মাওলানা মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান হাবিবী
কুরবানী শব্দটার মূল হচ্ছে ‘কুরবানুন’, যার আভিধানিক অর্থ নৈকট্য লাভ করা, কাছাকাছি যাওয়া ইত্যাদি। আর কুরবানী শব্দের অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ ও বিসর্জন ইত্যাদি। পরিভাষায় কুরবানী বলা হয়- কোন জন্তু জবেহ করার মাধ্যমে কিংবা কোন কিছু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ বা সদকা করার মাধ্যমে অথবা নিজের প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য হাসেল করা। আর ইসলামী ফিক্হ শাস্ত্রের পরিভাষায় এটাকে ‘উদ্বহিয়্যা’ বলা হয়। কিন্তু সাধারণের মধ্যে কুরবানী শব্দটি জন্তু জবেহের জন্যই ব্যবহৃত হয়। এক কথায়- ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের নামই হলো কুরবান। এ শব্দটি কুরআনুল করীমে পরিলক্ষিত হয় যেমন- ওয়াতলু আলাইহিম নাবা আবনাই আদামা বিল হাক্কি ইজ কাররাবা কুরবানা, অর্থাৎ হে প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনিয়ে দিন, যখন তারা কিছু উৎসর্গ করে ছিল। [সূরা আল মায়িদা: ২৭]
কুরবানীর দিনকে ইয়াওমুল আদ্বহা তথা ঈদুল আদ্বহার দিন বলা হয়।
কুরবানীর ইতিহাস
মুসলিম মিল্লাতের জন্য কুরবান মূলত একটি বড় ধরনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুসলমানরা প্রতি বৎসর জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের যে কোন এক দিন সূর্যাস্তের পূর্বে আল্লাহ তা’আলার নামে গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বাসহ বিভিন্ন প্রকার হালাল পশু দ্বারা কুরবানী দিয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে ধনী-গরীব প্রত্যেকের জন্য যার যার সামর্থ অনুযায়ী ইবাদতের সুন্দরতম ব্যবস্থাপনা রয়েছে। মহামহিম আল্লাহ আমাদেরকে এমন একটি ধর্ম উপহার দিয়েছেন, যাতে ধনী-গরীব সবার জন্য সমানভাবে ফরয কালেমা, নামায ও রোযাকে, তবে শুধুমাত্র যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা হজ্ব, যাকাতের ছাহেবে নিসাব করে দিয়েছেন তাদের উপর হজ্ব ও যাকাত আদায় করা ফরয করে দিয়েছেন। উপরোক্ত ইবাদতসমূহ দুই প্রকার, এক. ইবাদতে বদনী অর্থাৎ শরীরের মাধ্যমে ইবাদত আর দুই. ইবাদতে মালী অর্থাৎ অর্থের মাধ্যমে ইবাদত। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হল হজ্ব আর এটা ইবাদতে মালী। এ হজ্বের মাসেই দশ, এগার ও বার তারিখে প্রতি বৎসর নির্দিষ্ট পশু দ্বারা নির্দিষ্ট সময়েই বিশ্ব মুসলিম কুরবানী করে থাকে। আর এই হল মুসলমানদের জন্য একটি মালী ইবাদত।
কুরবানের প্রথম উৎস আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের দু’সন্তান হাবিল আর কাবিলের কুরবানী থেকে। কুরআন মজিদের সূরা মায়িদা শরীফের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কুরবানী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন; যার অনুবাদ আমি এ নিবন্ধের প্রথমে উল্লেখ করেছি।
আমরা সবাইতো আদম সন্তান। তবে আলোচ্য আয়াতে পাকে নির্দিষ্ট করে দু’জন সন্তানের ঘটনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আর এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হওয়ার দাবিদার। কেননা আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতে বিল হাক্কে শব্দ ব্যবহার করেছেন। কারণ অতীতকালের কাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেকে অতিরঞ্জিত করেছে। তাই হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে সকলকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আদম আলাইহিস সালামের দু’সন্তান কারা? তাদের পরিচয় মুফাস্সেরীনে কেরাম তাঁদের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। তাদের একজনের নাম হাবিল আর অপর জনের নাম কাবিল। তারা আল্লাহ তা’আলার দরবারে কী কুরবানী করেছিল? এবং কীভাবে করেছিল? হাদিসে পাকের মধ্যে এর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এ বিশ্ব জগতের প্রথম মানব হচ্ছেন মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম। তাঁর বাম পাজরের হাঁড় থেকে হযরত মা হাওয়া আলাইহাস সালামকে সৃষ্টি করা হয়। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁদের মাধ্যমেই এ পৃথিবীতে মানব জাতির বিস্তার ঘটান। এ বিষয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ওয়া খালাকা মিনহা জাওযাহা ওয়া বাস্সা মিনহুমা রিজালান কাসীরাঁও ওয়া নিসাআ। অর্থাৎ এবং তিনি (আল্লাহ তা’আলা) আদম থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর স্ত্রীকে এবং উভয়জন থেকে ছড়িয়ে দিলেন সমগ্র জগতে অনেক নারী-পুরুষ। [সূরা নিসা: ০১]
তখন আদম-হাওয়া আলাইহিমাস সালাম ছাড়া আর কোন মানব ছিলনা। তাই দ্রুত বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে আদম-হাওয়ার ঔরষে একই সাথে দুইজন সন্তান জন্ম লাভ করত। তাদের একজন মেয়ে অপরজন ছেলে। তখনকার সময় আদম আলাইহিস সালামের শরীয়তে নিয়ম ছিল, একজোড়ার ছেলের সাথে অপর জোড়ার মেয়ের বিয়ে হতো। একই গর্ভের দু’জনকে শুধু ভাই-বোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে নিষিদ্ধ তথা হারাম ছিল। এই নিয়ম অনুযায়ী দেখা গেল কাবিলের সাথে যে মেয়েটি জন্ম নিল সে ছিল অত্যন্ত সুন্দরী, সুশ্রী। আর হাবিলের সাথে যে মেয়েটি জন্ম নিল সে তেমন সুন্দরী ছিল না। এখন প্রথা অনুযায়ী কাবিলকে বিয়ে করতে হবে হাবিলের জোড়ার অসুন্দরী মেয়েকে। কিন্তু কাবিলের মনে শয়তানী বুদ্ধি বাসা বাঁধলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, হাবিলের সাথে জন্ম নেওয়া মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে না। যেই কথা সেই কাজ। কাবিল বাবা আদম আলাইহিস সালামের কাছে এই প্রস্তাব পেশ করলো। বাবা আদম বললেন, এটা তো হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলার বিধান মুতাবেক তোমাকে হাবিলের জোড়ায় জন্ম নেওয়া মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু কাবিল তা মানতে রাজি হল না। তখন আদম আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে তোমাদের উভয়কে আল্লাহর দরবারে তোমাদের প্রিয় বস্তু কুরবানী দিতে হবে। যার কুরবানী আল্লাহ তা’আলার দরবারে কবুল হবে সেই ঐ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। বাবা আদমের এই নির্দেশ পেয়ে তারা উভয়ে আল্লাহর দরবারে কুরবানী দিতে প্রস্তুত হলো। হাবিল পশু পালন করতো। সে তার পশুর মধ্য থেকে সবচেয়ে সুন্দর ও মোটা তাজা একটি ভেড়া বাছাই করলো। আর কাবিল করতো কৃষি কাজ। সে তার ফসলের কিছু অংশ হতে কুরবানী করার প্রস্তুতি নিল। সে সময়ে প্রথা ছিল যে, কুরবানীর বস্তু উন্মুক্ত মাঠে বা পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসা হতো। আর আসমান হতে এক টুকরো আগুন এসে আল্লাহর দরবারে কবুলযোগ্য বস্তুটিকে জ্বালিয়ে দিত। কবুল না হওয়া বস্তু জমিনে পড়ে থাকতো। হাবিল-কাবিল নিয়ম অনুযায়ী তা-ই করলো। আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে হাবিলের কুরবানী কবুল হলো। পক্ষান্তরে কাবিলের কুরবানী কবুল হয়নি। এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন- তাদের উভয়ের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো, অপর জনের কুরবানী কবুল করা হলো না। [সূরা মায়িদাঃ ২৭]
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিকটস্থ কোন একটি স্থানে হাবিল-কাবিল তাদের কুরবানী দিয়েছিলেন। সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালাম যে মাপকাঠি ও পরীক্ষা নির্ধারণ করেছিলেন সে মোতাবেক কাবিল সে-ই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারল না। এতে কাবিল খুবই রাগান্বিত হল এবং হাবিলকে বললো, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করবো। কুরআনের ভাষায়- ক্বালা লাআকতুলান্নাকা, অর্থাৎ সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করবো। [সূরা হজ্ব: ৩৭]
কাবিল ছিল বেশি শক্তিশালী ও সামর্থবান। সে কাউকে পরওয়া করতো না। পক্ষান্তরে হাবিল ছিল একটু দুর্বল ও শান্ত। কিন্তু আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কারো শক্তি ও দাপট দেখে কুরবানী কবুল করেন না। আল্লাহ তা’আলা দেখেন বান্দার অন্তরের তাকওয়া পরহেযগারী। সে বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন- ইন্নামা ইয়াতাক্বাব্বালুল্লাহু মিনাল মুত্তাকিন। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাক্বী, পরহেযগারদের থেকে কবুল করেন। [সূরা মায়িদা: ২৮]
হাবিলের অন্তরে ছিল তাকওয়া-পরহেযগারী। তাই সে ছিল নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী। কাবিলের মত সে দাপট দেখায়নি। কাবিল বলল, আমি তোমার জন্য সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারছিনা। আর তোমার জন্য আমার কুরবানীও কবুল হল না। তাই তোমাকে হত্যা করে আমার মনের জ্বালা মিটাবো। তার কথার জবাবে হাবিল বলল, (কুরআনের ভাষায়) ‘যদি তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য তোমার হাতকে আমার দিকে প্রসারিত কর, তোমাকে হত্যা করার জন্য আমার হাত তোমার দিকে প্রসারিত করবো না’। [সূরা মায়িদা: ২৮] অর্থাৎ তুমি আমাকে হত্যা করলেও আমি তোমাকে হত্যা করবো না। কারণ ইন্নি আখাফুল্লাহা রাব্বাল আলামীন। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করি। [সূরা মায়িদা: ২৮]
আল্লাহ ওয়ালা মানুষের আচরণ এমনই হয়। আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তাকে সম্মান দিয়ে থাকেন। কারণ, আল্লাহ বলেন, আমার নিকট সেই বান্দাই সবচেয়ে সম্মানী যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মুত্তাকি। তাই কারো সম্মান ক্ষুন্ন করাকে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। আর এ জন্যই হাবিল একটি চির সম্মানিত নাম। হাবিল মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত। যার স্বীকৃতি স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কালামে মজীদে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ থেকে কবুল করেন। [সূরা মায়িদা: ২৭]
কাবিল যদি খোদাভীরু হত তাহলে তার কুরবানীও কবুল হতো। কুরবানী কবুল না হওয়ার জন্য মূলতঃ সে নিজেই দায়ী। পরিশেষে কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে নিজের ক্ষতি সাধন করলো। আল্লাহ এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ করেন- ফাতাও ওয়াআত লাহু নাকছুহু কাতলা আখিহে ফাকাতালাহু ফাআসবাহা মিনাল খাছেরীন। অর্থাৎ অতঃপর কাবিলের অন্তর তাকে স্বীয় ভাই হত্যার জন্য সম্মত করল, আর কাবিল তাকে হত্যা করল। অতএব এতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
[সূরা মায়িদা: ৩০]
উক্ত আয়াতে করীমায় ক্ষতিগ্রস্ত মানে কাবিল ইহকালে তার সম্মানিত পিতার অসন্তুষ্টি অর্জন করলো, সহোদর ভাইকে হারালো এবং কিয়ামত পর্যন্ত অসম্মানের পাত্রে পরিণত হলো। আর পরকালে ক্ষতি হচ্ছে আল্লাহর আদেশ অমান্য, সীমালংঘন, হত্যা ও সম্পর্কচ্ছেদ করার কারণে জাহান্নামের খোরাকে পরিণত হলো।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেউ হত্যা করলে তার পাপের একটি অংশ আদম আলাইহিস সালামের প্রথম সন্তানের (কাবিল) ভাগ্যে জুটবে। কারণ, সে-ই প্রথম হত্যার দরজাটি উন্মুক্ত করেছিল। [কাসাসুল আম্বিয়া]
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানী
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইসমাঈল আলাইহিস সালামের তের অথবা চৌদ্দ বছর বয়সে তার পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে কুরবানীর বিষয়ে ইংগিত দিয়ে ইরশাদ করেন- অতঃপর যখন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম পিতার কার্যক্রমে সহায়তা করার মত বয়সে উপনীত হলো, তখন একদিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবেহ করছি এতে তোমার মতামত কি? পুত্র বললেন, হে আমার সম্মানিত পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন; তা শীঘ্রই বাস্তবায়ন করুন। ইনশা আল্লাহ! আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। [সূরা সাফফাত: ১০২]
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর বিষয়ে হাদিস শরীফের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।
একদিন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে দেখেন, তাঁকে বলা হলো; ইব্রাহীম তুমি কুরবানী কর। সকালে উঠে তিনি আনন্দচিত্তে একশত উট কুরবানী করলেন। কেননা নবীগণের স্বপ্নও অহী। কিন্তু পরবর্তী রাত্রেও তিনি একই নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন। আবার সকালে উঠে তিনি একশত উট কুরবানী দিলেন। তৃতীয় রাত্রে আল্লাহ তা’আলা আবার স্বপ্ন দেখালেন, বললেন, হে ইব্রাহীম! তুমি কুরবানী দাও। তিনি আরয করলেন, মাবুদ আমি কি কুরবানী করবো? ইরশাদ হলো, তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুটি আমার রাস্তায় উৎসর্গ কর।
অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, কোন ঘোষক ঘোষণা করছেন। হে ইব্রাহীম! আল্লাহর নামে কুরবানী দাও। কোন কোন রেওয়ায়েতে তার সন্তান হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের নামও উল্লেখ রয়েছে। সেই যাই হোক, প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারার সাথে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এ স্বপ্ন ছিল জ্বিলহজ্ব মাসের আট তারিখের। সে দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি দোদুল্যমান অবস্থায় ছিলেন। আবার কোন সময় মনে উদিত হয়, এটা কি কোন শয়তানী চক্রান্ত? না আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য স্বপ্ন? যা মান্য করা আমার জন্য অত্যাবশ্যক। সারাদিন সন্দেহের মধ্যেই অতিবাহিত হয়ে যায়। এ জন্য মুসলমানদের নিকট এ দিনটি সন্দেহের দিন হিসেবে পরিচিত। উপরোল্লিখিত ঘটনার দ্বারা বুঝা যায়, কুরবানী সাধারণভাবে করার কথা ছিল। তাইতো হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সে দিন সকালে একশত উট কুরবানী করেন। নয় তারিখের রাতে পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। অতঃপর তার পূর্বদিনের দুর্ভাবনা ও পেরেশানী সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যায়। আর এ স্বপ্নে তাঁকে আরো জানিয়ে দেয়া হল যে, আল্লাহ তা’আলার অহীকে শয়তানী প্ররোচনা মনে করা খোদাভীরুদের শানের বিপরীত। এ জন্য এ দিনটিকে পরিচিতির দিন বলে সারাদিন তিনি আল্লাহর এই হুকুম পালনের গুরুত্বের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন এবং আরো একশত উট কুরবানী করেন। জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখের রাত্রের তৃতীয় বারেও একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আগামী দিনই হচ্ছে কুরবানীর দিন। কিন্তু স্বপ্নের ইশারা-ইংগিতে নির্দিষ্ট কোন বস্তুর প্রতি বুঝানো হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাই স্বপ্নে আরয করেন, আমি কী কুরবানী করবো? ইশারায় জানিয়ে দেওয়া হয়, তোমার নিকট সবচাইতে যা প্রিয়, তা-ই কুরবানী কর। আর হযরত ইব্রাহমি আলাইহিস সালামের নিকট তাঁর সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালামই ছিলেন সর্বাপেক্ষা মহব্বতের। এ জন্যই আহলে কিতাবদের বর্ণনায় জবেহর জন্য নিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে (অহিদুন) একমাত্র প্রিয় ছেলে বলা হয়েছে। কেননা ইসমাঈল আলাইহিস সালামই সর্বপ্রথম জন্মগ্রহণ করেন। যখন ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বয়স ৮৬ বছর তখন হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর জন্ম হয়। আর তাঁর ৯৯ বৎসর দ্বিতীয় ছেলে হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন।
সুতরাং এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বৃদ্ধ বয়সের সন্তান কতটুকু আদর-মহব্বতের হবে। তাছাড়া হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তখন যৌবনের দিকে পদার্পণ করছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত অনুপম সৌন্দর্য ও চরিত্র মাধুরী তার মধ্যে ফুটন্ত গোলাপের মত বিকশিত হচ্ছিল।
হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের মতামত গ্রহণ
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ পাকের নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রাক্কালে কারো মতামত বা পরামর্শের প্রয়োজন ছিল না। তবুও পুত্রের কাছে কেন মতামত চাইলেন? তার কারণ হচ্ছে- সন্তানের কাছে আল্লাহর আনুগত্যের স্পৃহা যাচাই করা। কেননা আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যে আত্ম উৎসর্গ করার মধ্যে রয়েছে আলাদা ফযিলত। তাছাড়া জবেহ করার সময় মানব সুলভ কারণে পিতৃস্নেহে বিভোর হয়ে আল্লাহ তা’আলার আদেশ পালনে ইতস্তত ও বিলম্ব হতে পারে বিধায় পুত্রের মতামত অনুযায়ী ঐ কঠিন কাজকে তিনি আগে থেকেই সহজ করে নিলেন। [তাফসীরে রুহুল বয়ান]
দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খার সন্তান, নিঃসন্তান পিতার সন্তান পরিচয়ের স্বাভাবিক চাহিদা ও লোভকে পদদলিত করে পিতা-পুত্রের কুরবানীর জন্য সম্মত হওয়া ও শিশু সন্তানের বিবেকসম্মত মতামত যেন দুনিয়ার সকল বাধার পাহাড় সরিয়ে দিল। সন্তানের কাছ থেকে মতামত নেয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো- এ পরীক্ষা শুধু পিতার জন্য নয় বরং তা সন্তানের জন্যও ছিল ইস্পাত কঠিন পরীক্ষা। সন্তান কী মতামত প্রদান করে আল্লাহ তা’আলা তাও পরীক্ষা করে দেখতে চান। সন্তানও এমন যোগ্যতম সন্তান যে, সাথে সাথে বলে উঠলেন- ইয়া আবাতি ইফআল মা তু’মারুন অর্থাৎ হে আমার সম্মানতি পিতা! আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়েছে আপনি তা বাস্তবায়ন করুন।
[সূরা সাফফাত: ১০২]
আমার পক্ষ থেকে আপনাকে সার্বিক সহযোগিতা দেয়া হবে। আপনি যখন আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে যাবেন, তখন আমার পক্ষ থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা পাবেন না। এই স্বপ্ন দেখার পর ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ফিলিস্তিন থেকে মক্কা শরীফের ঐ স্থানে আগমন করলেন যেখানে সুদীর্ঘ তের বছর মতান্তরে আট বছর পূর্বে স্ত্রী পুত্রকে নির্বাসন দিয়েছিলেন।
কুরবানীর সংকল্প
আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের আদেশ পালনার্থে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম মক্কায় পৌঁছে তাঁর বিবি হযরত হাজেরা আলাইহাস সালামকে বললেন, ইসমাঈলকে সাজিয়ে দাও। এক জায়গায় বেড়াতে যাব। মতান্তরে দাওয়াতে যাব। অন্য রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম কুরবানীর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মক্কায় পৌঁছে বিবি হাজেরার নিকট স্বপ্নের কথা পূর্ণ ব্যক্ত করেন এবং বলেন, এক্ষুণি আমাদের আদরের পুত্রকে গোসল করিয়ে দাও এবং উত্তম কাপড় পরিয়ে দাও। অতঃপর বিবি হাজেরা তার চোখের মনি, কলিজার টুকরা সন্তানকে গোসল করিয়ে দিলেন এবং সুন্দর জামা-কাপড় পরিধান করিয়ে দিলেন, প্রাণভরে আদর করলেন আর বললেন, যাও আমার প্রাণের সন্তান আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করো। দিনটি জিলহজ্ব মাসের দশম তারিখ। পিতা বললেন, ছুরি ও রশি নিয়ে জঙ্গলে চল। ইসমাঈল পিতার আদেশ পেয়ে দৌঁড়ে লম্বা রশি ও তীক্ষ্ণ ছুরি নিয়ে আব্বাজানের কথামতো জঙ্গলের অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। আরেক বর্ণনায় আছে, মায়ের কথা শুনে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম হাসিমুখে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন এবং পিতাও সন্তানের সাথে চললেন ধারালো ছুরি ও রশি নিয়ে।
ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনা
আল্লাহ জাল্লা শানুহু শয়তানের পরিচয় দিতে গিয়ে কালামে মজীদে ইরশাদ করেন, ইন্নাশ শায়ত্বানা লিল ইনছানে আদুব্বুন মুবীন, অর্থাৎ নিশ্চয়ই শয়তান মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহ তা’আলার ইবাদত ও আনুগত্য শয়তান মোটেও সহ্য করতে পারে না। ইতোপূর্বে সে অনেক ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল। ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে স্বপ্নের বিষয়ে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল; তবে পারেনি। সে এবার তার সূক্ষ্ম পরিকল্পনাকে আরো গুছিয়ে নিল। দ্বিতীয় বারের মতো সে বিবি হাজেরার নিকট এসে উপস্থিত হল একজন খুবই আপনজন ও হিতাকাঙ্খী বেশে। সে জিজ্ঞেস করলো ইসমাঈল কোথায়? হাজেরা বললেন, পিতার সাথে জঙ্গলে গিয়েছে। শয়তান বলল, আপনি তো আসল ঘটনা জানেন না। তাঁর পিতা তাঁকে জবেহ করতে নিয়ে গেছে। উত্তরে হাজেরা বললেন, কোন পিতা কি তার সন্তানকে জবেহ করতে পারে? তখন শয়তান একটু বিচলিত স্বরে বলে উঠল, আল্লাহ তাঁকে এ কাজটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। শয়তানের একথা শুনে হাজেরা বললেন, যদি সত্যিই আল্লাহ তা’আলা আদেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই আদেশ অবশ্যই পালন করতে হবে।
বিবি হাজেরাকে ধোঁকা দিতে না পেরে শয়তান এবার পিতা-পুত্রের পিছু নিল। তাঁরা কিন্তু মিনা প্রান্তরের যাত্রী। শয়তান প্রথমে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের নিকট কোন এক বন্ধুর আকৃতি নিয়ে আসে। প্ররোচনা দিতে না দিতে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম শয়তানকে ঝাপটে ধরেন, যেন সে দূর্বল হয়ে পড়ে। ইব্রাহীম তাকে ছেড়ে দিলে পুনরায় সে জমরায়ে আকাবার নিকট বিদঘুটে আকৃতিতে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের গতিরোধ করে। ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সাথে একজন ফেরেশতা ছিলেন, তিনি ইব্রাহীমকে বললেন, আপনি তাকে পাথর নিক্ষেপ করুন। প্রতিবারই আল্লাহু আকবর ধ্বনি উচ্চারণ করুন। এতে শয়তান কাবু হয়ে যায়। এরপর শয়তান আরো একটু সম্মুখে এগিয়ে জমরায়ে ওছতার কাছে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম আবারো আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন। এবারও শয়তান কাবু হয়ে যায়। আবার শয়তান জমরায়ে উলার নিকট পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম আবারও সাতটি পাথর আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে নিক্ষেপ করলে শয়তান ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যায়। [তাফসীরে রুহুল মাআনী]
কুরবানীর প্রস্তুতি
আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য পিতা আপন পুত্রকে কুরবানী করা, পৃথিবীতে এর চেয়ে কঠিন পরীক্ষা আর কি হতে পারে? কিন্তু আপন সন্তানকে জবেহ করার কাজটি যতই কঠিন ছিল সন্তানের সম্মতি ও পরামর্শ সে-ই কঠিন কাজকে তার চাইতে আরো বেশী সহজ করে দিয়েছিল। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম আদর মাখা সুরে বললেন, আব্বাজান! আর দেরি করবেন না। যেন মানব জাতির চির শত্রু ইবলিশ শয়তান আমাদের এই খালেস নিয়তকে বাধাগ্রস্ত করার সুযোগ না পায়। তবে এ বিষয়ে আপনার নিকট আমার কয়েকটি অনুরোধ আছে। তাহল, আপনি আপনার দুই চক্ষুকে কাপড় দিয়ে বেঁধে নিন এবং আমার হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে দিন। যেন আমার চেহারা দেখে আপনার স্নেহ ও ভালবাসা উতলে না উঠে এবং আমার ছটফটের কারণে আমি আপনার জবেহ থেকে ছুটে না যাই। আব্বাজান! আপনার ছুরিটা ভালভাবে ধার করে নিন এবং আপনার পরনের কাপড় গুটিয়ে নিন। যেন আমার লাফালাফিতে রক্তের ছিটা আপনার কাপড়ে না লাগে। আমাকে মাটির দিকে মুখ করে শোয়ায়ে দিন। যেন আমার চেহারা আপনি দেখতে না পান। আমার রক্ত মাখা কাপড় আমার মায়ের নিকট পৌঁছে দেবেন। যেন তিনি পুত্র শোকের বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারেন।
জবেহের করুণ অবস্থা
যখন পূর্ব দিগন্তে উষার আলো উঁকি মারলো। স্নিগ্ধতায় উদ্ভাসিত সারা দুনিয়া। মানব-দানব, পশু-পাখি যে যার কাজে ব্যস্ত। ঠিক তখনই আল্লাহর খলীল হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ছুরিতে শান দিচ্ছেন। উর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাকুল ব্যকুলাবস্থায় হাহাকার করছেন। বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ হৃদয়বিদারক ঘটনা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। যার দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসী আর দেখেনি ইতোমধ্যে ছুরিতে শান দেওয়ার কাজ শেষ। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম শিশুপুত্র ইসমাঈলকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। অদৃশ্য জগতে পড়ে গেল কান্নার রোল। কারো সাধ্য নেই যে, আল্লাহর দরবারে এভাবে জিজ্ঞেস করবে। হে মাবুদ! কোন কারণে আপনি এ রকম করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটাচ্ছেন। খলীলুল্লাহর অন্তরে কী পরিমাণ খোদা প্রেমের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তা, আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন। তিনি বিছমিল্লাহ বলে প্রাণ প্রতীম পুত্রের কাঁধ ও কোমরের মাঝখানে বসে ত্বরিৎ বেগে কোমল কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ব্যর্থ হলেন। ছুরি অকেজো ও ভোতা হয়ে গেলো! পুত্র তখন পিতাকে আবদারের সুরে বললেন, আব্বাজান! আমাকে কাত করে শুইয়ে দিন। মনে হয় আমার আদর মাখা মুখ দেখে আপনার পিতৃস্নেহে জোয়ার এসে গেছে। তাই ছুরি চালাতে পারছেন না। পুত্রের পরামর্শ মতে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাকে ওভাবে ছুরি চালাতে থাকেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না, বরং ছুরি উল্টা দিকে চলতে থাকে। অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, পিঠের পিছনের দিকে সামান্য ছোট ছোট লোম ছিল্ যা ঘাড়ের কেশ। সেই কেশগুলো শুধু কাটা গেল। তিনি আবাক হয়ে দেখলেন, গলায় ছুরি চালানোর পর একটু কাটে; ছুরি ফিরিয়ে আনার পূর্বেই তা জোড়া লেগে যায়। তিনি বারবার ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই সামান্য লোম কাটা যায়। তিনি এই অদ্ভুত ব্যাপারটি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কি ব্যাপার। আল্লাহ তা’আলা কি আমার এ কুরবানী কবুল করছেন না? তিনি রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়লেন এবং আগের চাইতে আরো সজোরে ছুরি চালাতে লাগলেন। [তাফসীরে মাযহারী]
শেষ পর্যন্ত মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলার রহমতের অসীম সাগরে ঢেউ মারতে লাগলো। স্রষ্টার ইংগিত পেয়ে ছুরি ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের হুকুম তামিল করে না। তিনি রাগান্বিত হয়ে ছুরিকে এমন সজোরে নিক্ষেপ করলেন তাতে একটি পাথর সম্পূর্ণ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। আর গায়েব থেকে আল্লাহ পাক ডাক দিয়ে বলেন, হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন- ওয়া নাদাইনাহু আঁই ইয়া ইব্রাহীমু ক্বাদ ছাদ্দাক্বতার রু’ইয়া, অর্থাৎ আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। [সূরা সাফফাত: ১০৪-১০৫]
আল্লাহ পাক বলেন, হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। এ শুভ সংবাদের সাথে আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের স্থানে মোটা তাজা দুম্বাটি রেখে দেন এবং আল্লাহর হুকুমে সেটিই জবেহ হয়ে যায়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- ইন্না কাজলিকা নাযজিল মুহছেনীন, অর্থাৎ আমি খাঁটি বান্দাদেরকে এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। [সূরা সাফফাত: ১০৫]
মহান রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বিশুদ্ধ নিয়তের প্রমাণ পেলেন। তাই তিনি এ কুরবানীকে কবুল করে নিলেন। আর দুম্বাটি ইসমাঈলের পরিবর্তে ফিদইয়া হিসেবে ঘোষণা করে আল্লাহ পাক বলেন- ওয়া ফাদাইনাহু বিজিবহিন আজীম, অর্থাৎ আর আমি ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে ফিদইয়া দিয়েছি তা এক শ্রেষ্ঠ কুরবানী। [সূরা সাফফাতঃ ১০৭]
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের নিকট যেহেতু এ প্রাণীটি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এসেছে, তাই বলা যায় নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয়েছিল। পরিশেষে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম দুম্বাটি কুরবানী করেন। শিশু পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেন এবং তাঁকে নিয়ে মহা আনন্দে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। [তাফসীরে মাযহারী]
ইসলাম ধর্মে কুরবানী
প্রত্যেক নবী-রাসূলগণের ইতিহাসে কুরবানী পাওয়া যায়। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত সকল শরীয়তের উপরই কুরবানী করার বিধান ছিল। কালক্রমে ইসলামের এক অপরিহার্য বিধান হিসেবে তা আজ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মিল্লাতে মুহাম্মদিয়ার এক অনন্য অনুপম ঈমানের পরিচয় বহনকারী ইবাদত হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আল্লাহ তা’আলা এ প্রসঙ্গে কালামে পাকে ইরশাদ করেন, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের প্রভুই একমাত্র প্রভু। [সূরা হাজ্ব: ৩৪]
বর্তমান মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুরবানী নিছক কোন অনুষ্ঠান সর্বস্ব রীতি বা প্রথা নয়; বরং তা আল্লাহ তা’আলার পথে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের অপূর্ব আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিবহ। ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর অবিস্মরণীয় ঘটনাকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত করে রাখার জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ধর্ম ইসলামের অনুসারী উম্মতে মুহাম্মদীর উপর এ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ফাছাল্লী লিরাব্বিকা ওয়ানহার অর্থাৎ সুতরাং হে প্রিয় রাসুল! আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। [সূরা কাউসার: ০২]
কুরবানী হচ্ছে ইসলাম ধর্মের বিশেষ রীতি। কুরবানী না করে এর বিনিময়, মূল্য ইত্যাদি দেওয়া যাবে না। [তাফসীরে নূরুল ইরফান]
হযরত যায়েদ বিন আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিছু সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কুরবানী কি? হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নাত। সাহাবাগণ পুনরায় আরয করলেন, এই কুরবানীর মধ্যে আমাদের জন্য কী উপকারিতা রয়েছে? নবীজি বললেন, কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি নেকী রয়েছে। সাহাবাগণ আবারো আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাহলে দুম্বা ও ভেড়ার পশমের বিনিময়েও কী সওয়াব মিলবে? নবীজি ইরশাদ করেন, দুম্বা ও ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও সওয়াব মিলবে। [মিশকাত শরীফ]
আলোচ্য হাদীসে পাক দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইসলাম ধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুরবানী হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের স্মৃতি বিজড়িত সুন্নাত। তাই ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানীর পশু জবেহ করলেই এ ইবাদত আদায় হয়ে যাবে। অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়। যদিও প্রাচীনকালে ইহুদী, নাসারা ও হিন্দু অন্যান্য ধর্মে মিশর, ইউনান, রোম প্রভৃতি দেশে কুরবানীর প্রচলন ছিল্ কিন্তু ইসলাম ধর্মের কুরবানীর আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। কুরবানী ইসলাম ধর্মের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম ওছিলা ও মহান ইবাদত।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, পবিত্র মক্কা মুআজ্জমায় কুরবানীকৃত পশুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর একটি নিদর্শন বানিয়েছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। [সূরা হাজ্ব: ৩৬]
শুধু পশু জবেহ ও মাংস ভক্ষণ করার মাধ্যমে কুরবানী আদায় হয় না; বরং আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার মানসিকতা লালন করা এবং মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে দৃঢ় প্রত্যয় ও দীপ্ত শপথে ইসলামের শরীয়তের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করাই কুরবানীর মূল শিক্ষা। তাক্বওয়া বা পরহেযগারী ভিত্তিক জীবন গঠনের চেতনায় যে মু’মিন মুসলমান উজ্জীবিত হয়নি, তার কুরবানী মূল্যহীন, নিষ্ফল। এ বিষয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহু কালামে পাকে ইরশাদ করেন, আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্বওয়া পরহেযগারী। [সূরা হাজ্ব: ৩৭]
লৌকিকতা ও পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা নয় কিংবা সমাজে বিত্তবৈভব ও ধনসম্পদের প্রাচুর্য প্রদশর্নের জন্য নয় কেবল একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় পরকালীন সাফল্য ও নাজাত প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে হবে। আমার নবীকে সম্বোধন করার মাধ্যমে গোটা মুসলিম জাতিকে শিক্ষা দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, হে প্রিয় হাবিব! আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য , যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক।
[সূরা আনআম: ১৬৩]
নবী-এ মুকাররাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কুরবানীর দিন মানুষের কোন নেক আমলই আল্লাহর নিকট তত প্রিয় নয় যতটুকু প্রিয় হচ্ছে কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কুরবানীর দিন কুরবানীর পশুর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলার নিকট তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী কর।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.