মুফতী আল্লামা সাইয়্যেদ যিয়াউদ্দীন নক্সবন্দী (দাঃ বাঃ)
সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দুনিয়াতে শুভাগমন ৫ই শা’বানে হয়েছিল। হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা স্বয়ং নিজ থু থু মুবার দ্বারা তাকে তাহনীক করেন এবং ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মুখের মধ্যে নিজ মুখের থু থু মুবারক ঢেলে দেন। কানের মধ্যে আযানের বাক্যাবলী উচ্চারনের পর তাঁর নাম রাখেন “হুসাইন”। অতঃপর হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা তাঁর জন্য বরকতময় দু’আ করেন এবং জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর আক্বীকা দেন। আশুরা’র দিন অর্থাৎ ১০ই মুহাররম ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কারবালার ময়দানে যালিম ইয়াজিদ বাহিনী শহিদ করে। হযরত ইমামে আলী মাক্বাম ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মহান মর্যাদা এবং অগণিত ফযিলত বিদ্যমান রয়েছে।
ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর পবিত্র সত্তার আপাদমস্তক ছিল একটি কারামত। এরই প্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত আকারে ইমাম পাকের অগণিত কারামত হতে কিছু কারামত চয়ন করা হচ্ছে।
- কারামত – ০১
মুখের থু থু মুবারক এর বরকত
তৃতীয় হিজরি শতাব্দির হাদিস বিশারদ মুহাম্মদ বিন সা’আদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি(ওফাত ২৩০ হিঃ) ‘আত্ ত্ববাকাতুল কুবরা’ নামক কিতবে বর্ণনা করেছেন,
হযরত আবু আওন রহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মদিনা শরিফ থেকে মক্কা মুয়াজ্জামায় যাচ্ছিলেন, তখন ইবনে মু’তী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র পাশ দিয়ে তিনি অতিক্রম করছিলেন, যিনি কিনা তখন একটি কূপ খনন করছিলেন। সেই ব্যক্তি ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিকট আরয করলেন- আমার মাতা-পিতা আপনার প্রতি উৎসর্গীত! আপনি কোথায় রওনা হয়েছেন? ইমাম পাক বললেন- মক্কা শরিফের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। ইবনে মু’তীর নিকট (ইমাম হুসাইন) আরো বললেন যে, কূফার শিয়ারা আমাকে পত্র প্রেরণ করেছে। (একথা শুনে) ইবনে মু’তী বললেন- আমার মাতা-পিতা আপনার প্রতি উৎসর্গীত হোক ! আপনি আপনার পবিত্র সত্তা দ্বারা আমাদেরকে অত্যাধিক ফয়েজ দানে ধন্য করুন এবং তাদের (কূফাবাসীর) নিকট দয়া করে যাবেন না। ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিলেন। এরপর ইবনে মু’তী নিজের একটি বিষয় সম্পর্কে ইমাম পাক কে (এই বলে) আবেদন জানালেন- আমি এই কূপটি খনন করেছি; কিন্তু আজকে ডোল(কূপ হতে পানি উঠাতে ব্যবহৃত লোহা বা চামড়া দ্বারা বানানো পাত্র) এর মধ্যে সামান্য পরিমান পানি এসেছে। আপনি এই কূপের মধ্যে বরকতের জন্য আল্লাহ তায়ালা’র নিকট প্রার্থণা করুন! ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন- (এই কূপ হতে) কিছুটা পানি আন। অতঃপর যখন ইমাম পাকের সামনে পানি আনা হল, ইমাম পাক কিছুটা পানি মুখে নিয়ে কুলি করলেন এবং তারপর ঐ কুলি করা পানি কূপে নিক্ষেপ করলেন; ঠিক তখনই কূপের পানি মিষ্টির মত হয়ে গেল এবং কূপের উপরিভাগ পর্যন্ত উঠে টলমল করতে লাগলো। [ইবনে সা’দ কৃত “আত্ ত্ববাকাতে কুবরা”, বাবু আবু সাঈদ]
ইমামে আলী মাক্বাম হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জিহ্বা এবং মুখ মুবারকের এই মর্যাদা এজন্য অর্জিত হয়েছিল যে, নবীগণের সর্দার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইমাম পাকের শৈশবে তাঁর জিহ্বাকে চুষতেন এবং ইমাম পাকের মুখ মুবারকের মধ্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা নিজ থু থু মুবারক ঢেলেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে তাঁর প্রভাব ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জিহ্বা এবং থু থু এর মধ্যে এসে গিয়েছিল। এরই কারণে ইমাম পাকের থু থু মুবারক লবনাক্ত পানিকে মিঠা বানিয়ে দিত এবং শুকনো কূপ কে জলে ভর্তি কূপে পরিণত করে দিত। সুবহানাল্লাহ
- কারামত – ০২
তীর নিক্ষেপকারীর ভয়ংকর পরিণতি
আল্লামা মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সালিহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (ওফাত ৯৪২ হিঃ) তাঁর “সুবুলুল হুদা ওয়ার রিশাদ” নামক কিতাবে বর্ণনা করেন যে,
হযরত আব্বাস বিন হিশাম বিন মুহাম্মদ কুফী নিজ পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন- যার’আহ নামক এক ব্যক্তি কারবালা প্রান্তরে অবস্থান করছিল। সেই পাপিষ্ঠ ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র দিকে ঠিক ঐ সময় তীর নিক্ষেপ করেছিল, যখন তিনি পান করার জন্য পানি অন্বেষন করছিলেন এবং পান করতে চাইলেন। তীরটি ইমাম পাক রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং পানির মধ্যকার বাধা সৃষ্টি করল। ইমামে আলী মাক্বাম হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু দু’আ করলেন যে, হে মাওলা ! ঐ তীর নিক্ষেপকারীকে পিপাসার্ত করে দিন। বর্ণনাকারী বলেন যে, তার(ঐ তীর নিক্ষেপকারী ব্যক্তির) মৃত্যূর সময় উপস্থিত এক ব্যক্তি আমাকে বর্ণনা করলো যে, ঐ ব্যক্তির পেটে গরম এবং পিঠে ঠান্ডা অনুভব হতে লাগলো; যে কারণে সে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগলো। যখনকিনা পেটের গরম থেকে আরাম পেতে তার সামনে বরফ ও পাখা রাখা হয়েছিল এবং পিঠের ঠান্ডার কারণে পিছনে আগুন ভর্তি পাত্র রাখা হয়েছিল; সে তখন বলছিল- আমাকে পানি পান করাও ! তৃষ্ণা আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তখন তার নিকট ছাতু, পানি এবং দুধ মিশ্রিত এতটাই অধিক মধু রাখা হত, যা কিনা পাঁচ ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল; সে তখন একাই সেগুলো খেয়ে ফেলতো। অতঃপর এটাই বলতো যে, আমাকে পান করাও ! তৃষ্ণা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। একপর্যায়ে তার পেট বিদীর্ণ হয়ে গেল, যেমনিভাবে উটের পেট বিদীর্ণ হয়ে যায়। [সুবুলুল হুদা ওয়ার রিশাদ, দ্বিতীয় অধ্যায়, খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ৭৯]
যেই শাহজাদার মুহাব্বত এবং মুয়াদ্দাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হয়েছে। হাদিসে পাকের মধ্যে যার মর্যাদা বর্ণনা হয়েছে; তার দিকে তীর নিক্ষেপকারীর দুনিয়ায় এরূপ ভয়ংকর পরিণতি হয়েছে যে, আরাম এবং প্রশান্তির যাবতীয় মাধ্যম দুনিয়াতে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আরাম এবং প্রশান্তির কোনটাই সে অর্জন করতে পারল না। সে পেটের মধ্যে গরম এবং জ্বালাপোড়ায় পতিত থাকলো এবং পিঠের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর ঠান্ডার দ্বারা ছটফট এবং কাপতে লাগলো। ইমামে আলী মাক্বাম হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের ফলস্বরূপ এরকম ভাবেই সে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলো এবং যখন মৃত্যু আসলো, তখন অত্যন্ত ভয়ানক মৃত্যুর মুখে সে পতিত হলো। আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তিকে এমন বিশাল কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে এটাই স্পষ্ট করলেন যে, পবিত্র আহলে বাইতগণের উপর অত্যাচারকারীদের উপর দুনিয়ার মধ্যেও ভয়ানক পরিণতি হয়ে থাকে এবং পরকালীন শাস্তি তো আরো অত্যাধিক কঠোর হবে তাদের জন্য।
[আল্লামা সাইয়্যেদ যিয়াউদ্দীন নক্সবন্দী এর ‘কারামাতে ইমাম হাসান ওয়া হুসাইন’ হতে লেখাটি অনূদিত ]
অনুবাদঃ মুহাম্মদ মহিউদ্দীন।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.