হিজরী বর্ষের তাৎপর্য

শায়খ আল্লামা মুফতি কাজী মুহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ (দাঃ বাঃ)

 

ইসলাম একটি শাশ্বত ধর্ম। যার পরিপূর্ণতার জন্য আবির্ভাব হয়েছেন হুজূর রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা। এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নবী হিসেবে আগমন হয় মানবপিতা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম এর, যাঁকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলীফা হিসেবে সৃষ্টি করেন। আল্লাহর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের সূচনা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শুরু হয়। ফলে বেহেশত থেকে এ উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে তাঁর শুভাগমন হয়। মূলতঃ তাঁর এ আগমনটা এক প্রকারের হিজরত বা স্বদেশ ত্যাগ। এ হিজরত প্রত্যেক নবীগণের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জারী ছিল। এমন কোন নবী ছিলেন না; যাঁর কোন না কোন প্রকারের হিজরত হয়নি। হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম’র হিজরত হয় তুফানের পর। তুফানের পূর্বে এক জাতি ছিল, তুফানের পর আরেক জাতি সৃষ্টি হয়। তিনি আবার ওই জাতির নিকট প্রেরিত হন। তাই তাঁর এ অবস্থাও এক প্রকারের হিজরত। হযরত ইদ্রিস আলাইহিস্ সালাম’র ব্যাপারেও তাই। জীবিতাবস্থায় তাঁর বেহেশতে গমন এটা তাঁর পক্ষে হিজরত। এভাবে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম সুদূর ইরাক থেকে হিজরত করে সিরিয়ায় তাঁর আগমন ঘটে এবং সেখানে তাঁর অবস্থান হয়।

এভাবে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস্ সালাম’র ব্যাপারেও তাই। সিরিয়ার মধ্যে তাঁর জন্ম হয় এবং আল্লাহর হুকুমে তাঁর আম্মাজান হযরত হাজেরা আলাইহাস্ সালামসহ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম কর্তৃক মক্কা নগরীতে প্রেরিত হন। এটাও এক প্রকারের হিজরত।

হযরত মূসা আলাইহিস্ সালামও মিশরের মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন। পরে ফেরাউনের অত্যাচারে সিরিয়ার মাদায়েন শহরে চলে আসেন। আসার পথে নীল নদে তাঁর মুজিযা স্বরূপ তাঁর কওমের জন্য বারটি রাস্তা হয়। রাস্তা অতিক্রম করে হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম ও তাঁর কওম(জাতি) বনী ইসরাঈল নদীর এ পারে চলে আসেন আর ওপার হতে ফেরাউন ও তার বাহিনী নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে আসলে আল্লাহর হুকুমে পানির মধ্যে তাদের সলিল সমাধি ঘটে।

এভাবে হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম ও তাঁর পিতা হতে ৪০ বৎসর বিচ্ছেদ হয়ে সুদূর মিশরের মধ্যে তাঁর আগমন হয়। আবার ৪০ বৎসর পর উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে। এটাও তাঁর পক্ষে এক প্রকার হিজরত। এভাবে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম’র হিজরত হয়েছে। তাঁকে আসমানে উঠানো হয়েছে। কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতে তাঁর আবার শুভাগমন ঘটবে।

পরিশেষে সেই হিজরত ধারা অনুযায়ী হুজূর সায়্যিদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’রও ঘটেছে হিজরত। তাই হিজরত মূলতঃ পয়গম্বরগণেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ হিজরতই পয়গম্বরগণের মধ্যে নবুয়তী কর্মকান্ডের কার্যক্রমকে গতিশীল করেছে এবং নবীগণের দ্বীনী কার্যক্রমে বিজয় সূচিত হয়েছে।

হিজরতের মর্মার্থে ত্যাগের অর্থই বিরাজমান। আর এ ত্যাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই। আল্লাহর রেজামন্দীর কারণে পার্থিব সম্পর্ক ছিন্ন করাই হিজরতেরই উদ্দেশ্য।

এ জন্য হিজরতই আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে বিজয়ের নিশান। ইসলামের মধ্যে হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র হিজরত মহা তাৎপর্যপূর্ণ। এ হিজরতই ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। এ হিজরতের দ্বারা ইসলাম সুসংহত হয়েছে। এ হিজরতের মাধ্যমে ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ আহ্কাম বাস্তব রূপ লাভ করে। এ হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম জাতির শক্তির পরীক্ষা হয়েছে।

হিজরতের পরে ইসলামের প্রথম যুদ্ধে ইসলামের বিজয় সূচিত হয়েছে। অথচ হিজরতের পূর্বে মক্কা নগরীতে মুসলমানের সংখ্যা কমও ছিলনা। কিন্তু সেখানে পরিবেশ সেই মুসলমানের অনুকুলে ছিল না। তাই হিজরতই ইসলামকে সুসংহত এবং স্থায়িত্বের বীজ বপন করেছে। পাশাপাশি এ হিজরতই এ মুসলিম জাতির মধ্যে ইসলাম প্রচারের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে এবং মুসলমানদের মধ্যে ত্যাগের শিক্ষা প্রদান করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানের মধ্যে ত্যাগ আসবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এ জাতির উন্নতি হবে না।

এ হিজরতই হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ পার্থিব জীবনের দু’টি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। মক্কী জীবন এবং মাদানী জীবন। অনুরূপভাবে কোরআনে পাকের মধ্যে মক্কী ও মাদানী সূরার সূচনা হয়েছে। তেমনিভাবে ইসলামের আহকামের মধ্যেও দু’ধারার প্রবর্তন হয়েছে।

হিজরতের আলোচনা করলে হিজরত সংক্রান্ত সকল ঘটনা সামনে উপস্থিত হয়ে যায়। সিদ্দীকে আকবর রদিয়াল্লাহু আনহু’র ত্যাগ, হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে আল্লাহ্ তায়ালা কর্তৃক হিফাজত করণ, গারে সাওরের(সাওর পর্বতের গুহা) মধ্যে তিন দিন তিন রাত অবস্থান করার পর ১২ দিনে মদীনা শরীফে শুভাগমন করেন। এদিকে মদীনাবাসীরা হুজূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমনের আনন্দে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সাদরে অভ্যর্থনা জানান। আর মদীনাবাসী আনসারগণ হিজরতকারী মুহাজেরদের ভ্রাতৃপ্রতীম ভালবাসায় সিক্ত করে নেন। মুহাজের এবং আনসারদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয় পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। আনসারগণ তাঁদের মুহাজের ভাইদেরকে প্রত্যেক কিছু সমানভাবে ভাগ করে দেন। এমনকি কারো দু’জন স্ত্রী থাকলে মুহাজের ভাইয়ের পছন্দ অনুযায়ী তাঁদের এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাজেরদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। এতে যে আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয়, এ আত্মীয়তার সূত্রকে ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় রাখার জন্য হযরত ওমর ফারূক রদিয়াল্লাহু আনহু হিজরী সনের প্রবর্তনের মাধ্যমে হিজরতের পরিপূর্ণতা ও স্বার্থকতার অনন্য রূপকার হিসেবে আর্বিভূত হন। হযরত ওমর রদিয়াল্লাহু আনহু হিজরতের এসব গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করে হিজরী সনের প্রবর্তন করেন।

কিয়ামত অবধি এ হিজরী সন মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি করবে আর হিজরতের গুরুত্ব ও শিক্ষা মুসলমানগণ যেন গ্রহণ করে ত্যাগ ও মহিমার উচ্চাসনে সমাসীন হয়ে দ্বীন ও মিল্লাতের খেদমতে আত্মনিয়োগ করে। হিজরতের এসব ত্যাগ ও মহিমাকে প্রাধান্য দিয়ে মুসলমানদেরকে প্রত্যেক কাজে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। সেই মহিমার শিক্ষা মুসলমানরা যতদিন বুকে ধারণ করে রেখেছিল, ততদিন ইসলামের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আর মুসলমানরা যখন এ ত্যাগের শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে ইংরেজী নববর্ষের প্রতি বিভিন্নভাবে ঝুঁকে পড়ে ইসলামের সেই ঐতিহ্যকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দেয়, তখনই ইসলামের সেই মোহিনী শক্তি মুসলমানদের থেকে বিলুপ্তি পেতে থাকে। তাই সেই ত্যাগী ও হোসাইনী শক্তি আবির্ভাবের জন্য মুসলমানদেরকে পুনরায় সেই ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে ইসলামের বিজয় কেতন ছিনিয়ে আনার জন্য উদ্যম স্পৃহা নিয়ে নবী প্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। তখনই হিজরী সনের প্রবর্তনের আসলরূপ উদ্ভাসিত হবে। আর প্রত্যেক মুসলমানদের হৃদয়ে হিজরতের তাৎপর্য, মাহাত্ম ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ঈমানী বলে বলীয়ান হবার জন্য স্বীয় চিন্তা-চেতনাকে শানিত করার জন্য, ঈমানদার মুসলমানদেরকে নব উদ্দীপনায় নতুন সাজে ইসলামী কর্মকান্ড তথা ইসলামী সংস্কৃতি প্রবর্তনের জন্য সাধারণ মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তখনই হিজরী সনের প্রবর্তনের স্বার্থকতা মুসলমানদের মাঝে গড়ে উঠবে।

 


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading