ইসলামে মুসাফাহার বিধান

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী

عن البراء بن عازب قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما من مسلمىيىن يلتقيان فيتصافحان الا غفرلهما قبل ان ىفترقا – رواه الترمذى

অনুবাদ

হযরত বারা ইবনে আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এরশাদ করেন, দু’জন মুসলিম যখন মিলিত হয়ে পরস্পর মুসাফাহা (করমর্দন) করে, তখন তারা দু’জন পৃথক হয়ে যাওয়ার পূর্বেই তাদের গুনাহ্গুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়। [তিরমিযী]

রাবী পরিচিতি

হযরত বারা ইবনে আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, তাঁর নাম বারা, উপনাম আবু উমারাহ্ পিতার নাম আযিব, পিতা ও পুত্র দু’জনেই সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এ দু’জনের নামে অন্য কোন সাহাবী ছিলেন না। মদীনা মুনাওয়ারার প্রসিদ্ধ খাযরাজ গোত্রে হযরত বারা ইবনে আযিব জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। এর পরবর্তী সকল ইসলামী জিহাদেও তিনি বীরত্বের সাথে অংশ নেন। তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও বিভিন্ন সমরাভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। উষ্ট্রের যুদ্ধে ও সিফফীনের যুদ্ধে তিনি হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পক্ষ সমর্থন করেন।
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হাদীসের খেদমতে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৩০৫। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২২টি, বুখারী শরীফে এককভাবে ১৬টি হাদীস ও মুসলিম শরীফে ৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইসলামী সামাজিক রীতি নীতি তাহযীব তমুদ্দুন সংক্রান্ত তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ ইসলামী সংস্কৃতির পরিচায়ক ও নির্দেশনা। ইসলামী মহাকাশের এই উজ্জ্বল তারকা মহান সাহাবী হযরত বারা ইবনে আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হিজরি ৭২ সনে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি ইরাকের কুফা নগরীতে ইন্তেকাল করেন।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

পারস্পরিক সহমর্মিতা সম্প্রীতি, অভিবাদন জ্ঞাপন, সম্ভাষণ ইসলামের এক উত্তম ব্যবহারিক রীতি ও সৌজন্যের প্রতীক হিসেবে পারস্পরিক কালাম বিনিময় ও মুসাফাহা-করমর্দন রীতি ইসলামের সূচনাকাল থেকে প্রচলিত যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম সংস্কৃতিরূপে পরিচিত। এক মুসলমান অপর মুসলিমের সাথে সাক্ষাৎকালে পারস্পরিক শান্তি ও কল্যাণ কামনার অভিব্যক্তি সালাম বিনিময়। একজন বলবে আস্সালামু আলাইকুম, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। প্রতি উত্তরে অন্যজন বলবেন ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ্, অর্থাৎ আপনার উপরও শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। এ বিধান ইসলামে সুন্নাত হিসেবে স্বীকৃত। এতে উচ্চারিত প্রতি অক্ষরের বিনিময়ে পুণ্যের শুভ সংবাদ রয়েছে।

ইসলামে সম্প্রীতি ও আন্তরিকতা নিবিড় করার লক্ষ্যে পরস্পর সাক্ষাৎকালে মুসাফাহা তথা করমর্দন’র বিধান দেওয়া হয়েছে বর্ণিত হাদীসে এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব আলোকপাত হয়েছে। মুসাফাহার বর্ণনা সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীসের সন্ধান পাওয়া যায়। মুসাফাহা পদ্ধতি নব উদ্ভাবিত বা নব আবিষ্কৃত প্রচলিত কোন প্রথা নয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও এ নিয়ম প্রচলিত ছিল।

তিরমিযী শরীফে আছে-

عن قتاده قال قلت لانس : اكانت المصافحة فى اصحاب النبى صلى الله عليه وسلم؟ قال نعم ـ

হযরত কাতাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা-এর সাহাবাগণের মধ্যে কি মুসাফাহা প্রচলিত ছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ। [তিরমিযী]

হাদীস পর্যালোচনায় জানা যায় মুসাফাহা দ্বারা সালাম পূর্ণতায় রূপ পায়। এ প্রসঙ্গে নিচে বর্ণিত হাদিস প্রণিধানযোগ্য।

عن ابى امامة رضى الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال تمام عىادة المريض ان يضع احدكم يده على جبهته او قال يده فيسأله كيف هو؟ وتمام تحياتكم بينكم المصافحة (رواه الترمذىح)

হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাএরশাদ করেন, রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখার পূর্ণতা হলো তোমাদের কেউ স্বীয় হাত তার কপালে বা হাতে রেখে এ কথা জিজ্ঞেস করা যে, সে কেমন আছে? আর তোমাদের পারস্পরিক অভিবাদনের পূর্ণতা হলো পরস্পর মুসাফাহা করা। [তিরমিযী]

মুসাফাহার সংজ্ঞা

প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

الافضاء بصفحة الله الى صفحة اليه

অর্থাৎ হাতের তালু দ্বারা হাতের তালু ধারণ করার নাম মুসাফাহা বা করমর্দন করা।

আল্লামা খাত্তাবী বলেন,

المصافحة : وضع كف على كف مع ملازمة لهما قدر ما يفرغ من السلام

অর্থাৎ মুসাফাহা হলো, সালাম থেকে অবসর না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর সংযুক্ত থেকে হাতের তালুর উপর হাতের তালু রাখা।

মুসাফাহার বিধান

১. ইমাম নাওবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মতে মুসাফাহা মুস্তাহাব। এ প্রসঙ্গে রদ্দুল মোখতার ফত্ওয়া গ্রন্থে আছে-

قال اعلم ان المصافحة مستحبة عند كل لقاء

তিনি বলেন, জেনে রেখো, প্রত্যেক সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা মুস্তাহাব।
[সূত্র. আনোয়ারুল হাদীস, আল্লামা জালালুদ্দীন আহমদ আমজাদী,
মুসাফাহা অধ্যায়, পৃ. ৪০১] ২.ফতওয়া শামী মুসাফাহা অধ্যায়ে আছে-

لابأس بتقبىل يد الرجل العالم والمتورّع على سبىل التبرك

অর্থাৎ বরকত অর্জনের জন্য আলেমেদ্বীন ও ধার্মিক মুত্তাকী লোকদের হাত চুম্বন করা জায়েয। [প্রাগুক্ত]

৩. হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রণীত ‘আশিয়াতুল লুমআত’ (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ) ৪র্থ খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

مصافحه سنت ست نزد ملاقات وبايد كه بهر دودست بود

অর্থাৎ সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা সুন্নাত। দু’ হাতের মুসাফাহা করা সমীচীন।

৪. মুসাফাহা করা সুন্নাত, হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে অসংখ্য ফজিলত উল্লেখ করা হয়েছে। জামাত সহকারে নামাযের পর মুসাফাহা করা নিঃসন্দেহে জায়েয। বিখ্যাত ফিকাহ্গ্রন্থ, ফতওয়ায়ে শামীতে درمختار كتاب الحظر والاباحة باب الاستبراء তে উল্লেখ আছে যে,

تجوز المصافحة ولو بعد العصر وقولهم انه بدعة اى مباحة حسنة كما افاده النووى فى اذكاره

অর্থাৎ আছর নামাযের পরও মুসাফাহা করা জায়েজ। ফকীহ্গণ যেটা বিদআত বলেছেন, তা বিদআতে হাসনাহ ও মুবাহ্ অর্থে প্রযোজ্য যেমন ইমাম নওবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় আযকারে উল্লেখ করেন। [ফতোয়ায়ে ফয়জুর রসূল, আল্লামা মুফতি জালালুদ্দিন আমজাদী, পৃ. ২৩৮]

যাদের সাথে মুসাফাহা করবে

ইসলামী শরীয়ত কোন পুরুষ পর নারীর সাথে এবং কোন নারী পর পুরুষের সাথে মুসাফাহা অনুমোদন করেনা। এটা ইসলামে না জায়েজ ও হারাম।

পুরুষ পুরুষের সাথে নারীরা নারীর সাথে মুসাফাহা করবে এটা ইসলাম অনুমোদিত ও স্বীকৃত। আজকের সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুকরণ ইয়াহুদি খ্রিস্টানদের কৃষ্টি-কালচার যেভাবে দ্রুতগতিতে মুসলিম সমাজে সংক্রমিত হচ্ছে এটা নিঃসন্দেহে লজ্জা ও ঘৃণার বিষয়। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান সরকার প্রধান ও কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের কৃষ্টি কালচার জলাঞ্জলি দিয়ে ইয়াহুদি নাসারাদের পদাঙ্ক অনুসরণে পর পুরুষ ও পরনারীর সাথে উদারতা ও আধুনিকতার নামে যেভাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করছে, তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য।

বিশিষ্ট ফকীহ্ আল্লামা রিয়াজ ইবনে মুহাম্মদ আল মুসাইমিরী বলেন -উম্মতের পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল আলিম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, পরনারীর সাথে পুরুষের মুসাফাহা করা হারাম। এ রীতির উপর চার মাযহাবের আমল প্রচলিত। সুপ্রতিষ্ঠিত দলিলাদির মাধ্যমে এটা হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

চার মাযহাবের কোন মাযহাবে পরনারীকে স্পর্শ করা, হাত স্পর্শ করে মুসাফাহা করা অনুমোদন ও সমর্থন করেনা। এ ব্যাপারে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর অভিমত প্রনিধানযোগ্য।

মুহাম্মদ ইব

নে আবদুল্লাহ্ ইবনে মিহরান বলেন, পুরুষ নারীর সাথে মুসাফাহা করতে পারবে কিনা? ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাবে বলেন, না, এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করেন, আমি বললাম, কাপড়ের সাহায্যে পুরুষ নারীর সাথে মুসাফাহা করতে পারবে কিনা? তিনি জবাব দিলেন, পারবেনা।

আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে মুসাফাহার বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

মাদকাসক্তি ও আমাদের করণীয়

আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আযহারী [বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন ওয়াস সালাতু ওয়াস …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading