এডভোকেট মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার
বাংলাদেশের জশনে জুলুস ৪২ বছরে পা দিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। ১২ রবিউল আউয়ালকে ঘিরে এখন বলা যায় সমগ্র মাসব্যাপী -দেশের প্রায় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন বা শহরে -ঈদে মীলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে আয়োজিত হয় এ নির্মল ইসলামি সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এই জশনে জুলুসের সংস্কৃতি আমাদের দুর্বল হয়ে যাওয়া ইসলামি তাহজিব -তামুদ্দুনের ভাৃারকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে। তেমনি আমাদের হাজার বছরের মীলাদের জৌলুশে এনেছে বৈচিত্র্য ও চাঙ্গাভাব। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে হঠাৎ করে ঈদে মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিরোধী একটি চক্র চাঙ্গা হয়ে ওঠেছিল, এই চক্রটি মীলাদের জায়গায় ‘সীরাত’ লিখতে শুরু করেছিল। এ নিয়ে যখন সুন্নি মুসলমানদের সাথে বাতেলদের পাল্টাপাল্টি মাহফিল -বক্তব্য -লেখালেখির এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের এ দেশের মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ অনুগ্রহ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। মহান সংস্কারক অলী। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তিনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে মীলাদের পক্ষে হিকমতপূর্ণ সংস্কার হিসেবে ১৯৭৪ সনে প্রবর্তন করেন জশনে জুলুস, যা ‘জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে আজ বহুল পরিচিত এবং সমাদৃত। তাঁর এই নতুন প্রবর্তন প্রথম চালু হয় চট্টগ্রামে। তাঁরই নির্দেশনা ও রূপরেখা অনুসরণে -তাঁরই প্রতিষ্ঠান আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায়। চট্টগ্রাম কোরবানিগঞ্জের বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকাহ্ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া থেকে যাত্রা করে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে এ জসনে জুলুস এসে আলোচনা, মাহফিল, মীলাদ, কেয়াম এবং দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এটিই ছিল বাংলাদেশেরর ইতিহাসের প্রথম জসনে জুলুস, তখন এর নেতৃত্ব দেন আনজুমানের সিনিয়র সহ সভাপতি আলহাজ নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯৭৬ সনের ১২ রবিউল আউয়াল, বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরো বহুদেশে এ জুলুস প্রবর্তনকারী মহান মুজাদ্দিদ নিজেই নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের জসনে জুলুসে। ফলে এতে এসে যায় এক নবচেতনা এবং বাঁধভাঙ্গা জোয়ার যা প্রতিবছর দ্বিগুণ উৎসাহ ও মানব বন্যায় সম্প্রসারিত হতে থাকে।
১৯৮৬ সনে লাখো নবী প্রেমিক মুসলমানদের এ শরিয়তসম্মত আনন্দ মিছিলের প্রভাব সমগ্র দেশকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। বাঁধভাঙ্গা এ জোয়ারের প্রবল স্রোত সমগ্র দেশকে ধাক্কা দেয়। শুরুতে কেউ কেউ বুঝে -না বুঝে এ নতুন সংস্কৃতির সমালোচনায় মুখর হলেও এ সময় কিন্তু সবকিছু থমকে যায় এবং দেশের প্রায় সুন্নি – সূফি চিন্তাধারার দরবার-সংস্থা -সংগঠন নীরবতা ভেঙ্গে জশনে জুলুস পালনের চিন্তাভাবনা এবং কর্মসূচি নিতে শুরু করে। ফলে, এখন ১২ রবিউল আউয়াল দিবসে মনে হবে জশনে জুলুস সমগ্র দেশ যেন দখল করে নিয়েছে। বিশেষত, চট্টগ্রামের মানুষ এ দিনটির জন্য পুরো বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে। আজ এ কথা অনস্বীকার্য যে চট্টগ্রামে এর চেয়ে বড় কোন প্রকারের আয়োজন এ পর্যন্ত হয়নি। চট্টগ্রামে জশনে জুলুসে যোগ দেয় আনুমানিক পঁচিশ লাখ মানুষ। যা শুধু চট্টগ্রামের ইতিহাস -ঐতিহ্যের ধারায় প্রধান কোন আয়োজন শুধু নয়, বরং এটি বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী’র মর্যাদার দাবিদার।
জশনে জুলুসের ৪২ বছরের প্রথম দুই বছর ছিল সূচনা পর্ব। ১৯৭৬-৮৬ এক দশক ছিল প্রতিষ্ঠা পর্ব। যখন নেতৃত্বদান করেন এর প্রবর্তক আল্লামা সৈয়্যদ তৈয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নিজেই। ১৯৮৭-২০১৬ একাধারে তিন দশকের নেতৃত্বে আছেন এর প্রবর্তকের সাজ্জাদানশীন হযরত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (ম.জি.আ.)। এ ত্রিশ বছরকে সম্প্রসারণশীল অধ্যায় বলতে পারি। এখন, আর সীরাতের বাড়াবাড়ি নাই বলা চলে, আছে শুধু মীলাদ আর মীলাদ, জুলুস আর জুলুস। চলতি হিজরি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংস্কার হলো এই -জসনে জুলুস, আর এ হিজরির মহান সংস্কারক হলেন এর প্রবর্তক আওলাদে রাসুল, গাউসে জামান, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। আগে আমরা বলতাম -সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মীলাদুন্নবী। এখন তা বাস্তবে উপলব্ধি করি -যখন লাখো মু’মিন সালাত -সালাম, না’ত -ক্বেরাত আর না’রা ধ্বনিতে আকাশ – বাতাস মুখরিত করে সম্মিলিত ঈদমিছিলে পথ চলে। সেদিন যেন আনন্দের আর কোন সীমা থাকেনা। চট্টগ্রামের জন্য এ এক মর্যাদার বিষয় যে -বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এ জশনে জুলুস এখানে উদযাপিত হচ্ছে। বলা যায় বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঈদ উৎসব হয় চট্টগ্রামে। ষোলশহর জামেয়া ময়দান যেন দুনিয়ার সেরা ঈদগাহ্ এখন। এখানে এতো মুসল্লির জোহরের জামাত একত্রে আদায় সম্ভব নয় বিধায় জুলুসের অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী ময়দান পর্যন্ত আসতে পারেনা। এরপরও, কয়েক লাখ মুসলিম একত্রে জোহর আদায় ও আখেরী মুনাজাতে শরিক হয়। এশিয়ার গর্ব জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াকে ঘিরে এক কিলোমিটার এলাকায় যে যেখানে সুযোগ পায় জোহরের নামাজ ও দোয়ায় অংশ নেয়।
নাজিরপাড়া, খতিবেরহাট-মুহাম্মদপুর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আর ভাড়াটিয়া নির্বিশেষে সবাই যোগান দেয় নামাজের সরঞ্জাম –বিছানা ইত্যাদি। বাড়িতে বাড়িতে প্রতিযোগিতা চলে মেহমানদারী করবার। সেই কবে ১৯৮৫’র পর থেকে জসনে জুলুসের তবারুকের আয়োজন কর্তৃপক্ষ আনজুমান ট্রাস্ট বাধ্য হয় বন্ধ করে দিতে। এতো লোকের তবারুক পরিবেশন সহজসাধ্য ছিলনা সে সময়েও। আর, এখনতো তা কল্পনাও করা যায়না। তবে সে সুযোগ এখন সাদরে লুফে নিয়েছে সৌভাগ্যবান এলাকাবাসী। গরু -মহিষ জবাই হয় মহল্লায় মহল্লায়, হাউজিং সোসাইটিগুলোতে। এখন ঘরে ঘরে তবারুকের আয়োজন করে। আর মদীনা শরিফের রমযানের ইফতারের সময়ের মতো মেহমান নিয়ে টানাটানি শুরু হয় এখানে। কী এক জান্নাতি পরিবেশ দেখা যায় ১২ রবিউল আউয়াল দিবসে। সাজানো হয় মহল্লা -রাস্তাঘাট -সড়কসমূহ আলোকসজ্জা করা হয়। মোটকথা সবকিছু মিলিয়ে এক মহান ঈদ পালিত হয় এদিন। আর, এ ঈদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এবং অমূল্য ধন হয়ে ওঠেন আওলাদে রাসুল, আল্লামা তাহের শাহ্ হুজুর কেবলা (ম.জি.আ)। তাঁকে এক নজর কোন প্রকারে দেখার সৌভাগ্যকে গনিমত মনে করা হয়। একসময় জুলুসের প্রবর্তক হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছিলেন ‘‘এয়সা এক ওয়াক্ত আনে ওয়ালা হ্যায় যব হামারে মাশায়েখ -হযরাতে কেরামকো এক নজর দেখনা ভি গনিমত হোগা’’। সমগ্র জুলুস জুড়ে মহড়া চলে নেতৃত্বদানকারী হুজুর কেবলা তাহের শাহ্ কে একনজর দেখবার। এটা যেন ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার। আল্লাহ্ পাক এমন চাঁদবদন নূরানি হুজুর কেবলার হায়াত দারাজ করুন। যিনি আজ ত্রিশটি বছর ধরে এই জসনে জুলুসের আলোক কেন্দ্র হয়ে আমাদের পরম সৌভাগ্যবান করেছেন। ইনশাল্লাহ্, এবারের জসনে জুলুসেরও মধ্যমণি হবেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। বরাবরের মতো প্রথমে ৯ রবিউল আউয়াল ঢাকায় মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সকাল ৮টায় অনুষ্ঠেয় জুলুসের নেতৃত্ব দেবেন। তারপর, ১২ রবিউল আউয়াল সকালে চট্টগ্রাম ষোলশহর আলমগীর খানকাহ্ শরিফ হতে অনুষ্ঠিতব্য জুলুসের নেতৃত্ব দেবেন। আল্লাহ্ কবুল করুন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব
ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সমন্বয় কমিটির সচিব
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.