মুহাম্মদ মহিউদ্দীন
মজযুব শব্দটি মূলত আরবী। এর মূলধাতু হল- “জযবা” । জযবা শব্দের অর্থ হচ্ছে- আকর্ষণ। মজযুব শব্দের অর্থে ফিরোজুল লুগাত অভিধানে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর ভালবাসায় নিমজ্জিত, আল্লাহর ভালোবাসায় দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্ন,আল্লাহর প্রতি আকর্ষিত, পাগল(আল্লাহর প্রেমে), দিওয়ানা সহ ইত্যাদি। মজযুব সাধারণত আউলিয়ায়ে কিরামদেরই একটি বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে মজযুব হল তাদেরকেই বলে, যারা সর্বদা আল্লাহর প্রেম সাগরে নিমজ্জিত থাকে। যাদের জীবনযাপন সমাজের বাকি আট-দশজনের মত নয়। দুনিয়া হতে যারা নিজেরদেরকে পরিপূর্ণ বিমুখ করে আল্লাহমুখী হয়ে যান। যাদের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত প্রকাশ পায়। বাহ্যিকভাবে তাদের দেখতে মনে হয় শরিয়ত বিবর্জিত। কিন্তু তারা আসলে তা নন। মূলত তারা শরিয়তের চত্বরেই আছেন।
তাসাউফের কিতাব সমূহে এসেছে, আল্লাহর অলীদের মধ্যে দুইটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, ১. সালিক(স্বাভাবিক, যাদের চলাফেরা সমাজের বাকি আট-দশজনের মতই), ২. মজযুব(এরঅর্থ উপরোল্লিখিত হয়েছে) । এখন অলীদের মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্যের আধিক্যের দিক থেকে অলীদের শ্রেণি আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. মজযুবে সালিক : যার মধ্যে সালিক বৈশিষ্ট্য হতে মজযুব বৈশিষ্ট্য অধিকহারে থাকে। ২.সালিকে মজযুব : যার মধ্যে মজযুব বৈশিষ্ট্য হতে সালিক বৈশিষ্টের আধিক্য বেশি।
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই তাসাউফের সূচনা। তাসাউফ এমন একটি নেয়ামত, যার মাধ্যমেই কেবল আল্লাহকে পরিপূর্ণরুপে চেনা সম্ভব। এবং এই তাসাউফের চর্চা স্বয়ং নবীজীর প্রকাশ্য জিন্দেগী হতেই হয়ে আসছে। যার চর্চাকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা। তারই ধারবাহিকতায় এটি আউলিয়ায়ে কিরামগণ পর্যন্ত এসে স্থির হয়েছে। অথচ আফসোস, আজ যে যেভাবে পারছে শরিয়তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাসাউফের নামে ভন্ডামি করে যাচ্ছে। আর এতে করে সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে তাসাউফ সম্পর্কে এক বিরুপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম নিচ্ছে। অথচ তাসাউফ হচ্ছে শরিয়তেরই একটি নির্যাস। তাই বর্তমানে তাসাউফকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই তাসাউফের নামে এসব ভন্ডদেরকে প্রতিহত করাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
সুতরাং বুঝা গেল মজযুব এবং সালিক ব্যতীত আল্লাহর অলী কল্পনাই করা যায় না। কারো মধ্যে সালিক অবস্থাটা মজযুব অবস্থাটা থেকে অধিক থাকে, আর কারো মধ্যে তার বিপরীত। অর্থাৎ কমবেশি দুটি অবস্থায়ই বিদ্যমান থাকে। আমাদের নিকট দৃশ্যায়ন সেটাই হয়, যেটার আধিক্য তার মধ্যে বেশি। এখন আসছি মূল প্রসঙ্গে। বর্তমান সময়ে আমাদের তাসাউফ সম্পর্কে বিশ্বাসকে পুঁজি করে একশ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে মজযুব দাবি করে। অথচ প্রকৃত মজযুব ব্যক্তি কখনো কাউকে বলে না যে, সে মজযুব। বলবেই বা কেমনে, আল্লাহর প্রেমে সে এতটাই বিভোর যে, সে যে মজযুব কি না, এটাই সে জানে না । অন্যদিকে স্ব-ঘোষিত মজযুব নিজ ইচ্ছায় হাতে চুরি, চুলে জটা, নাভি পর্যন্ত দাঁড়ি সহ সমগ্র শরীর লাল কাপর দ্বারা আবৃত রেখে নিজেকে মজযুব জাহির করা শুরু করে। অথচ প্রকৃত মজযুবরা কখনোই তা নিজ ইচ্ছায় করেন না, যা কিছু করেন, সবই আল্লাহর হুকুমেই করেন। এসব ভন্ড মজযুবদের খোজ নিলে দেখা যায়, তারা স্ত্রী-সন্তান লালন-পালন সহ আবার তারা স্ত্রী সম্ভোগও করে। হাট-বাজার সহ দুনিয়াবি যাবতীয় কার্যাদিও তারা সম্পাদন করে। অথচ প্রকৃত মজ্জুব যারা, তারা দুনিয়া হতে একেবারেই বিমুখ, স্ত্রী-সন্তান সহ পরিবার পরিজন সবাইকে ভুলে এক এলাহির প্রেমে সর্বদা পাগলপারা থাকেন। অপরদিকে এসকল তথাকথিত মজযুব’রা নামায-রোযার কথা আসলেই নিজেকে মারেফাতী ঘোষণা দিয়ে মারেফাত নামক পবিত্র বস্তুকে অপব্যাখ্যার দ্বারা শরিয়ত কে নাস্তানাবুদ করার অপকৌশলে লিপ্ত হয়। অথচ শরিয়তবিহীন মারেফাত একেবারেই নিস্প্রাণ। তাই এখন আমরা চতুর্দশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ, আ’লা হাযরাত, আযিমুল বারকাত, ইমাম শাহ আহমাদ রাযা খাঁ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জবান মুবারক থেকে জেনে নিব “মজযুব অলী” চেনার উপায়।
“মালফুযাতে আ’লা হযরত” কিতাবের মধ্যে এসেছে যে, একদা এক ব্যক্তি আ’লা হাযরত আযিমুল বারকাত ইমাম শাহ আহমাদ রাযা খাঁ ফাযেলে বেরেলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে জিজ্ঞাসা করলো- হুজুর, মজযুব’কে কিভাবে চেনা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তরে চতুর্দশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ ইমাম আহমাদ রাযা রাহিমাহুল্লাহ বললেন –
সত্যিকারের মজযুবের পরিচয় হচ্ছে এটাই যে, সে কখনো পবিত্র শরিয়তে’র সাথে মোকাবেলা করবে না। হযরত সাইয়্যিদি মূসা সোহাগ রহমাতুল্লাহি আলাইহি একজন প্রসিদ্ধ মজযুবগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। উনার মাজার শরিফ আহমেদাবাদে অবস্থিত। আমি সেখানে যিয়ারত দ্বারা ধন্য হয়েছি। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় মহিলাদের মত পোষাকে থাকতেন। একদা রাজ্যে প্রচন্ড খরা পড়লো। তখন বাদশাহ, কাজী সহ সবাই একত্রিত হয়ে হযরতের নিকট দোয়া চাইতে গেলেন। হযরত মূসা সোহাগ দোয়া করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং বললেন-“আমি কি দোয়া করার যোগ্য?” যখন লোকদের আবদার-আহাজারি সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন তিনি একটি পাথর খন্ড উঠালেন এবং অপর হাতের চুড়ি’র দিকে প্রসারিত করলেন এবং আসমানের দিকে মুখ উত্তোলন করে বললেন- “মেঘমালা প্রেরণ করুন, নতুবা আপনার সোহাগ আপনি নিয়ে যান।” একথা বলতে না বলতেই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে মেঘ জড়ো হল এবং প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ দ্বারা রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তকে সয়লাব করে দিল। সুবহানাল্লাহ
অত:পর একদিন হযরত মূসা সোহাগ জুম’আর নামাযের সময় বাজারে গমন করছিলেন, একই রাস্তার বিপরীত দিক থেকে শহরের কাজী (শরিয়তের আলোকে বিচারক) সাহেব জামে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। হযরত মূসা সোহাগকে দেখে কাজী সাহেব আল্লাহর নির্দেশ “আমর বিল মা’রুফ (সৎ কাজে আদেশ দাও)” অনু্যায়ী তাঁকে বললেন- এই সাজসজ্জা পুরুষদের জন্য হারাম। পুরুষদের পোষাক পরিধান করুন এবং আমার সাথে নামাযে চলুন। একথা শুনে হযরত মূসা সোহাগ এর বিরুদ্ধে কিছুই বললেন না এবং মসজিদে যাওয়াকে অস্বীকারও করলেন না। চুড়ি, গয়না সহ মেয়েলি জামা-কাপর পরিবর্তন করে মসজিদের দিকে রওনা হলেন মূসা সোহাগ।
আলা হযরত বলছেন, হযরত মূসা সোহাগ রহমাতুল্লাহি আলাইহি মসজিদে গেলেন এবং খুতবা শ্রবণ করলেন। খুতবা শেষে জামা’আতের প্রস্তুতি শুরু হল। ইমাম সাহেব এর “আল্লাহু আকবার” তাকবীর শুনতে না শুনতেই হযরত মূসা সোহাগ রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন- “আল্লাহু আকবার আমার স্বামী, তিনি চিরঞ্জীব এবং কখনোই মরবেন না। তিনিই আমাকে বিধবা করে দেন।” এতটুকু বলতে না বলতেই তৎক্ষণাৎ তাঁর আপাদমস্তক লাল পোষাক দ্বারা আবৃত হয়ে গেল এবং হাতে চুড়ি দেখা গেল। (আফসোস) অন্ধ অনুসরনের কারণে উনার মাজার শরিফ সংলগ্ন কতেক ব্যক্তিকে দেখা যায় যে, তারা চুল বড় রাখে এবং হাতের মধ্যে চুড়ি জাতীয় অলংকার পরিধান করে। এটা গোমরাহী। হযরত মুসা সোহাগ রহমাতুল্লাহি আলাইহি হক্ব ছিলেন; অথচ তার এসব অনুসারীরা গুনাহগার। (এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মজযুব ব্যক্তির অনুসরণ শরিয়তে জায়েয নেই। তথাপি তিনি মজযুব হয়েছেন, কারো অনুসরণ করে না, আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তার মত মজযুব সেজে স্বেচ্ছায় ঘুরে বেড়িয়ে তার অনুসরণ করাটা গোমরাহী- মহিউদ্দীন )
(সূত্র: মালফুযাতে আ’লা হাযরাত, দ্বিতীয় খন্ড)
সুতরাং এর দ্বারা এটাই বুঝা গেল যে, কোন প্রকৃত মজযুব কখনোই শরীয়তের মোকাবেলা করবেনা। শরিয়তকে একবাক্যে-এক কথায় নতশিরে কুর্নিশ জানাবে। অথচ বর্তমানে স্বঘোষিত মজযুব’রা শরিয়তের কোন তোয়াক্কা-ই করে না। নিজেদেরকে মারেফাতী আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। এরা মনগড়াভাবে এ কথাও বলে বেড়ায় যে, তরিকতে প্রবেশ করলে শরিয়তের কোনই প্রয়োজন নাই।নাউজুবিল্লাহ। অথচ তারা কি দেখাতে পারবে যে, কোন প্রকৃত মজযুব অলী কখনো এরকম ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলে গিয়েছেন? ইনশা’আল্লাহ, কিয়ামত পর্যন্ত তারা এই কথা প্রমাণ করতে পারবে না। তাই আমি মনে করি এরা মজযুব বেশে মজযুব অলীর দুশমন। তাসাউফে বিশ্বাসী মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়েই তারা মূলত এই অপকর্মগুলো করে থাকে। শুধু তাই নয়, এদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বিভিন্ন পবিত্র মাজার শরীফ সমূহ। অথচ মাজারে আরামরত আল্লাহর অলী তাঁর জীবদ্দশাতে কখনোই এরকম উপদেশ দেননি এবং এই জীবনযাপনকে সমর্থনও করেননি।
এই অভাগারা পবিত্র মাজার সমূহে অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদেরকেও দিনকে দিন মাজার বিমুখী করে ফেলছে। আর এ সুযোগে নবী-অলী বিরোধী লোকেরা সাধারণ মানুষদেরকে এসব দেখিয়ে অলী বিদ্বেষী করে তোলার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা’র রহমত এবং ফুয়ুজাত প্রাপ্তির অন্যতম স্থান হচ্ছে এসকল পবিত্র মাজার সমূহ। তাই আমাদেরকে অবশ্যই এসব ভন্ডদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মাজার সমূহকে এদের হীন আগ্রাসন হতে রক্ষা করতে হবে। মানুষের অন্তরে তাসাউফের নামে এ সকল ভন্ডদের বিরুদ্ধে চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। আর যদি তা আমরা না করি, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আর আমাদের মত তাসাউফকে আকড়িয়ে ধরার সেই সৌভাগ্য কখনো হাসিল করবেনা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এবং সকল আউলিয়ায়ে কিরামের উসিলায় যাবতীয় কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত মতবাদ হতে সংরক্ষিত রাখুন। আমিন
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.