুবাদঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাজ পাখি শিকার (তা আহার) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম । তিনি ইরশাদ করেন- তোমার জন্য তা ধরে রাখলে তা আহার করতে পার ।

**ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি হাদীসটি মুজালিদ -শ’বী সূত্র ছাড়া আর কোন সূত্রে পাননি, কিন্তু আহলে ইলমের (ওলামা কেরামের) এর উপর আমল রয়েছে । [২]

যদিও মুজালিদ দ্বয়ীফ রাবী ছিলেন । মাসিক আল হাদীস এর সম্পাদক মহোদয় তার আনওয়ারুস সহীফা নামক কিতাবের ১০২ নং পৃষ্ঠায় ইমাম হায়সামীর বরাত দিয়ে লিখেন মুজালিদ দ্বয়ীফ রাবী ছিলেন । আর এই বর্ণনায় আহলে ইলমের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা দ্বয়ীফ বর্ণনা গ্রহণ করতেন এবং তার উপর আমলও করতেন, আর এই আহলে ইলম হলেন- সাহাবা ,তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, মুহাদ্দিস ও ফুকাহা কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ।

  • বর্ণনা নং-২

হযরত আবু ওয়াকিদ লাইছি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,

عَنْ أَبِي وَاقِدٍ اللَّيْثِيِّ، قَالَ: قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ وَهُمْ يَجُبُّونَ أَسْنِمَةَ الإِبِلِ، وَيَقْطَعُونَ أَلْيَاتِ الغَنَمِ، فَقَالَ: مَا قُطِعَ مِنَ البَهِيمَةِ وَهِيَ حَيَّةٌ فَهِيَ مَيْتَةٌ

অনুবাদঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা মুনাওয়ারায় আগমণ করলেন, তৎকালে সেখানকার লোকেরা (জীবন্ত) উটের কুঁজ ও মেষের পাছার গোস্ত পিন্ড খেত । অতঃপর তিনি ইরশাদ করেন, জীবন্ত পশুর কর্তিত অংশ মৃত বলে গণ্য । [৩]

**উক্ত হাদীসের সনদে আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ দীনার র. আছেন যিনি ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আযাদকৃত দাস । যার ব্যাপারে ইবন হাজর আসকালানী লিখেন – صدوق يخطى  অর্থাৎ তিনি সত্যবাদী ছিলেন এবং তার দোষ ত্রুটি ছিল । [৪]

**তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে বলা হয়- عن يَحْيَى بْن مَعِين: فِي حديثه عندي ضعف
অর্থাৎ ইয়াহইয়া বিন মুয়ীন র. হতে বর্ণিত, আমার নিকট তার হাদীসের সনদে দূর্বলতা আছে । [৫]

**আবু আহমদ আদী র. বলেন –أَبُو أَحْمَد بْن عَدِيّ : وبعض ما يرويه منكر
অর্থাৎ তার কতেক বর্ণনা মুনকার । [৬]

**ইবনে জুযী তার আদ দু’আফা নামক কিতাবের ৯৪ পৃষ্ঠায় তার সম্পর্কে লিখেন- মোটকথায়, মুহাদ্দেসীন কেরামের মতে তিনি দ্বয়ীফ রাবী । কিন্তু ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহ উক্ত হাদীসের শেষে উল্লেখ করেন ওলামায়ে কেরামের আমল এর উপর ।

  • বর্ণনা নং-৩

নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ مَلَكَ ذَا رَحِمٍ مَحْرَمٍ فَهُوَ حُرٌّ

অনুবাদঃ যাদের সঙ্গে বিবাহ হারাম এমন কোন আত্মীয়ের মালিক যদি কেউ হয়, তবে সে মুক্ত হয়ে যাবে । [৭]

**ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহ বলেন- وَهُوَ حَدِيثٌ خَطَأٌ عِنْدَ أَهْلِ الحَدِيثِ
অর্থাৎ হাদীস বিশারদগণের মতে হাদীসটির সনদে ভুল রয়েছে ।

**হাদিসটির ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- لَا يَصِحُّ  অর্থাৎ এর সনদ সহীহ নয় ।

**ইমাম বুখারীর উস্তাদ আলী ইবনুল মাদিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন , হাদীসটি মুনকার ।

**ইমাম নাসাঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- حَدِيثٌ مُنْكَرٌ  হাদীসটি মুনকার । [৮]

**কিন্তু ইবনুল আসীর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
وَالَّذِي ذهَب إِلَيْهِ أَكْثَرُ أَهْلِ العِلم مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ، وَإِلَيْهِ ذهَب أَبُو حَنِيفَةَ وأصحابُه وَأَحْمَدُ أَنَّ مَن ملكَ ذَا رَحِمٍ مَحْرَمٍ عَتَقَ عَلَيْهِ ذَكَرًا كَانَ أَوْ أُنْثَى
অর্থাৎ সাহাবা ও তাবেঈগণের মধ্যে অধিকাংশ আহলে ইলমের এই হাদীসের উপর আমল আছে । এর সমর্থনকারী হলেন ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও তার সহচরবৃন্দ এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি । নিশ্চই যে ব্যক্তি কোন মুহরিম আত্মীয়ের মালিক হয়ে গেলে সে মুক্ত হয়ে যাবে, চাই সে পুরুষ হোক কিংবা মহিলা । [৯]

যে হাদীসের সনদের ব্যাপারে ইমাম বুখারী, মাদীনী ও নাসাঈর মত হল তা দ্বয়ীফ। সে হাদীস তার পূর্ব সময়েই সাহাবা তাবেঈগণের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল আর তাদের আমলও এর উপর ছিল । দ্বয়ীফ হাদীসের ব্যাপারে এটাই সালফ সালেহীনের মত ও পথ । তিরমিযি শরীফ হতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই, ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন কোন হাদীসের ব্যাপারে মন্তব্য প্রদান করতেন যে, মুহাদ্দেসীনের মতে এর সনদ দ্বয়ীফ । তখন তিনি এতে আহলে ইলমের মত ও আমলকেও সামনে আনেন । এর ব্যাপারে তাদের মত ও পথ উল্লেখ করেন । সুতরাং এ হতে দ্বয়ীফ হাদীসের ব্যাপারে তার দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট হয়ে যায়, মুহাদ্দীসীন কেরামের মতে হাদীসের সনদ দ্বয়ীফ হলেও ওলামাগণের আমল যদি তাতে থাকে তাহলে তার নিকট তা সহীহ হিসেবে গণ্য । যদি এমন না হত হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা কেরাম, তাবেঈগণ তাতে আমল করলেন কেন ? আহলে ইলমের আমলের দিকে ইঙ্গিত করত ইমাম তিরমিযি রাহমাতুল্লাহি আলাইহ উক্ত হাদীসকে সহীহ প্রমাণিত করেন । এমনিভাবে ইমাম আবু দাউদ,নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ তাদের স্ব স্ব কিতাবে এমন কিছু বর্ণনা সঙ্কলন করেন । যে সকল হাদীসের সনদ দ্বয়ীফ কিন্তু পূর্ব হতেই এর উপর আমল হয়ে আসছিল । আবার এমন কিছু হাদীসও পাওয়া যায় যার আমলের বৈধতা নেই, ইবনে মাজাহ শরীফে এমন কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় । যেগুলোকে ইমামগন কঠিনভাবে নিরীক্ষণ করেন । ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর কিতাব সম্পর্কে বলেন –
وَأما هَذِه الْمسَائِل مسَائِل الثَّوْريّ وَمَالك وَالشَّافِعِيّ فَهَذِهِ الْأَحَادِيث أُصُولهَا
অর্থাৎ আর ইমাম সাওরী, মালিক ও শাফেয়ীর যে মাসয়ালাসমূহ আছে, তা এই হাদীসমূহের মূলনীতির উপর । [১০]

ইমাম আবু দাউদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এ বক্তব্য দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তার কিতাবে বহু সংখ্যক হাদীস সংকলিত হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে ইমামগণের মাসায়ালার ভিত্তি এই হাদীসসমূহ দ্বারাই হয়েছে । এখন সুনানে আবু দাউদে সংকলিত কতেক হাদীসের সনদ মুহাদ্দেসীন কেরামের দৃষ্টিতে দ্বয়ীফ হলেও ইমামগণ তাতে আমল করেছেন এবং তা হতে ফিকহী মাসয়ালা নিরূপন করেছেন । মোটকথা এ সকল হাদীস ইমামগণের নিকট গ্রহণযোগ্য ও তাদের আমলকৃত । এখন এ দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, ইমামগণের দৃষ্টিতে হাদীসগুলো ঐ রকম দ্বয়ীফ নয় যা দ্বারা উদ্দেশ্য হয় এগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নয় বরং তা উসুলে হাদীসের দৃষ্টিকোণ হতে দ্বয়ীফ ছিল আর তা আমলযোগ্যও ছিল । ইমামগণ দ্বয়ীফ হাদীসকে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নিসবত করা জরুরী মনে করেননি ।

ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন –
وَالْأَحَادِيث الَّتِي وَضَعتهَا فِي كتاب السّنَن أَكْثَرهَا مشاهير
আর আমি আমার সুনানে যে সকল হাদীস সংকলিত করেছি তার অধিকাংশই মাশহুর [যার সনদ দুইয়ের অধিক] [১১]

এখানে মাশহুর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে সকল হাদীসের উপর ইমামগণ আমল করেছেন যদিও তা পরিভাষায় দ্বয়ীফ ছিল । ইমাম হাফিজ ইবনে হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে সকল হাদীসের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকেছেন তা চার প্রকার-

১. যা সহীহাইনে (বুখারী ও মুসলিম) আছে অথবা সহীহাইনের শর্ত মোতাবেক সংকলিত।
২. যা হাসান লিযাতিহি পর্যায়ের ।
৩. যা হাসান লিগাইরিহি পর্যায়ের অথবা এতদুভয়ের নিকটবর্তী ।
৪. এমন যার সনদ দ্বয়ীফ । এরপর বলেন, এ সকল প্রকার ইমাম আবু দাউদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল । [১২]

এ দ্বারা বুঝা যায় যে, ইমাম ও মুহাদ্দেসীন কেরামের নিকট দ্বয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য ছিল এই জন্যই তারা এ প্রকার হাদীস তাদের কিতাব সমূহে সংকলন করেছেন । কিন্তু বর্তমানে আলবানী ও তার অনুসারীরা তাদের মত দ্বারা দ্বয়ীফ হাদীসকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে চলছে । এটা সালফে সালেহীনের আমল নয় এটা নব্য আবিষ্কৃত বিদ’আত । মূলত তারা বিদ’আতি কিন্তু অন্যদের সুন্নত আমলকে বিদ’আত বিদ’আত বলতে তাদের বাঁধেনা । দ্বয়ীফ হাদীসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যুগের নতুন ফিতনা ।

ইবন আব্দুল বার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- وَرُبَّ حَدِيثٍ ضَعِيفُ الْإِسْنَادِ صَحِيحُ الْمَعْنَى
অর্থাৎ অনেক হাদীস আছে যার সনদ দ্বয়ীফ কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে তা সহীহ পর্যায়ের । [১৩]

হাদীসের মূল বক্তব্য ও এর অর্থই তো আসল, সনদ হল হাদীস পর্যন্ত পৌছানোর মাধ্যম মাত্র । যদি মাধ্যম দোষযুক্ত হয় আর মূল দোষমুক্ত, তাহলে মূল ও তার অর্থকে মানতে বাঁধা কিসে ? কেবল মাত্র মাধ্যমের দোষের কারণে মূলকে দোষযুক্ত করা ও তা অস্বীকার করা এটা কোন ধরণের বিবেক ? এই নামধারী সালাফী ও আলবানীদের নিকট ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির চেয়ে বড় মুহাদ্দিস আর কেউ নেই । আসুন দেখে নেই তার নিকট দ্বয়ীফ হাদীসের অবস্থান কোথায় ।

সহীহ বুখারী ব্যতীত আর সব হাদীসের কিতাবেই দ্বয়ীফ হাদীসের ছড়াছড়ি আছে । এমনকি তারা তাঁর আল আদাবুল মুফরাদকেও দুটি অংশে ভাগ করেছে যা খোদ ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও করেননি । সহীহ বুখারীতেও দ্বয়ীফ রাবীদের বর্ণনা নেয়া হয়েছে । যা ফাজায়েল এবং ভীতি-আগ্রহ প্রদানের জন্য সংকলিত হয়েছে-

  • সহীহ বুখারী শরীফে কিতাবুর রিক্বাক [بَابٌ: يَدْخُلُ الجَنَّةَ سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ] ৬৫৪১ নং হাদীসে আসীদ বিন যায়দ বিন জামাল নামক রাবী রয়েছেন যিনি দ্বয়ীফ ।
  • ইমাম নাসাঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- أسيد بن الْجمال مَتْرُوك الحَدِيث তার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় । [১৪]
  • ইমাম যাহাবী বলেন- كذبه يحيى وَقَالَ غَيره مَتْرُوك অর্থাৎ ইয়াহইয়া বিন ময়ীন তাকে মিথ্যাবাদী এবং অন্যরা তাকে মাতরূক তথা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন । [১৫]
  • ইমাম দারে ক্বুতনী তার দ্বু’আফা ওয়াল মাতরুকুন কিতাবে তাকে দ্বয়ীফ বলেন , ১:২৫৯ ।
  • ইবন হাজর আসকালানী তার সম্পর্কে বলেন, মিথ্যাবাদী । তিনি দারে ক্বুতনীর বরাত দিয়ে বলেন- وقال الدارقطني: “ضعيف الحديث” অর্থাৎ তার হাদীস দ্বয়ীফ । [১৬]
  • ইমাম ইবনে হিব্বান তার মাজরুহাইন কিতাবে তার সম্পর্কে লিখেছেন, ১:৩১০ বর্ণনা-১১৯ ।
  • ইয়াহইয়া বিন মুয়ীন তারীখে ইবনে মুয়ীনে, বর্ণনা নং-১৯১৪ তাকে মিথ্যাবাদী বলেন ।
  • ইবনে হাতেম রাযী তার জরহ ওয়াত তা’দীল কিতাবে তাকে মিথ্যাবাদী উল্লেখ করেন, ২:৩১৮, রাবী নং-১২০৪ ।
  • ইবনে আদী আল কামিল ফিদ দ্বু’আফা কিতাবে তাকে মিথ্যাবাদী ও অগ্রহণযোগ্য বলেন, ১:৪০০ ।
  • ইবনে জুওযী আদ দ্বু’আফা ওয়াল মাতরুকীনে মিথ্যাবাদী বলেন ১:১২৪ ।
    অনুসরণের দিক থেকে শেষতক ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই দ্বয়ীফ রাবীকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন । এটাই আমরা বুঝাতে চাচ্ছি যে, পূর্ববর্তী তথা প্রাথমিক সময়ের হাদীস বিশারদগণ দ্বয়ীফ বর্ণনা ছেড়ে দিতেন না যেমনটি বর্তমান সময়ের কতেক মুর্খ নামধারী বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন । আরও একটি উদাহরণ বুখারী শরীফ হতে-
    وَيُذْكَرُ عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الأَكْوَعِ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَزُرُّهُ وَلَوْ بِشَوْكَةٍ فِي إِسْنَادِهِ نَظَرٌ
    অর্থাৎ সালামা ইবনুল আকওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার জামায় বোতাম লাগিয়ে নাও এমনকি কাঁটা দিয়ে হলেও । এই হাদীসের সনদ সম্পর্কে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন অর্থাৎ এই হাদীসের সনদ নিরীক্ষণ প্রয়োজন । [১৭]

ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট এর সনদ দ্বয়ীফ কিন্তু ফাজায়েল ও মানাকিবের মাসয়ালায় তিনিও দ্বয়ীফ হাদীসকে গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন এবং তা গ্রহণও করেছেন । জানা গেল যে, পূর্ববর্তীগণ দ্বয়ীফ বর্ণনা হতে দলীলাদি গ্রহণ করেছেন এবং আমলও করেছেন । কখনো এমনও হয়েছে দলীল হিসেবে দ্বয়ীফ হাদীস আছে আর তা কিয়াসের বিপরীত । এমতাবস্থায় ফুকাহা কেরাম বিশেষত চার মাযহাবের ইমামগণ কিয়াসের বিপরীতে দ্বয়ীফ হাদীসকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন । যেমনটি ইবনুল কয়্যুম ই’লামু মুয়াক্কিয়ীন নামক কিতাবে লিখেছেন । এখন এসকল হাদীস অস্বীকারকারী ব্যক্তিরা বলল হাদীস দ্বয়ীফ তাই তারা তা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মনগড়া কিয়াসের উপর আমল করল, আর নাম দিল আহলে হাদীস । এখন আবার তাদেরই আরেক রূপ দেখুন, যখন তাদের নীতি ও আক্বীদা সংক্রান্ত বর্ণনা থাকলে দ্বয়ীফ হওয়া সত্বেও তা তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য । আর পৃথিবীজুড়ে তার আঢাক পিটিয়ে বেড়ায় যে, আমরা সহীহ ও হাসান হাদীস আমল করি । দ্বয়ীফ হাদীসের উপর তাদের আমল দেখুন-

  • তিরমিযী শরীফে এসেছে- নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَا وُضُوءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرْ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি ওযুতে আল্লাহর নাম নিবেনা তার ওযু হবেনা । [১৮]

এই বর্ননা দ্বয়ীফ, এ সংক্রান্ত যত বর্ণনা আছে সব দ্বয়ীফ সনদে । যেমন, আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী বুলুগুল মারাম ১:১৮ [দারুল ফালাক্ব,রিয়াদ] বর্ণনা করেন, হাফিজ ইবন রুশদ তার বিদায়াতু মুজতাহিদ কিতাবে ১:২৪ [দারুল হাদীস কায়রো] আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকপুরী তুহফাতুল আওযাহী কিতাবে লিখেছেন ।

গায়রে মুক্বাল্লিদ আলেম আব্দুর রহমান মুবারকপুরী বলেন-

لَا شَكَّ فِي أَنَّ هَذَا الْحَدِيثَ نَصَّ عَلَى أَنَّ التَّسْمِيَةَ رُكْنٌ لِلْوُضُوءِ
অর্থাৎ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা হাদীসে নস (দলীল) বিসমিল্লাহ পড়া ওযুর রুকনের অংশ । [১৯]

এখন এই হাদীস গ্রহণ করত আহলে হাদিস সম্প্রদায় বিসমিল্লাহ পড়াকে ওযুর ফরজ করেছে । কিন্তু তাদের নীতি অনুসারে এই হাদীস দ্বারা ফরজ তো দূরের কথা এর উপর আমলই ত করা যায়না । কিন্তু আমল হচ্ছে এটা যে তাদের আক্বীদা ভ্রষ্ট করছেনা ।

  • গায়রে মুক্বাল্লিদরা নামাযে উচ্চস্বরে আমিন বলার ক্ষেত্রে এই দলীল প্রদান করে থাকে

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: تَرَكَ النَّاسُ التَّأْمِينَ، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَالَ: ” غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ [الفاتحة: 7] ، قَالَ: «آمِينَ» حَتَّى يَسْمَعَهَا أَهْلُ الصَّفِّ الْأَوَّلِ، فَيَرْتَجُّ بِهَا الْمَسْجِدُ

অনুবাদঃ হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- লোকেরা আমিন বলা ছেড়ে দিয়েছে । অথচ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন .. غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ বলতেন, তখন তিনি এভাবে আমীন বলতেন প্রথম কাতারের মুসল্লিরা তা শুনতে পেত এবং মসজিদ গুঞ্জরিত হত । [২০]

হাদীসটিকে নাসির উদ্দীন আলবানী দ্বয়ীফ বলেন । এই হাদীসের একজন রাবী বশর বিন রাফীর উপর ইমাম বুখারী, ইয়াহিয়া বিন ময়ীন, আহমদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ কঠিনভাবে নিরীক্ষণ করেন । জমহুরের মতে তিনি দ্বয়ীফ । কিন্তু গায়রে মুক্বাল্লিদরা এই হাদীস গ্রহণ করেছে কেননা তা তাদের মতের বলে ।

  • গায়রে মুক্বাল্লিদরা সারা বছর ওয়াক্ত শুরু হতেই নামায আদায় করে ফেলে । দলীল দেয়

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ أَحَدًا كَانَ أَشَدَّ تَعْجِيلًا لِلظُّهْرِ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَا مِنْ أَبِي بَكْرٍ، وَلَا مِنْ عُمَرَ

অনুবাদঃ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, আমি রাসূল পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা অপেক্ষা শীঘ্র যুহরের নামায আদায় করতে আর কাউকে দেখিনি । [২১]

এই হাদীসকে আলবানী দ্বয়ীফ বলেছে । এর সনদে হাকীম বিন জুবায়র নামক একজন রাবী রয়েছেন, মুহাদ্দীস কেরাম তার ব্যাপারে কঠোর ছিলেন । ইমাম বুখারী,আহমদ,নাসাঈ,শো’বা,দারে ক্বুতনী,সাওরী,জুযজানী প্রমুখ মুহাদ্দীস তাকে দ্বয়ীফ,মিথ্যাবাদী,মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য ইত্যাদি বলেন । [২২]

এত নিরীক্ষণের পর এই দ্বয়ীফ হাদীসের উপর তাদের আমল ও ফাতওয়া আছে, কেননা তা তাদের মতের তাই । এসব আলোচনা ও উপস্থাপিত প্রমাণাদি হতে বুঝা যায়- দ্বয়ীফ হাদীস সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা যাবেনা । এটা সালফে সালেহীন,মুতাকাদ্দেমীন ওয়া মুতাআক্ষিরীন, মুহাদ্দেসীন,মুফাসসিরীন, ফুকাহা কেরাম ও আহলে সুন্নাতের আমল ও আক্বিদা বিরধী । এটা নামধারী সালাফ ও আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের আমল । তাদের এই দ্বয়ীফ হাদীস সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার হাদিস অস্বীকারের চিরন্তুন রূপ । আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দু’আ এত কিছু জানার পর যেন তা গ্রহণ করার তাওফিক দেন। আমীন! বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন ।

প্রবন্ধ সূত্রঃ

MONTHLY TAHAFFUZ

Website : http://tahaffuz.com 

তথ্যসূত্রঃ

১. সুরা হুজুরাত আয়াতঃ ৬
২. জামে তিরমিযি, শিকার অধ্যায় [أَبْوَابُ الصَّيْدِ] হাদীস নং- ১৪৬৭
৩. জামে তিরমিযি, আহার করা অধ্যায় [أَبْوَابُ الْأَطْعِمَةِ] হাদীস নং- ১৪৬৭
৪. আসকালানী তাকরীবুত তাহযীব ৩৪৪ পৃষ্ঠা , দারুর রশীদ সিরিয়া ।
৫.তাহযীবুল কামাল ১৭:২০৯ মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ বৈরুত ।
৬.প্রাগুপ্ত ।
৭.জামে তিরমিযি, বিধি বিধানঅধ্যায় [أَبْوَابُ الْأَحْكَامِ] হাদীস নং- ১৩৬৫
৮. আসকালানী আত তালখীসুল হাবীর ৪:৫০৮ হাদীস-২১৪৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত ।
৯.ইবনুল আসীর, আন নিহায়া ফি গারীবিল হাদীস ওয়াল আছার ২:২১১ আল মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাহ বৈরুত ।
১০. রিসালাতু আবী দাউদ ২৮ পৃষ্ঠা , দারুল আরাবিয়্যাহ বৈরুত ।
১১. প্রাগুপ্ত ২৯ পৃষ্ঠা ।
১২. ইবন হাজর কৃত আন নুকতু আলা ইবনুস সালাহ ১:৪৩৫ ।
১৩. ইবনুল বার কৃত আত তামহীদ ১:৫৮ ।
১৪. নাসাঈ,আদ দ্বু’আফা ওয়াল মাতরুকুন ১:১৯ বাবুল হামযা ।
১৫. যাহাবী আল মুগনী ফিদ দ্বু’আফা ১:৯০, ৭৪৭ নং রাবী ।
১৬. আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ১:৩৪৫ রাবী নং-৬২৮ ।
১৭. সহীহ বুখারী, কিতাবুস সালাত ১:২০২ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ।
১৮. সুনানে তিরমিযি ১:৩৭ ত্বাহারাত অধ্যায় হাদীস নং-২৫ ।
১৯. মুবারকপুরী তুহফাতুল আওযাহী ১:৯৩ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত ।
২০. সুনানে ইবন মাজাহ ১:২৭৮ হাদীস নং-৮৫৩ ।
২১. সুনানে তিরমিযি ১:২৯২ সালাত অধ্যায় হাদিস নং-১৫৫ ।
২২. যাহাবী মীযানুল ই’তিদাল ১:৫৮৩ রাবী নং-২২১৫ দারুল মা’রেফাহ বৈরুত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *