সাইয়িদুল মুজতাহিদীন ইমামুল মুহাদ্দিসীন, ওয়াল ফুকাহা, হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক, সিরাজুল উম্মাহ ও কোটি মানুষের স্মরণীয়-বরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম আজম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু যেমনি ছিলেন সর্বসম্মত ফকীহ, তেমনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত মুহাদ্দিস। কুরআন সুন্নার দিক-নির্দেশনায় তাঁর অসামান্য অবদানের কথা মুসলিম উম্মাহ স্মরণ করবে অনন্তকাল পর্যন্ত। তাঁর আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা ও কুরআন-সুন্নার গবেষণায় সুনিপূন কৃতিত্ব আদর্শ হয়ে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। ইলমে হাদীসে তার অসামান্য অবদানের কথা অতি সংক্ষেপে আমরা এখানে আলোচনা করব।
খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ১৭ হিজরীতে কুফা নগরীর গোড়পত্তন করেন এবং তাঁর শাসন আমলেই কুফা মুসলিম সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। তখন কুফাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনি প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কে মুয়াল্লিম, মুফতী ও গভর্ণরের পরামর্শদাতা হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর উপযুক্ত তালীম-তরবিয়তের বরকতে কুরআন, হাদীস ও ফিকহী মাসাইলের ব্যাপক চর্চা কুফার ঘরে ঘরে প্রসার লাভ করে। অতঃপর চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফা নগরীকে স্বীয় দারুল খেলাফত বানানোর কারণে ইসলামের চর্চা আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে এবং হযরত উমর, আলী ও ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উলূম ও ফতওয়া কুফা নগরীকে ইলমের খনিতে পরিণত করে। সাহাবাদের সাহচর্যে এসে অসংখ্য তাবেঈ শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করেন। মুহাদ্দিস ও ফকীহদের আধিক্যের কারণে কুফা নগরী পৃথিবীর অদ্বিতীয় স্থানে পরিণত হয়।তালীম তারবিয়তের স্বর্গভূমি এই কুফাতেই ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু লালিত-পালিত হন। তাঁর পরিবারের সাথে সাহাবায়ে কেরামের বিশেষত: হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর গভীর সম্পর্ক ছিল। একদা ইমাম আ’জমের পিতা সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর সাক্ষাতে এলে তিনি তার সন্তান-সন্তুতির জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেন। আর এ দোয়ার বরকতেই ইমাম আজম এত বড় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ইমাম আবূ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পিতা ছিলেন একজন সৎ আমানতদার ব্যবসায়ী। তাই বাল্যকালেই তিনি পিতার থেকে এ ব্যবসা শিক্ষা করেছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি যুগের বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ এর দরসে উপস্থিত হতে থাকেন। একদা ইমাম শা’বী রাদিয়াল্লাহু আনহু .-এর দরসে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “তোমার ভিতরে আমি অপূর্ব মেধা ও বেনযীর প্রতিভার নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি।” ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাঁর এ কথা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করলো। তখন থেকে আমি হাঁটে-বাজারে গমন ছেড়ে দিয়ে ইলমের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলাম। এরপর থেকে তিনি ইলম অন্বষণে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। বিশেষ করে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিক্হে গভীর মনোনিবেশ করেন। তিনি যখন হাদীস চর্চায় ব্রতী হন তখন সারা দুনিয়ায় ইলমে হাদীসের ব্যাপক চর্চা চলছিল, যে কারণে তিনি তখনকার সকল বড় বড় হাদীস বিশারদ ও ফকীহদের থেকে উপকৃত হতে পেরেছিলেন। ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর শাইখ ও উস্তাদের সংখ্যা চার হাজারের মতো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম শা’বী, আ’মাশ, সিমাক ইবনে হারব, হাসান বসরী, শু’বা, কাতাদা, আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইকরামা ও হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান প্রমুখ। এতেই বুঝা যায় ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফকীহ হওয়ার সাথে সাথে কত উঁচু স্তরের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন।
তাঁর ইলমে ধন্য হয়ে যারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ হয়েছিলেন তাদের সংখ্যাও অগণিত। যেমন ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, যুফার, হাসান বিন যিয়াদ, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, অকী ইবনুল জাররাহ, মাক্কী ইবনে ইবরাহীম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ তাঁর ইলমেরই ফসল। এরা সবাই সর্বজন স্বীকৃত মুহাদ্দিস ও ফকীহ এবং ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ফেকাহ বোর্ডের সদস্য। ফিকহে হানাফীর ভিত্তি যেহেতু কুরআন-হাদীসের উপর তাই কুরআন হাদীসের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন ছাড়া মাসাইলের ইস্তেমবাত সম্ভব নয়। এ কারণেই ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন, ইবনে সাইদ আল কাত্তান, ইবনুল মুবারক ও অকী ইবনুল জাররাহ-এর মতো মহান ব্যক্তিবর্গও হানাফী মাযহাব অনুযায়ী ফতোয়া দিতেন। ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীসের ক্ষেত্রে যদি সামান্য দুর্বলতাও থাকত তাহলে এ সব মনীষী তার ফেকহী মাযহাব কোনদিনও গ্রহণ করতেন না।
ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তিনিই সর্বপ্রথম ফিকহের তারতীবে ইলমে হাদীস সংকলন করেন এবং অমূল্য গ্রন্থ ‘কিতাবুল আছার’ লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অনুসরণে মুয়াত্তা কিতাব প্রণয়ন করেন। এ বিষয়ে ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু .-এর পূর্বে আর কেউ এগিয়ে আসেন। এতে তিনি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসের সনদ হলো সর্বোচ্চ সনদ। কেননা তিনি ছিলেন তাবেঈ। তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে মাত্র দুইজন বা তিনজন বর্ণনাকারী থাকতেন। এতে তাঁর বর্ণিত হাদীস সবচেয়ে সহীহ বলে বিবেচিত হত। অতএব কেউ যদি বলে ইমাম আবু হানীফা হাদীস জানতেন না বা তিনি হাদীসে এতিম ছিলেন, তাহলে তার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট হবে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য কথা তারাই বলতে পারেন, যারা তাঁর ফিকহের গভীরে যেতে পারেননি, বা তার স্বীকৃত ফিকাহ ইনসাফের সাথে অধ্যয়ন করেননি। কেননা বহু বিশ্ববরেণ্য উলামায়ে কেরাম ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।
নিম্নে তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমকালীন ও পরবর্তীকালীন কতিপয় মনীষীর মতামত উল্লেখ করা হলো।
- হাফেয যাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন- আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রসিদ্ধ ইমাম, মুসলিম মিল্লাতের শ্রেষ্ঠ ফকীহ, হাদীস অনুসন্ধানে তার রয়েছে অনন্য ভূমিকা।
- ইমাম শাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আল্লাহর কসম করে বলছি আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর অনুধাবন শক্তি অতি আকর্ষণীয় এবং স্মৃতিশক্তি অতি প্রখর ছিল। ইমাম ইবনে আইয়ুব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইলমে শরীয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করা হয়েছে। তাঁর ইলম স্বীয় সাহাবাদের নিকটে পৌঁছেছে। তারপর তাদের ইলম ইমাম আবু হানীফা ও তার অনুসারীদের কাছে পৌঁছেছে। চাই এতে কেউ সন্তুষ্ট হোক বা অসন্তুষ্ট হোক।
- ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হাদীসের নির্ভরযোগ্য ১৫টি মুসনাদ রয়েছে। এগুলোকে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মাহমূদ আল খাওয়ারিযমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি একত্রে সংকলন করে ‘জামিউল মাসানীদ’ নামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এতে ইমাম সাহেব সূত্রে বর্ণিত দু হাজার হাদীস রয়েছে। মোটকথা ইমাম আযম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হাফেযে হাদীস। বাকি তিন মুজতাহিদ ইমাম ছিলেন তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাগরেদ। তিনি নিজে ইলমে হাদীসের প্রতি যেমন যত্নবান ছিলেন তেমনি তাঁর ছাত্রদেরকেও ইলমে হাদীসে উৎসাহ প্রদান করতেন। তাঁর সমালোচনা করে মর্যাদা ক্ষুণ করা যায়নি বরং আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্মান দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।
সূত্র : তারিখে বাগদাদ : ১৩/৩৪৫, ৩৩৬, আলামুল মুসলিমীন : ৫/২৯১, মাকানাতুল ইমাম আবু হানীফা : ১৯২
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.