সাম্প্রতিক আপডেটঃ

নিছবত-এ-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা

আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান ইমাম হুসাইনী চিশতী

 

নবী মোর পরশমনি নবী মোর সোনার খনি

নবী নাম জপে যেজন সেই তো দু-জাহানের ধনী॥

এ কথাগুলোর মধ্যে নবী প্রেম, নবী প্রেমের মর্যাদা, নবীর সাথে ঈমানী, ক্বলবী, রূহানী ও ইরফানী সম্পর্কের এক গভীর তত্ত্বের দিক নির্দেশনা নিহিত রয়েছে। ছোহবত বা সঙ্গ একটি শব্দ, যাতে ভাল-মন্দ দু-ই রয়েছে। কবির ভাষায়-

ছোহবতে ছালেহ তোরা ছালেহ কুনদ,

ছোহবতে তালে তোরা তালে কুনদ।

মুসলমান জাতিকে এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, ঈমান, আমল যেভাবে আছে এভাবে কুফর এবং বদবাতেন এর মূলে আছে আক্বীদার বিভ্রাট ও বিভ্রান্তি। অর্থাৎ অত্যাচারীদের সঙ্গে বস না, কারণ ভাল-মন্দের সঙ্গের প্রভাব অন্য আমল থেকে অনেক বেশী। এর কারণ-

১) সঙ্গের প্রভাব রোযা, নামায, যাকাত ইত্যাদির চেয়ে বেশী। নামায আদায়ে, মানুষ নামাযী হবে। এভাবে জেহাদ থেকে গাযী, হজ্ব থেকে হাজ্বী, বিদ্যার উৎকর্ষের কারণে কাজী হতে পারে। কিন্তু এসবের কোন আমল দিয়ে ছাহাবী হতে পারবে না। ছাহাবী তিনিই হবেন, যিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মহৎ সান্নিধ্য লাভ করেছেন।

২) মদীনা পাক ও মক্কা মুকাররমার মাটি অন্য সব মাটি থেকে উত্তম। হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র রওজা শরীফের সেই অংশ যা পবিত্র শরীরের সাথে মিশে আছে আরশে আযীম থেকে উত্তম। কেন ? পবিত্র শরীরের ফয়েজ এর সাথে সম্পর্কের কারণে। হযরত জুন্নন মিছরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) হজ্বে যাচ্ছিলেন। পথে কাদেসিয়ার ময়দানের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় উট থেকে নেমে গেলেন। এই কাদেসিয়ার প্রান্তরে ছাহাবায়ে কিরাম ও ঈসায়ীদের মধ্যে বিখ্যাত কাদেসিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তিনি উট থেকে প্রান্তরের বালির স্তুপের মধ্যে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। সঙ্গীরা মনে করল যে, হয়তো অত্যধিক গরমের কারণে। সেজন্য পানি এনে হাতে মুখে ছিটাতে লাগলেন। তিনি বললেন- তোমরা এসব কি করছ? তোমরা যা মনে করেছ তা নয়। এখানে কিছুদিন আগে হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ছাহাবাগণের ঘোড়া দৌঁড়িয়েছেন। তাঁদের ঘোড়ার পায়ের চোটে যে নূর চমকেছিল তা আজও এ বালির স্তুপে চমকাচ্ছে। আমি বালির স্তুপের সেই নূরের আশায় লুটোপুটি খাচ্ছি; যাতে আল্লাহ পাক ঐ নূর আমার শরীরেও লাগিয়ে আমাকে ভাগ্যবান করেন।

৩) সম্পর্কের প্রভাবে মন্দও ভাল হয়ে যায় এবং ভাল মন্দ হয়ে যায়। দেখুন, হযরত নূহ্ আলাইহিস্ সালাম’র পুত্র নবীর ঔরসে জন্ম নিয়েও মন্দ লোকের সাথে সম্পর্কের কারণে কাফের হয়ে গেল। নূহ আলাইহিস্ সালাম ডাকলেও উত্তরে বললেন- ইন্নাহু লায়ছা মিন আহলিক, হে নূহ! সে আপনার আহলে বায়তই নয়। পক্ষান্তরে আছহাবে কাহাফের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে কুকুরটিও মর্যাদাবান হয়ে গেল। খেয়াল রাখা চাই যে, সম্পর্ক কয়েক প্রকার আছে-

(১) নিছবতে জিছমানী বা শারীরিক সম্পর্ক।

(২) নিছবতে রূহানী বা আত্মিক সম্পর্ক।

(৩) নিছবতে ঈমানী বা ঈমানী সম্পর্ক।

(৪) নিছবতে ইরফানী বা পরিচিতির সম্পর্ক।

(৫) নিছবতে কল্বী বা হৃদিক সম্পর্ক।

শারীরিক সম্পর্ককে শারীরিক কার্যাবলী যাতে শরীয়তের আদেশাবলী রয়েছে। যেমন- ছাহাবী তাকে বলা যাবে, যিনি ঈমানের সঙ্গে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দরবারে হুজুরের কাছে শরীর নিয়ে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। এভাবে তাবিঈ যিনি ছাহাবীর সঙ্গে শরীর নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। রূহানীভাবে এ নৈকট্যের উপর আদেশাবলী প্রযোজ্য হয়না। তাহলে সবাই ছাহাবী হওয়া বিধেয়। তবে ফয়েজ প্রত্যেক রকম নৈকট্য ও সঙ্গ থেকে লাভ করা যায়। দেখুন- হযরত লূত আলাইহিস্ সালাম এর স্ত্রী যদিও আযাবের রাত্রে হযরত লূত আলাইহিস্ সালাম’র সাথেই সদুম নামীয় বস্তি থেকে বের হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু যেহেতু অন্তর ঐ অত্যাচারী জাতির সাথে ছিল, সেজন্য রাস্তাতেই তাকে হত্যা করা হল। এ হল নিছবতে রূহানী ও কলবীর কুফল। হযরত  ওয়াইছ ক্বরনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও রূহ এবং দিল এর দিক থেকে হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র কদমে উপস্থিত ছিলেন। সেজন্য ক্বরনে বসেও মদীনা থেকে ফয়েজ পেয়েছেন, সুবহানাল্লাহ্! এ হল ঈমানী, রূহানী ও ইরফানী নিছবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সূর্য চতুর্থ আসমানে এবং দুর্গন্ধময় যমীন সূর্য থেকে সহস্র-কোটি মাইল দূরে। কিন্তু সূর্য যখন তার নূরানী দৃষ্টিতে যমীনের দিকে আলোকপাত করে তখন যমীনের সমুদয় বস্তুকে শুষ্ক করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে দেয়। আসমানের সূর্য এতদূর থেকে দুর্গন্ধময় মাটিকে পবিত্র করে দেয় আর মদীনার প্রকৃত অস্তবিহীন মহাসূর্য আমাদের মত অপবিত্রদেরকে ওখান থেকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দেন, তাহলে আশ্চর্যের কি আছে ? হ্যাঁ সম্পর্কটা (নিছবত) মদীনার শাহেনশাহ্ দোজাহানের মনিবের সঙ্গে অবশ্যই সঠিক থাকতে হবে। এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিজ্ঞ পাঠকদের  নিছবত সম্পর্কে হৃদয়ঙ্গম করতে আরও সহজ হবে।

শরহে কছিদা-এ বুরদাতে ইমাম খরপুতী বলেছেন- আবু জাহেল তার এক বন্ধু ইয়েমেনের হাবীব ইয়ামেনীকে খবর দিল যে, মক্কাতে এক নয়া ধর্ম এসেছে। যার পয়গম্বর সম্পর্কে লোকদেরকে আকৃষ্ট করে নিয়েছে। এ ধর্মের এ শক্তি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর গতিপথ রুদ্ধ করতে কেউ পারছে না। তুমি তাড়াতাড়ি আস এবং লোকদেরকে এই ধর্ম গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত রাখ। অন্যথায় আমাদের ধর্মের মঙ্গল হবেনা। মক্কাবাসীদের উপর তোমার অনেক দয়া আছে। লোকজন তোমার কথা মেনে চলবে। সে এ খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি মক্কা এসে পৌঁছল। আবু জাহেল তাকে অনেক খাতির যত্ন করল এবং এখানকার সমুদয় ঘটনা বিস্তারিত বলল। সে বলল যে, বন্ধু! দু‘ পক্ষের কথা শুনে মীমাংসা করা হয়। আমি তো তোমার কথা শুনলাম, কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ‘র কথা শুনাতো অত্যন্ত জরুরী। তাঁর সঙ্গেও কথা বলতে হবে। একথা শুনে আবু জাহেল একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। হাবীব ইয়েমনী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সংবাদ পাঠাল, আমি ইয়েমেন থেকে এসেছি, আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চাই। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে আসলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনতেই সভায় একটি গম্ভীরতা নেমে আসল। সব লোকজনই নীরব হয়ে গেল। কারো কথা বলার সাহস হল না। শেষ পর্যন্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্বয়ং নবীজী জিজ্ঞেস করলেন- হাবীব! আমাদেরকে তুমি কেন ডেকেছ ? সে অন্য কিছু বলতে পারল না। ঘাবড়িয়ে বলল, আমি শুনেছি যে, আপনি নবুয়তের দাবীদার। নবীদের জন্য অলৌকিক কার্যাবলী আবশ্যক। আপনার মু’জিযাত কি? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি যা চাও। সে বলল দু’টো জিনিস চাই। এক হলো এ মুহুর্তে চন্দ্র পূর্ণ আলো প্রদান করছে। এই চন্দ্রকে দু’টুকরো করে দিতে হবে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ছাফা পর্বতে চল। উপস্থিত সবাই ছাফা পর্বতে পৌঁছল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে ইশারা করলেন। সম্পূর্ণ চন্দ্র ফেটে গিয়ে দু’টুকরো হয়ে গেল। এক টুকরো পাহাড়ের এদিকে আরেক টুকরো পাহাড়ের ঐদিকে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আঙ্গুলীর নির্দেশে অতঃপর দু’টুকরোই একত্রিত হয়ে গেল। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার দ্বিতীয় কথাটি বল। সে বলল, হুজুর আপনিই বলুন, আমি দ্বিতীয় কথাটি কি বলতে চাই। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- শোন, তোমার একটি মেয়ে যার না হাত আছে, না পা আছে, না চোঁখ আছে, না কান আছে। সে তোমার উপর বোঝা স্বরূপ। তুমি চাও যে, সে আরোগ্য লাভ করুক। তাকে এখান থেকেই আরোগ্য করা হল। এটা শুনে হাবীব ইয়েমেনী অত্যন্ত অস্থির হয়ে গেল এবং কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে আওয়াজ দিল, হে আবু জাহেল শোন, হে উম্মিরা শোন, হে মক্কার প্রান্তর শোন, আমি আন্তরিকভাবে পড়ছি যে, “আশহাদু আন্‌লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ।” এখন থেকে আমি ইয়েমেনের জন্য ইসলামের প্রকৃত প্রচারক হলাম। এ কথা বলে সে অত্যন্ত খুশী হয়ে ঘরের দিকে রওয়ানা হল। যখন ঘরে পৌঁছল তখন রাত ছিল এবং দরজাতে আঘাত করতেই ঐ হস্ত-পদবিহীন মেয়ে দরজা খোলার জন্য আসল এবং পিতাকে দেখে পড়তে লাগল “আশহাদু আন্‌লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ্”  শুনে হাবীব বলল, তুমি এ কলেমা কোত্থেকে শিখলে? তুমি কিভাবে ভাল হয়ে গেলে? মেয়েটি বলল, অমুক রাতে আমি বিছানায় শুয়েছিলাম, চন্দ্রের মত চেহারা বিশিষ্ট একজন কালকেশরাশি বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বপ্নে আমার কাছে আসলেন এবং বললেন- “বেটি, তোমার পিতাকে আমি মক্কাতে কলেমা পড়িয়েছি। তুমি এখানে মুসলমান হয়ে যাও। আর পড় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলাল্লাহ”। এ কথা বলে আমি উঠলাম এবং আমি নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পেলাম এবং সেই কলেমা শরীফও পড়তে লাগলাম। এ হলো নিছবতে রূহানী ও ঈমানীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ নিছবত বা সম্বন্ধ সম্পর্কে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন-

  • সুতরাং হে মাহবুব! আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মুসলমান হবে না যতক্ষণ পরস্পরের ঝগড়ার ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক মানবে না। অতঃপর যা কিছু আপনি নির্দেশ করবেন, তাদের অন্তরসমূহে সে সম্পর্কে কোন দ্বিধা পাবেনা এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নিবে। (সূরা নিসা, আয়াত- ৬৫)
  • এবং নিঃসন্দেহে, আল্লাহ বনী ইসরাঈল এর নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে বারজন নেতা নিয়োগ করেছি এবং আল্লাহ এরশাদ করেন- “নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি।” অবশ্যই তোমরা যদি নামায কায়েম রাখ, যাকাত প্রদান কর, আমার রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখ, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে আমি অবশ্যই তোমার পাপ মোচন করব এবং তোমাদেরকে অবশ্যই বেহেশত সমূহে নিয়ে যাব, যেগুলোর পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। অতঃপর এ অঙ্গীকারের পর তোমাদের মধ্যে যে, ‘কুফর’ করেছে সে অবশ্যই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।  (সূরা মায়েদা,  আয়াত- ১২)
  • ও গলার শৃংখল যা তাদের উপর ছিল, নামিয়ে অপসারিত করবেন। সুতরাং ঐসব লোক যারা তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁকে সম্মান করেছে, তাকে সাহায্য করেছে এবং ঐ নূরের অনুসরণ করেছে, যা তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে তারাই সফলকাম হয়েছে। (সূরা আ’রাফ, আয়াত- ১৫৭)
  • হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আহ্বানে হাজির হও, যখন তোমাদেরকে সেই বস্তুর জন্য আহ্বান করেন, যা তোমাদের জীবন দান করবে এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহর নির্দেশ মানুষ ও তার মনের ইচ্ছাসমূহের মধ্যে অন্তরায় হয়ে যায় এবং একথাও যে, তোমাদেরকে তাঁর প্রতি উঠতে হবে। (সূরা আনফাল, আয়াত- ২৪)
  • রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তেমনই স্থির করোনা যেমন তোমরা একে অপরকে ডেকে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন, যারা তোমাদের মধ্যে চুপে চুপে বের হয়ে যায় কোন কিছুর আড়াল গ্রহণ করে। সুতরাং যেন ভয় করে তারা, যারা রাসূলের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে যে, কোন বিপর্যয় তাদেরকে পেয়ে বসবে, অথবা তাদের উপর বেদনাদায়ক শাস্তি আপতিত হবে।  (সূরা নূর, আয়াত- ৩৬)
  • হে ঈমানদারগণ ! নবীর গৃহসমূহে হাজির হয়োনা, যতক্ষণ পর্যন্ত অনুমতি না পাও। যেমন খাওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলে, না এভাবে যে, তোমাদেরকে (দীর্ঘসময় পর্যন্ত) তা রান্না হওয়ার জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে হয়; হ্যাঁ যখন আহুত হও তখন হাজির হও। আর যখন আহার করে নাও, তখন ছড়িয়ে পড়। এমন না যে, বসে কথা-বার্তার মধ্যে মশগুল হয়ে থাকবে নিশ্চয় তাতে নবীর কষ্ট হতো। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সঙ্কোচবোধ করতেন। আল্লাহ সত্য বলতে সঙ্কোচবোধ করেন না এবং যখন তোমরা তাদের নিকট থেকে কিছু ভোগ্য সামগ্রী চাও, তখন পর্দার বাইর থেকে চাও। এর মধ্যে অধিকতর পবিত্রতা রয়েছে তোমাদের হৃদয়সমহ ও তাদের অন্তরসমূহের। এবং তোমাদের জন্য শোভা পায়না যে, আল্লাহ রাসূলকে কষ্ট দেবে এবং না এও যে ,তারপরে কখনো তার বিবিগণকে বিবাহ করবে; নিশ্চয় এটা আল্লাহর নিকট বড় জঘন্য কথা। (সূরা আহযাব, আয়াত- ৫৩)
  •  যাতে হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আন এবং রাসূলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন কর আর সকাল সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর। (সূরা ফাত্হ, পারা ২৬, আয়াত ৯)
  • হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আগে বাড়বে না এবং আল্লাহ্কে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ জানেন এবং শুনেন। (সূরা হুজুরাত, পারা ২৬, আয়াত১)
  • হে ঈমানদারগণ! নিজেদের কন্ঠস্বরকে উঁচু করনা, ঐ অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী) এর কন্ঠস্বরের উপর এবং তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বলোনা যেভাবে পরস্পরের মধ্যে একে অপরের সামনে চিৎকার কর যেন কখনো তোমাদের কর্মসমহ নিষ্ফল না হয়ে যায় আর তোমাদের খবরই থাকবে না। (সূরা হুজুরাত, পারা ২৬, আয়াত ২)

উপরোক্ত আয়াতগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি আদব বজায় রাখা ঈমানের মূল ভিত্তি।

  • এ নবী, মুসলমানদের, তাদের প্রাণের চেয়েও অধিক মালিক এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা। আর নিকটাত্মীয়গণ আল্লাহর কিতাবের (বিধানের) মধ্যে একে অপরের চাইতেও নিকটতর অন্যান্য মুসলমান ও মুহাজিরদের তুলনায়, কিন্তু এই যে, তোমরা আপনবন্ধু বান্ধবের উপকার করো। এটা কিতাবের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে। – (সূরা আহযাব, পারা ২১, আয়াত ৬)
  • এবং না কোন মুসলমান পুরুষ না কোন মুসলমান নারীর জন্য শোভা পায় যে, যখন আল্লাহ ও রাসূল কোন নির্দেশ দেন তখন তাদের স্বীয় ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকবে। এবং যে কেউ নির্দেশ অমান্য করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের, সে নিশ্চয় সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে। -(সূরা আহযাব, পারা ২২, আয়াত ৩৬)
  • এবং আমি কোন রসূল প্রেরণ করিনি কিন্তু এজন্য যে, আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হবে এবং যদি তখনও তারা নিজেদের আত্মার প্রতি জুলুম করে তখন, হে মাহবুব! (তারা) আপনার দরবারে হাজির হয় এবং অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আর রাসূল তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই আল্লাহকে অত্যন্ত তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু পাবে। -(সূরা নিসা)

উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমরা সবাই হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গোলাম। যারা অসুস্থ তাদের উচিত আরোগ্য লাভের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া এবং ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা। উপরোক্ত আয়াতে গুনাহর রোগে আক্রান্তদেরকে দু’জাহানের ডাক্তার হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ডাক্তার খানায় পাঠানো হয়েছে। এই ডাক্তারখানার অবস্থা এমন যে, এখানে রোগী এলে কেউ ছিদ্দীকে আকবর, কেউ ফারুকে আ’যম, কেউ উসমান যিন্নুরাঈন, কেউ আসাদুল্লাহ্ হয়ে যান। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিরই উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। কোন গুনাহ্ করলে এখানে হাজিরা দিতে হবে। এটা এমন আরোগ্য নিকেতন নয় যেখানে শুধুমাত্র চোঁখ, কান অথবা হাত ও পা’র চিকিৎসা করা হয়। এটা ঐ আরোগ্য নিকেতন যেখানে দিল-হৃদয়, হাত, পা, নাক ও কান প্রভৃতির চিকিৎসা করা হয়। এটা এক প্রবাহিত সমুদ্র, যেখানে যত ময়লা আবর্জনাই আসুক না কেন, পবিত্র হয়ে যায়।

ইহকাল পরকালের সেই চিকিৎসকের নাম আক্বায়ে নামদার দো’জাহানের মালিক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা সবাই যেহেতু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র গোলাম সেহেতু গোলামের সাথে মনিবের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, এ বিষয়ে একটি সুন্দর ঘটনা তাফসীরে রূহুল বয়ানে বর্ণনা করা হয়েছে। ঘটনাটি হল-

একদিন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিখ্যাত ছাহাবী হযরত মায়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন- হে মায়াজ! আমি তোমাকে একটি কথা বলছি, যদি কথাটি স্মরণ রাখ তাহলে তোমার খুব উপকারে আসবে। যদি তুমি একথা ভুলে যাও তবে মনে রেখ যে, ‘তোমার দাবী আল্লাহর কাছে অগ্রাহ্য হয়ে গেল।’ হে মায়াজ! আল্লাহ তায়ালা যমীন ও আসমান সৃষ্টি করার পূর্বে সাতজন ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন। তাদেরকে প্রত্যেক আসমানে পৃথক পৃথকভাবে দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। অতঃপর যখন সৎকর্মশীল কোন ব্যক্তির সৎকর্ম যা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হয়- প্রথম আসমানে পৌঁছার পর ঐ আমল আরও পরিষ্কার এবং এর উজ্জ্বল আভা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। অতঃপর যখন একে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয় তখন ওখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত  ফেরেশতা বলেন- থাম। এই আমল ঐ ব্যক্তির মুখের উপর ছুঁড়ে মার। কেননা, ঐ ব্যক্তি পরনিন্দাকারী। আমার উপর আদেশ আছে যে, ঐ বান্দার অভ্যাস ছিল পরচর্চা করার, সেজন্য তার আমল উপরে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ এবং এই কারণে তার আমল যমীনে ফেরত পাঠিয়ে দাও।

অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ঐ বান্দার অন্য আমল, অন্য সৎকর্ম সংরক্ষণকারী ফেরেশতারা নিয়ে আসে এবং ঐসব আমলকেই উপরে দ্বিতীয় আসমানের দিকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতিপ্রাপ্ত হয় কিন্তু দ্বিতীয় আসমান পর্যন্ত পৌঁছতেই ঐ আসমানের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা এসে বলেন- ঐ ব্যক্তির আমল ঐ ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দাও কেননা ঐ ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক এবং আমার উপর আদেশ আছে যে, ঐ আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তির আমল উপরে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। কেননা, ঐ ব্যক্তির আমল দুনিয়াতে সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অতঃপর ঐ ব্যক্তির অন্য আমল উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় যা রোযা, দান এবং নামাযের কারণে আলোকিত হয় যা সংরক্ষণকারী ফেরেশতা দেখে খুবই খুশী হয় কিন্তু যখন তৃতীয় আসমানে পৌঁছে তখন সংরক্ষণকারী ফেরেশতা বলে থাম। ঐ ব্যক্তির আমল উপরের দিকেক নিয়ে যাওয়া যেতে পারে না। কেননা, ঐ ব্যক্তি দাম্ভিক। যেখানে বসে সেখানেই দম্ভ প্রকাশ করে। আমার উপর আদেশ- ঐ ব্যক্তির আমল উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ সেজন্য ঐ ব্যক্তির আমল তার মুখের উপর ছুঁড়ে মার।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- অতঃপর তার অন্য আমল উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ ব্যক্তির নামায, তাসবীহ, হজ্ব, ওমরা, নক্ষত্রের মত আলোকিত হয় যখন তা চতুর্থ আসমানে পৌঁছে তখন ওখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা বলে- থাম। ঐ ব্যক্তির আমল তার মুখের উপর ছুঁড়ে মার। কেননা, ঐ ব্যক্তি আত্মসন্তুষ্টিতে আক্রান্ত। আমার উপর আদেশ আছে ঐ ধরণের লোকের আমল উপরের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- যখন ঐ ব্যক্তির আমল পঞ্চম আসমানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মনে হয় ঐ আমল যেন নববধু নতুন বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানেও নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন- থাম। তার আমল তার মুখের উপর ছুঁড়ে মার। কেননা ঐ ব্যক্তি হিংসার রোগে আক্রান্ত। আমার উপর আদেশ এই ধরণের ব্যক্তির আমল উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে না।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ফেরেশতাগণ রোযা, নামায, হজ্ব, ওমরাগুলি ষষ্ঠ আসমানে নিয়ে যায়। যথানিয়মে সেখানকার নিয়োজিত ফেরেশতা বলেন- থাম। তার আমল তার মুখের উপর ছুঁড়ে মার। এই ব্যক্তি কারও প্রতি দয়া করে না। বরং কাহারও দুঃখের সময় তাকে গালিগালাজ করে। আমার উপর আদেশ আছে যে, যে ব্যক্তি কারও প্রতি দয়া প্রদর্শন করেনা। তার আমল উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- বান্দার আমল যখন সপ্তম আসমানের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, যা রোযা, নামায, ফিক্বহ্, গবেষণা ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এর আওয়াজ মধুর মত মিষ্ট এবং তার আলো সূর্যরশ্মির মত হয়, তার সাথে তিন হাজার ফেরেশতা চলে। তখনকার নিযুক্ত ফেরেশতা বলেন- থাম। তার আমল তার মুখের দিকে ছুঁড়ে মার। কেননা, এ ব্যক্তি এ আমলের দ্বারা জ্ঞানী গুণী বলে পরিচিত হতে চেয়েছিল, আলিমদের মধ্যে মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। শহরে, বন্দরে মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল, এই জন্য সে আল্লাহর দর্শন থেকে বঞ্চিত। তার অন্তরে দাগ লেগে আছে। একে আর যেতে দেয়া যায় না। কেননা আমার উপর নির্দেশ আছে লোক দেখানো আমলকারীকে খোদার দরবারে আসতে দেয়া যাবে না।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- বান্দার আমলসমূহ সপ্তম আসমান অতিক্রম করে হেজাবগুলি অতিক্রম করে যখন আল্লাহর দরবারে পৌঁছে এবং ফেরেশতারা বলে ইলাহী এই আমল শুধুমাত্র তোমার জন্য পরিশুদ্ধভাবে তোমার সামনে পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- ফেরেশতাগণ, তোমরা এর বাইরের দিকটা দেখেছ। এর ভিতরের দিকটা আমার কাছে গোচরীভূত। এই আমল শুধুমাত্র আমার জন্য করা হয়নি। বরং এ আমল অন্য উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সে জন্য এর উপর আমার অভিশাপ। ফেরেশতারা বলেন, আপনার অভিশাপ হলে আমাদেরও সবার অভিশাপ এবং এর মধ্যে যারা আছে সবার অভিশাপ।

মায়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আরজ করলেনঃ হুজুর, এখন তাহলে আমাদের উদ্ধার পাওয়া কঠিন। কেননা না পরিশুদ্ধভাবে আমল করি, না সুন্দরভাবে।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- হে মায়াজ! আমার অনুসরণকে পরিহার করবে না। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে। আমলে ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। নিজের জবানকে নিজের ভাইয়ের সম্বন্ধে পরনিন্দা থেকে বিরত রাখবে। নিজেকে উত্তম জানিও না। দুনিয়ার আমলকে পরকালের মধ্যে প্রবেশ করাইও না এবং লোকদের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি করবে না। যাতে তোমাকে দোযখের কুকুরে ধ্বংস না করে এবং নিজের আমলকে লোক দেখানো আমল থেকে বিরত রাখবে। -(তাফসীরে রূহুল বয়ান, ১ম খন্ড, ১ম পারা, পৃষ্ঠাঃ ১৮৪ – ১৮৭)

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়,  বর্তমান যুগে আক্বীদা বিশ্বাসের চরম বিপর্যয় ঘটে চলেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে সম্পর্ক না রেখে আমরা সবাই এবাদত বন্দেগী করে গেলে এবং পরিণাম কিরূপ দাঁড়ায় এর একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এসব বিভ্রান্তির মূল উৎস কখন কিভাবে সৃষ্টি হয় তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম কি হয়েছে তা বিস্তারিত একটি হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে তাফসীরে রূহুল বয়ানে। তা হলঃ

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন- মদীনাতে এক বড় স্তরের আবেদ(ইবাদতকারী) এবং যাহেদ নওজোয়ান ছিল। আমরা একদিন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সামনে তার কথা স্মরণ করলাম। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনলেন না। অতঃপর আমরা তার অবস্থা ও গুণাবলী বর্ণনা করলাম। তখনও হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)তাকে চিনলেন না। একদিন হঠাৎ ঐ ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সামনে এসে পড়ল। তার উপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দৃষ্টিপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হুজুরকে জানালাম যে, এই সে যুবক! হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে দৃষ্টিপাত করে এরশাদ করলেন “আমি তার চেহারার মধ্যে শয়তানের প্রতিকৃতি দেখছি। অতঃপর ঐ যুবক হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে আসলো এবং সালাম করল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে সম্বোধন করে বললেন, একথা কি সত্য নয় যে, তুমি এই মুহুর্তে মনে মনে চিন্তা করছিলে যে, তোমার থেকে উত্তম এখানে আর কেও নেই। সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ। অতঃপর সে যখন মসজিদের ভিতর গিয়ে ঢুকল, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাকলেন- কে আছো, তাকে হত্যা করতে পারবে?  শুধুমাত্র হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উত্তরে বললেন- ‘আমি’। যখন তিনি এ উদ্দেশ্যে মসজিদের ভেতর ঢুকলেন তখন তাকে নামায পড়তে দেখলেন। এ অবস্থায় দেখে তিনি ফিরে এলেন এবং মনে মনে চিন্তা করলেন যে, একজন নামাযীকে কিভাবে হত্যা করব। যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযীকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওয়াজ দিলেন- কে আছ তাকে হত্যা করতে পারবে? তখন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উত্তরে বললেন- ‘আমি’। তিনি যখন মসজিদের ভেতর ঢুকলেন তখন ঐ যুবক সেজদারত অবস্থায় ছিল। তিনিও নামাযরত অবস্থায় দেখে হযরত আবু বকর ছিদ্দীকের মত ফিরে আসলেন। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওয়াজ দিলেন- কে আছ? যে তাকে হত্যা করতে পারবে। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন- ‘আমি’। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- তুমি তাকে অবশ্যই হত্যা করবে যদি তুমি তাকে পাও। কিন্তু যখন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদের ভিতর ঢুকলেন তখন দেখলেন ইতিমধ্যেই সে পলায়ন করেছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- “যদি তুমি তাকে হত্যা করতে, তাহলে আমার উম্মতের সমস্ত ফেত্‌নাকারীদের মধ্যে ঐ যুবকই প্রথম ও শেষ ব্যক্তি প্রমাণিত হত এবং আমার উম্মতের মধ্যে দুই ব্যক্তি একে অন্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতো না।”

এ প্রসেঙ্গ আল্লামা ইসমাঈল হক্কী বলেন- এই ঘটনায় চিন্তা করে দেখুন যে, উল্লিখিত ব্যক্তি শরীয়তের নিয়ম-কানুন পালনে কত বড় অনুসারী ছিল। কিন্তু হুজুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দয়ার দৃষ্টিতে এবং তাঁর মুহাব্বত ও ভালবাসা থেকে একেবারে শুন্য ছিল। এজন্য হুজুর নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বারবার অবহিত করা সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারা অস্বীকার করলেন। যদিও বাতিনী দৃষ্টিতে তিনি তার সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবহিত ছিলেন।

অতঃপর ঐ যুবক যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে হাজির হল, তিনি বললেন এই যুবকের চেহারায় আমি শয়তানের প্রতিকৃতি লক্ষ্য করছি এবং তার দিকে লক্ষ্য করে তার অভ্যন্তরীন রোগসমূহের খবর দিলেন এবং তার সঙ্গে যে কথাগুলি বললেন তা হলো যে, তুমি কি মনে মনে এই ভাবছ যে, তোমার থেকে উত্তমগুণী কেউ নেই? ঐ যুবকের মুখ থেকে বের হল- হ্যাঁ এই চিন্তাই ছিল।

চিন্তা করুন, আমাদের নবীর জ্ঞান কতদূর ছিল যে প্রতিটি বান্দার মানসিক অবস্থা জানা ছিল বরং প্রত্যেকের আভ্যন্তরীন অবস্থাসমূহ ভালভাবেই জানতেন।

আবার চিন্তা করে দেখুন, ঐ ব্যক্তি এত বড় আলেম এবং পরহেজগার হওয়া সত্ত্বেও রহমাতুল্লিল আলামীন(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র উম্মতের দুঃখে সারারাত ক্রন্দনকারী  দয়ালু, মায়াবান, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)তাকে হত্যা করার আদেশ দিলেন এবং শুধু একবার নয় বারবার জলীলুল ক্বদর সাহাবা এবং খোলাফায়ে রাশিদীন এর মত ব্যক্তিত্বদের। অতঃপর যখন তাকে হত্যা করা হল না তখন দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, যদি তাকে হত্যা করা হত তাহলে আল্লাহর পথের ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী এই যুবকই প্রথম ও শেষ হত্যা হত এবং কেয়ামত পর্যন্ত ধর্মীয় ঝগড়া এবং মতের বিভিন্নতা সমূহও দুনিয়া থেকে উঠে যেত।

প্রমাণিত হল যে, এ ধরণের ঝগড়া-ফ্যাসাদসমূহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শত্রুদের বংশ থেকে হয়ে আসছে। – (তাফসীরে রূহুল বয়ান, পারা ১৬, পৃষ্ঠা ৬-৭)

উপসংহার

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম বেহেশত থেকে পৃথিবীতে আসার পর একদল হরিণ তাঁকে দেখার জন্য আসল। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এর ফলে ঐ সব হরিণের পেটে মৃগনাভী তৈরী হয়ে গেল। তারা চলে যাওয়ার পর এ সংবাদ পেয়ে অন্যান্য হরিণেরা বলাবলি শুরু করল, চল আমরাও যাই হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম’র সাথে দেখা করি তাহলে আমদের পেটেও মৃগনাভী তৈরী হবে।তারপর তারা সবাই আদম আলাইহিস্ সালাম এর সাথে দেখা করল, তাদের মাথায়ও হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম হাত বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু তাদের পেটে মৃগনাভী প্রস্তুত হলনা। বিষয়টি সবার জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর হরিণেরা সবাই হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম’র কাছে এসে প্রশ্ন করল, আপনি কারও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার পর তাদের পেটে মৃগনাভী তৈরী হল আবার কারও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার পরও পেটে মৃগ তৈরী হলনা; এর কারণ কি? উত্তরে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম বললেনঃ যারা প্রথমে এসেছিল তারা আমার প্রকৃত মুহব্বতে আমাকে দেখতে এসেছিল। আর পরে যারা এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল পেটে মৃগনাভী লাভ করা। মুহব্বতের কারণে তারা আমাকে দেখতে আসেনি। সেজন্য তাদের পেটে মৃগনাভী তৈরী হয়নি। -(তাফসীরে রূহুল বয়ান, পারা ৯, পৃষ্ঠা ১০৯)

আসুন, আমরা সবাই খাঁটি নবীপ্রেমকে অবলম্বন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে প্রকৃত ‘নিছবতে রাসূল’কায়েম করার তরীকায় নিজেদেরকে আবদ্ধ করি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাওফীক দান করুন; আমীন, বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন।

Check Also

হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর স্ত্রীগণ সমগ্র জাহানের স্ত্রীলোকদের চেয়ে উত্তম।

*হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বিবিগণের ভিন্ন ভিন্ন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *