ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাঃ কোরআন, সুন্নাহ্ ও ইজমা’র আলোকে [দ্বিতীয় পর্ব]

[প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে]

মূলঃ আল্লামা ঈ’ছামানে আল্ হিময়ারী

জেনারেল ডাইরেক্টর – ওয়াক্‌ফ ও ধর্মীয় বিষয়ক দপ্তর, দুবাই, ইউ.এ.ই.

ভাষান্তরঃ আল্লামা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী।

 

 

  • পঞ্চম দলীলঃ মহান রাব্বুল ইজ্জতের ফরমান-

لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

অর্থাৎ – যাতে হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো এবং রাসূলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।  – (সূরা ফাত্‌হ  ৯)

সম্মানিত তাফসীরকারকগণ উক্ত আয়াতের দু’ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

(১) একদল তাফসীরকারক জমীরগুলোর(সর্বনাম) মধ্যে পার্থক্য করেনি।

(২) অন্যদল তাফসীরকারকগণ জমীরগুলোর মধ্যে পার্থক্য করেছেন।

 

প্রথম দলের তাফসীরের সারমর্মঃ

উক্ত আয়াতে করীমার সমস্ত জমীরের (সর্বনাম) প্রত্যাবর্তন স্থল হলো আল্লাহ্ অথবা তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। মুফাচ্ছিরীনে কেরামের একদল কর্তৃক সমর্থিত যা ইমাম নববী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) মত প্রকাশ করেছেন।

আর যাঁরা সর্বনামের প্রত্যাবর্তনস্থল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি বলে মত প্রকাশ করেছেন তাঁদের অভিমত হলো-

(১) উক্ত আয়াতে পাকে হুজুর আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য হওয়াই সমর্থিত কেননা এটাই নিকটবর্তী।

(২) প্রয়োজন ব্যতিরেকে সর্বনামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা বৈধ নয়।

(৩) উক্ত আয়াতের (তুছাব্বিহহু) অর্থ দোষত্রুটি মুক্ত হওয়া এবং তাঁর মঙ্গল কামনা করা।

 

দ্বিতীয় দলের তাফসীরের সারকথাঃ

যাঁরা আয়াতে পাকের জমিরের(সর্বনামের) মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেন তাঁরা মত ব্যক্ত করেন-

উক্ত আয়াতে পাক এর উল্লিখিত জমির(সর্বনাম) মহান আল্লাহ্ পাকের দিকে প্রত্যাবর্তিত। আর এর মধ্যে যে জমির রয়েছে উভয় জমির হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দিকে প্রত্যাবর্তিত। হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দিকে জমির (সর্বনাম)দ্বয়ের প্রত্যাবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হলো তাঁর প্রতি সম্মান, ভক্তি আর মর্যাদা প্রদর্শন করা যা, আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা প্রকাশে সহায়ক হয়। এটা আরবী অলঙ্কার শাস্ত্রের (বালাগাতের) একটি চমৎকার নিয়মনীতি যা, লফ্‌ফে নশর হিসেবে প্রসিদ্ধ।

 

  • ষষ্ঠ দলীলঃ  ফরমানে বারী তা’য়ালা রয়েছে-

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ

অর্থাৎ – নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের উপর যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল। – (সূরা আল ইমরান ১৬৪)

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-

“নিশ্চয় সৃষ্টি জগতে রাসূল প্রেরণ জগতবাসীর জন্য এক অনন্য অনুগ্রহ। মহান আল্লাহ্ পাক এর মাধ্যমে আরবদের সম্মানিত করেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে ইমামুল আম্বিয়া রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমনের কারণে তারা ছাগল চারণ থেকে জাতির নেতৃত্বের উচ্চাসনে আসীন হয়েছেন এবং শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। তাদেরকে অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে উদ্ধার করে নেতৃত্বদানকারী এবং আদর্শরূপে মানুষের মাঝে সমাদৃত করেছেন।

এ ছাড়াও সমগ্রজাতির উপর তাঁদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। যেভাবে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস্ সালাম)‘কে নিয়ে ইয়াহুদী-নাসারা এবং আরবগণ গর্ববোধ করতেন। ঠিক তেমনিভাবে ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টানগণ হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আলাইহিমাস্ সালাম আর তাওরাত শরীফ ও ইঞ্জিল শরীফ নিয়েও গর্ববোধ করতেন।

আর আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত যখন প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘কে পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেন এবং তাঁর  উপর কোরআনুল করীম অবতীর্ণ করেন তখন আরবদের জন্য এটা মর্যাদার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়, আর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির সম্মানে ভূষিত হয়।

বাস্তবিক পক্ষে যারা সত্যের চোঁখে এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম এটা অকাট্য দলীলের আলোকে তাঁরাই উক্ত নেয়ামতের খুশী লাভে সামর্থ। উক্ত আয়াতে পাক-ই দলীলের জন্য যথেষ্ট। এটা চির সত্য যে, এই ইহসানের কোন বিনিময় নেই। তাই ইহসানের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে আনন্দ প্রকাশ করা, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়াই উদ্যাপনকারীর চরম চাওয়া আর পাওয়া। যা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)উপর সালাত ও সালাম পাঠে রয়েছে। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে যতই আনন্দ, শ্রদ্ধা, সম্মান নিবেদন করা হোক না কেন, আর মুসলমানগণ তাঁর উপর যতই দরূদ পাঠ করুক না কেন, সবই তাঁর মর্যাদার তুলনায় খুবই নগণ্য। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা স্বয়ং তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর দরূদ পাঠ করে থাকেন, যা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শ্রেষ্ঠত্বের জন্য যথেষ্ট। এটা এতই মর্যাদা সম্পন্ন, যা তাঁকে সম্মানের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে উম্মতগণ চিরদিন উপকৃত হয়ে থাকবেন।

 

  • সপ্তম দলীলঃ মাওলায়ে কায়েনাতের বাণী-

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থাৎ – নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ দরূদ প্রেরণ করেন ঐ অদৃশ্যবক্তা (নবী)‘র প্রতি, হে ঈমানদারগণ! তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর। -(সূরা আহযাব ৫৬)

উক্ত আয়াতে পাকে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মান সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সর্বকালের জন্য খুবই চমৎকার দলীল। কেননা নবীপ্রেম ও ভক্তিই দ্বীনের মূল ভিত্তি। সমস্ত ইবাদত বন্দেগী একে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে এবং তাঁর ভালবাসা অন্তরে রাখার উপর সবকিছু নির্ভরশীল। এটা খুবই মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপার। সত্য বলতে কি এমন কোন মিলাদুন্নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র অনুষ্ঠান উদযাপন হয়না, যাতে নবীজির উপর অসংখ্য দরূদ পাঠে অন্তর ধাবিত হয়না। সাথে সাথে সকলের ইচ্ছা জাগে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর বংশধরদের ভালবাসা যেন তাঁদের অন্তরে বৃদ্ধি পায় যা ঈমানের মূলভিত্তি এবং অন্তরের দৃঢ়তা রূপে প্রকাশ পায়। এ উপলক্ষে যে আনন্দ উল্লাস পরিলক্ষিত হয় সে ব্যাপারে তা বাস্তবায়ন করাতে তাঁরা সম্মানিত হয়েছেন। তিনি তাঁর বান্দাহদেরকেও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর দরূদ পাঠের জোর তাগিদ প্রদান করেছেন। এ হুকুম মান্য করাতে তাঁরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। মু’মিনদের উদ্দেশ্যে এই হুকুম প্রদান করার মধ্যে রহস্য রয়েছে। কেননা উক্ত স্থানে তিনি তাঁর বান্দাহদের ‘হে মুসলমানগণ’ বলে সম্বোধন করেন নি বরং তিনি ‘হে মুমিনগণ’ বলে সম্বোধন করেছেন। কেননা তার প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র মর্যাদা ও অবস্থান কত যে সুমহান তা মুমিনগণই যথাযথ জ্ঞাত, যা শুধু মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। যেমন ফরমানে ইলাহী-

قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا

অর্থাৎ মরুবাসীরা বললো, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ (হে হাবীব!) আপনি বলুন, তোমরাতো ঈমান আননি, হাঁ এমনই বলো ‘আমরা অনুগত হয়েছি এবং এখন ঈমান তোমাদের অন্তরসমূহে কোথায় প্রবেশ করেছে? প্রকৃত ভালবাসা ঈমান ব্যতিরেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, আর প্রগাঢ় প্রেম অন্তরে ধারণ করা ব্যতীত ঈমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ আদৌ সম্ভব নয়। -( সূরা হুজরাত ১৪)

 

  • অষ্টম দলীলঃ

কোরআনে পাকে মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান-

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

অর্থাৎ – পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন বান্দাহকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশে পাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন নিদর্শনসমূহ দেখাই, নিশ্চয় তিনি শুনেন দেখেন।-(সূরা বনী ইসরাঈল ১)

প্রিয় পাঠকগণ! এটা কোরআনে পাকের অকাট্য প্রমাণ। আপনারা সকলেই সুস্পষ্টভাবে পরিজ্ঞাত যে, তাঁর হাবীব (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র প্রতি কতই প্রগাঢ় প্রেমভালবাসা রয়েছে, আর সৃষ্টি জগতে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র) মর্যাদার গুরুত্ব কী চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। এটা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আয়াতে পাক, যাতে আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র মর্যাদার বর্ণনার পূর্বে আপন পূতঃপবিত্রতার বর্ণনা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। এর দ্বারা হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র প্রতি তাঁর প্রেম ভালবাসা, মান মর্যাদা রয়েছে এটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর দৃষ্টান্ত স্বরূপ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র বাণী প্রণিধাণযোগ্য। যেমন, তিনি বলেন-

আরবী ইবারত

অর্থাৎ – “(হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক সর্বদা আপনার ভালবাসা তথা সন্তুষ্টিতেই মগ্ন।”

তিনি ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের মহান সৃষ্টিকর্তা, যিনি তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্রতা, সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেক স্থানে তাঁর নামের সাথে বন্ধুর নাম সংযোজন করেছেন। এমনকি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাম ব্যতিরেকে কলেমায়ে শাহাদাতেও ঈমানের পূর্ণাঙ্গতা লাভ হবে না, নামাযের ক্ষেত্রে ও তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামের স্মরণ অনস্বীকার্য, না হয় তাও আদায় হবে না। শুধু তাই নয়, তাঁর স্বশরীরে উপস্থিতি ব্যতিরেকে মেরাজের অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হয়নি। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে বর্তমানে এমন বাতিল ফেরকার আবির্ভাব ঘটেছে, যারা নামাযে হুজুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র খেয়াল আসা গরু-গাধার খেয়ালের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে মন্তব্য করে থাকে এবং তারা স্বশরীরে মেরাজ স্বীকার করেনা (নাঊযুবিল্লাহ্)।

এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীর সম্মান যেভাবে বৃদ্ধি করেছেন, তাঁর উম্মতের মর্যাদাও তেমনিভাবে সমুন্নত করেছেন। আর ঐ ব্যক্তি নিজ সম্মান নিজেই বিনষ্ট করেছে যে নবীজীর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছে। অথচ স্বয়ং রাব্বুল আলামীন তাঁর মান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সমস্ত নবী, রাসূল ও ছিদ্দীক্বীনদের চেয়েও অধিক বলে ঘোষণা করেছেন। এ কারণেই নবীজীর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে সকলের সম্যক জ্ঞান থাকা অতীব প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আর তিনিই হলেন সকলের ইমাম আর সকলেই তাঁর মুক্বতাদী।

মেরাজের ঐতিহাসিক ঘটনা যদি পর্যালোচনা করা হয় তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মেরাজ আমাদের জন্য ঈদের আনন্দ ও খুশীর ন্যায়। ঐ রাত্রিতেই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পূর্বাপর নবী-রাসূলগণ, ছিদ্দীকগণ, ছালিহীন এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের একত্রিত করে তাঁর প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র ইমামতিতে নামায আদায় করানোর মাধ্যমে সকলকে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যাতে সকলেই এ ব্যাপারে সজাগ থাকে।

অতঃপর তিনি তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে উর্ধ্বজগতে প্ররিভ্রমন করিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে আসমান-যমীন তথা সমগ্র সৃষ্টিজগত এই মহাখুশীতে অংশীদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে, এটা এমন এক ঐতিহাসিক দিন যেদিন মহান সৃষ্টিকর্তা মুমিনদের জন্য তাঁর অনুগ্রহের পূর্ণাঙ্গতা প্রদান করেছেন। আর নবীয়ে দোজাহাঁ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ রজনীতে পবিত্র স্থানসমূহ পরিদর্শন করার সুযোগ লাভ করেছেন, এরপর ঐ পবিত্র রজনীতেই প্রত্যাবর্তন করেছেন। শুধু তাই নয়, ঐ রজনীতে তিনি তাঁর প্রতিপালকের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতঃ কথোপকথন ও আরজি পেশ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসার সময় মু’মিনদের মেরাজ নামায নিয়ে এসেছেন; যেন তারাও তাদের নামাযের মাধ্যমে প্রতিপালকের সাথে অন্তরে মেরাজ করতে সক্ষম হয়। নবীয়ে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মাধ্যমে কি অমূল্য পুরষ্কার অর্জিত হয়েছে, যার মর্যাদা মাওলায়ে কায়েনাত ইহজগত ও পরজগতে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর তা মহাপ্রলয়ের দিন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এমন এক মুহর্তে প্রকাশ ঘটাবেন, যখন সকলেই নিজ হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং ‘ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী’ বলে দৌড়াতে থাকবেন। ঠিক সে মুহর্তেই দিশেহারা মুসলমানদের শাফায়াতের কান্ডারী উচ্চস্বরে ঘোষণা দিতে থাকবেন “আমিই আজ শাফায়াতের জন্য যোগ্য” আর ঐ মহাসঙ্কটের দিন সৃষ্টিকর্তা এমন রাগান্বিত থাকবেন যার পূর্বাপর সে দৃশ্য পরিলক্ষিত হবে না।

ঠিক সে কঠিন মূহুর্তে আল্লাহ্ তাবারকা ওয়া তা’আলা সমগ্র সৃষ্টিকে নির্দেশ প্রদান করবেন যেন তাঁর প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট সকলেই শাফায়াত প্রার্থনা করে তার উচ্চাসন ও মহা মর্যাদার চিত্র সকলের সামনে প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। আজ অভিনন্দন সে মহা সৌভাগ্যবান ব্যক্তির জন্য যিনি সর্বদা শাফীউল মুযনিবীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর দরূদ পাঠ করে নিজ মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছেন এবং এর মাধ্যমেই আজ সফলকাম হিসেবে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবেন। দরূদ এবং শান্তি ঐ সত্ত্বার উপর বর্ষিত হোক যিনি নূরানী কন্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন-

(হাদীস)আরবী ইবারত

অর্থাৎ – “ঐ ব্যক্তিই কিয়ামত দিবসে আমার অত্যাধিক নৈকট্য অর্জন করতে পারবে, যে আমার উপর অধিকহারে দরূদ পাঠে নিয়োজিত থাকে।”

তাই অভিনন্দন সে, ব্যক্তির জন্য যে রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর অতিমাত্রায় দরূদ শরীফ পাঠ করেন এবং এর উপর স্থায়ীভাবে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন যা জীবনের শুরু থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ে বিরাজমান, তখনই ঐ সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ এবং বন্ধুরূপে পরিগণিত হয়ে থাকেন।

 

  • নবম দলীলঃ মহান পূতঃ পবিত্র সত্তার ফরমানে আলী-

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ

অর্থাৎ – “নিশ্চয় আমি সেটাকে বরকতময় রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা দুখান ৩)

আরো এরশাদ হয়েছে-

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

অর্থাৎ – “নিশ্চয় আমি সেটা ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।”(সূরা ক্বদর ১)

আয়াতদ্বয়ে মহান পালনকর্তা কোরআন মজীদ অবতীর্ণের রাত্রির গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও যাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ নবীকুল সম্রাট হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মর্যাদা ও সম্মানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কেননা তা অতি বরকতময় ফজিলত মন্ডিত।

দয়াময় খোদা আরো ঘোষণা করেন-

وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ(4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)

অর্থাৎ – এবং আপনি কি জানেন ক্বদর রাত্রি কি? ক্বদরের রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম। এতে ফেরেশতাগণ ও জিব্রাঈল অবতীর্ণ হয়ে থাকে স্বীয় প্রতিপালকের আদেশে প্রত্যেক কাজের জন্য। ওটা শান্তি ভোর উদয় হওয়া পর্যন্ত।[সূরা ক্বদর ১-৫]

মোট কথা মহান দয়ালু খোদা প্রত্যেক বছর ক্বদর রাতের শুভাগমন ঘটান। আর প্রত্যেক মাসে ফেরেশতার দল জগতবাসীর পূণ্যাত্মা সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র আত্মার সাথে পরিভ্রমন ঘটান। এটা শুধুমাত্র বিশাল মর্যাদার ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য। আর এটা বারংবার স্মৃতিপটে আনার মূল উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টিকুলের নবীসম্রাট হুজুরে আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসার গভীরতা সম্পর্কে যাতে চিন্তাশক্তি ও জ্ঞান অর্জন করা যায়।

 

পবিত্র কোরআন মজীদের যদি এত মর্যাদা হয় আর যাঁর শানে, যাঁর উদ্দেশ্যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, কোরআনে পাকে যাঁর প্রশংসা ও গুণাগুণের সমাবেশ ঘটেছে সে সত্তার কী মর্যাদা হতে পারে?  নিঃসন্দেহে বলা যায় সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মর্যাদা ও অবস্থান কোরআনে পাকের অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ্ পাকের যে কোন নির্দেশনাবলীর গুরুত্ব ও মান যে কোন স্থান-কালের সাথে সম্পৃক্ত, এর আনন্দ উল্লাস কিন্তু নির্দিষ্ট বা সীমিত হয়না। আর এটা সর্বদা স্মরণযোগ্য হয়। কেননা, এ এক অপরিসীম করুণা এবং ব্যাপক অনুগ্রহ ও কল্যাণ। মহান করুণাময় প্রত্যুষে আয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। আর প্রত্যুষকাল বলতে আমরা জানি প্রকৃতপক্ষে উদীয়মান ভোরের আলো। তদ্রুপ সৃষ্টিকুল শ্রেষ্ঠ হুজুরে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মীলাদ শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, মহাত্ম বর্ণনা করা, আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করা সবই দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট তথা অনস্বীকার্য প্রণিধানযোগ্য। যার শেষ পরিণাম মঙ্গলজনক। যা যথাযথভাবে পালন করলে মহাবিপদের দিবসে আরশের নীচে ‘লেওয়ায়ে আহমদী’র ছায়াতলে আশ্রয়লাভে ধন্য হবেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং হাত মোবারকে সুস্বাধু পানি পান করার সৌভাগ্য অর্জন করবেন, যে পানি পান করার পর আর কোন দিন তৃষ্ণার্থ হবেন না। অর্থাৎ চিরকালের জন্য তৃষ্ণা মিটে যাবে।

[তৃতীয় পর্ব]


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

বইঃ নবীগণ সশরীরে জীবিত (ফ্রী ডাউনলোড)

নবীকূল সর্দার, রাসূলগণের ইমাম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এবং অন্যান্য নবী রাসূলগণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading