খতীবে পাকিস্তান আল্লামা সায়েম চিশতী রাহিমাহুল্লাহ
অনুবাদঃ মুহাম্মদ মহিউদ্দীন
আগামীকাল প্রাতঃকাল-ই “১০-ই মুহাররম” , আশুরার দিন । দিনটি আসমান এবং যমীন সৃজিত হওয়ার দিন । চাঁদ-তারা এবং সূর্যের সৃষ্টির দিন , জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টিরও দিন এটি । এই দিনটি আল্লাহর পক্ষ হতে মুসিবত এবং পরীক্ষার দিন ; আবার সেই পরীক্ষায় সফলতারও দিন এটি । সত্যের বিজয় এবং অসত্যের বিজিত হওয়ার দিন । নৈকট্যপাপ্ত ফেরেশতাগণের পয়দার দিন এটি । লওহ-কলম কে উদ্ভাসিত করার দিন । আরশ প্রতিস্থাপন এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিন এই আশুরা । হযরত আদম এবং হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুলের দিন । হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর অগ্নি’কে সুশোভিত উদ্যানে পরিণত করার দিন । হযরত ইব্রাহীমের জয় এবং নমরুদের পরাজয়ের দিন । নরপিশাচ ফির’আউনের নীল নদে পতিত হওয়ার দিন । হযরত ইদরীস এর উচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তির দিন । হযরত নূহ এর কিশতী পাড়ে নোঙর করার দিন । এই দিনটি ছিল হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর ‘জিন্দান’-এর শিকল হতে মুক্তি লাভের দিন ; এখন সেই দিনটি-ই কিনা হবে হযরত যাইনুল আবেদীন কে শিকল পড়ানোর দিন । এই দিনটিতেই হযরত ইসমাঈল যবীহুল্লাহ’র পরিবর্তে দুম্বা কুরবানি হয়েছিল এবং এই দিনটিতেই সেই কুরবানিকে পরিপূর্ণতা দানে হযরত ইমাম হুসাইন সহ তাঁর পরিবার-পরিজন’কে কারবালার প্রান্তরে কুরবানি দেয়া হবে ।
আশুরার এই দিনে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামকে তাঁর পুত্র ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ এর আনন্দ সংবাদ দেয়া হয়েছিল এবং এই দিনটিতেই কিনা হযরত সাজ্জাদ(যাইনুল আবেদীন)’কে তাঁর পিতা(হুসাইন) হতে আলাদা করা হবে । এই দিনটিতেই হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন আর সাথে সাথে থেমে গিয়েছিল তাঁর ক্রন্দন ; অথচ সে দিনটিতেই কিনা হযরত সাজ্জাদ এর চোখ মুবারক হতে রক্ত-অশ্রু প্রবাহিত হবে ! এই দিনেই হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কে আপন ভাইদের সাথে মিলিত হওয়ার শুভ সমাচার দেয়া হয়েছিল , আর সেই দিনটিতেই কিনা হযরত ইমাম হুসাইন’র আপন বোন হযরত যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে তাঁর ভাই হুসাইন হতে বিচ্ছেদন ঘটানো হবে !
ইসলামী বিশ্বের ইতিহাসের আলোকে এটা সর্বোচ্চ সীমার একটি মহান দিন । ইমামে আলী মাক্বাম হযরত ইমাম হুসাইন এতদিন সেই দিনটিরই অপেক্ষা করছিলেন । এটাই সেই দিন , যেই দিনটিতে দুনিয়া ও আখিরাতের শাহজাদাকে আপন নানাজানের ধর্মকে অন্ধকার এবং পশ্চাদ্গামী হওয়া থেকে মুক্ত করতে হবে । নানাজানের উম্মতের ডুবন্ত তরীকে কিনারায় ভিড়াতে হবে । স্বয়ং যবেহ হওয়ার মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে এই বিষয়টিকে দীপ্তিমান করতে হবে যে,
কত্লে হুসাইন আসল ম্যায় মারগে ইয়াজিদ
ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বা’দ
“হুসাইন এর শাহাদাত এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দুশমন নরাধম ইয়াজিদেরই মৃত্যু ঘটেছে । ইসলাম এভাবেই একেকটি কারবালা’র দ্বারা পূনর্জীবিত হয় ।”
এটি ছিল সেই পবিত্র এবং মহান একটি দিন , যাকে হুসাইনের রক্ত প্রবাহের দ্বারা আরো মর্যাদাবান করতে হবে । এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে , এই দিনটি ছিল সহস্র সৌভাগ্যবান এবং লাখো রহমত প্রাপ্তগণের খুশির দিন । কিন্তু এই দিনটি হুসাইনের রক্ত দ্বারা যেই মহান উচ্চতা এবং মর্যাদা লাভ করেছে , হুসাইনের শাহাদাতের রঙ এদিনটিতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার রঙকে রাঙিয়ে দিয়েছে । বরঞ্চ এটাই বোধগম্য হচ্ছে যে , জান্নাতের শাহজাদা-ই এই দিনটিকে নিজের জন্য পছন্দ করে এটিকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন । আশুরার ঐতিহাসিক মর্যাদাকে যদি স্মরণ করা হয় , তবে শুধুমাত্র হুসাইনের স্মরণ এর মাধ্যমে । হে আশুরার দিন ! তোমাকে সালাম , তোমাকে হুসাইনের ‘লাল রক্ত’ আরো উদ্ভাসিত করে দিয়েছে । তুমি যখনই আসবে , ঈমানদাগণ তোমাকে অভিবাদন জানাবে । সেই ১০ই মুহাররম প্রভাতের আর মাত্র আট ঘন্টা বাকী । বরঞ্চ এটা ধরে নিন যে , কিয়ামত সংঘটিত হতে আর কিছু সময় বাকী । কিয়ামত এই দিনটিতেই সংঘটিত হবে ; কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট সময় আমরা কেউ জানি না । কারবালা’র যমীনের উপর আগামীকাল কিছু সময়ের জন্য হলেও সেই কিয়ামত এর একটা প্রতিচ্ছবি প্রদর্শিত হবে ।
সাথীদের উদ্দেশ্যে ইমামের বক্তব্যঃ
ইমামে আলী মাক্বাম এশা’র নামায আদায় শেষে নিজ সাথীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন । বক্তব্যের প্রারম্ভে আল্লাহ্ তায়ালা’র প্রশংসা এবং মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন । অতঃপর বললেন যে , আমি প্রত্যেক অবস্থায় আল্লাহ্ তায়ালা’র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী ; চাই সেটা দুঃখ-কষ্ট হোক বা সুখ-শান্তি । আমরা খোদা তায়ালা বিশেষ দয়ার একটি দৃষ্টান্ত ; যিনি আমাদের ঘরকে নবুয়ত এবং রিসালাতের এর মুকুট দ্বারা সম্মানিত করেছেন । আমাদের প্রতি কুর’আন অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং কুর’আনকে হৃদয়াঙ্গম করার বোধশক্তিও দান করা হয়েছে । ইসলামের যাবতীয় জ্ঞানসমূহকে বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে বুঝার ক্ষমতাও মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের দান করেছেন । দৃষ্টান্ত অর্জনের শক্তিও আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে ।
আম্মা বা’দ , হে আমার দুঃখের সাথীগণ ! আমি এটা খুব ভালো করে জানি যে, আজ গোটা দুনিয়ার বুঁকে আমি এবং আমার সাথীদের চাইতে সর্বোত্তম কোন দল আছে , না আমার পরিবার হতে অধিক কল্যাণমুখী এবং সমবেদনা দানকারী এমন কেউ দুনিয়ার যমীনে আছে । হে হুসাইনের প্রেমিকগণ ! আল্লাহ্ তায়ালা আপনাদের সবাইকে (আমার সহচর হওয়ার কারণে) উত্তম প্রতিদান দান করুন । আপনারা জানেন যে , আমার সাথে ইয়াজিদের শত্রুতা । তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে শুধুমাত্র আমাকে হত্যা করা । সে তার তাগুতি সাম্রাজ্যের ভিত্তি আমার লাশের উপর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় । এজন্য আমি আপনাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি , নিশির এই অন্ধকারকে কাজে লাগান । আর কিছুক্ষণ পরই আকাশের বুঁকে চাঁদ দৃশ্যমান হবে । তখন হয়তো কোন বিপদ আপনাদের সামনে আসতে পারে ! আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এজন্য যে , এই তীব্র তাপদাহের মধ্যে আপনারা টানা দু’দিন ধরে আমার সাথে আমার মতই পিপাসার তীব্র যন্ত্রণা বরদাশত করে যাচ্ছেন ! কিন্তু এখন আমি আপনাদেরকে আনন্দচিত্তে অনুমতি প্রদান করছি যে , আমার সাথে থেকে বিপদের সম্মুখীন হওয়ার চাইতে নিজ নিজ বাহনের উপর গিয়ে বসুন এবং যেথায় যেতে মন চায় চলে যান !
যদি সম্ভব হয় তবে আমার পরিবারের একেকজন সদস্যকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেয়েন ; আমি আপনাদের উপর সন্তুষ্ট । কিয়ামতের দিন (আপনাদের বিষয়ে) এই কথা বলে কোন অভিযোগ উত্থাপিত করবো না যে, “আপনারা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন” । বরং আল্লাহ্র দরবারে হাজির হয়ে আমি আবেদন করবো যে , হে খোদা তায়ালা ! আমার সাথীদের সবার আমার পরীক্ষার মধ্যে সমান অংশ আছে ।
আমার ভয়শূন্য সাথীগণ , প্রস্থান করুন । হুসাইন আপনাদেরকে সম্পূর্ণ প্রাণ খুলে “বিদায়” জানাচ্ছে । আপনারা যেখানেই যাবেন , কেউ আপনাদের বাধা দিবে না । এই সব (ইয়াজিদি) সৈন্যরা আমার জন্য এসেছে । তাদের তীর , তলোয়ার এবং বর্শা সমূহের লক্ষ্যস্থল হচ্ছে হুসাইনের সিনা । কেন আপনারা শুধুশুধু আমার সাথে থেকে বিপদের সম্মূখীন হবেন ?
ইমামের প্রতি তাঁর সাথীদের আবেদনঃ
ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথীগণ যখন তাঁর এই আবেগময় নূরানী কথামালা শোনার পর তাদের অন্তরগুলো যেন হু হু করে কেঁদে উঠলো ! ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তাঁরা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র নিকট আবেদন জানালেন যে , হে উভয় জগতের বাদশাহ ! হে সত্য এবং ন্যায়ের শহর ! হে নবী বাগানের আলোকময় ফুল ! আমরা এখন আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাবো ? আপনাকে ছাড়া দুনিয়াতে আমাদের এমন কে-ই বা আছে , যার জন্য আমরা বেঁচে থাকবো ? হে ফাতেমা যাহরার হৃদয়ের স্পন্দন , আমাদের নিকট যদি কোটি কোটি জীবনও থাকতো , তবে সেগুলোও আপনার কদমে উৎসর্গীত করতাম ! দয়া করে আমাদেরকে আপনার কদম হতে দূরে যেতে পরামর্শ দিবেন না । হে আল্লাহ্র মাহবুবের প্রিয় নাতি ! আমাদেরকে আপনার পদযুগলে উৎসর্গীত হতে দিন । আমাদেরকে আমাদের জীবনের স্বার্থকতা আদায় করতে দিন । আমাদের জন্য সৌভাগ্য এবং খুশির বিষয় হচ্ছে এটাই যে , আপনি আমাদেরকে আপনার জন্য উৎসর্গীত হতে দেখবেন । আমাদের জীবন উৎসর্গের প্রতি দৃষ্টি দান করুন ।
হে যুগের ইমাম ! আপনার পবিত্র প্রাণ আমাদের সবার প্রাণের চেয়ে অধিক মূল্যবান । শুধু আমাদের কেন , গোটা সৃষ্টিজগতের হতে বেশি মূল্যবান ।
হে ইমাম ! আমাদের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা আপনার নামে উৎসর্গীত হবে । এবং যেসময় আমাদের রুহ সমূহ আমাদের দেহগুলোকে ছেড়ে চলে যাবে , তখনও তারা সর্বদা এটাই বলতে থাকবে যে , হে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ! আপনার মর্যাদার প্রতি রইলো সালাম ।
আপনি আমাদের মাওলা এবং মনিব । আপনি আমাদের জানের চেয়ে আমাদের নিকট বেশি প্রিয় ।
হযরত আব্বাস বললেন – হে ইমাম ! আমরা আপনার ইন্তেকালের পর জীবিত থাকবো , খোদা আমাদেরকে যেন সেই দিনটি না দেখায় ! হযরত মুসলিম এর ভাইয়েরা বললেন – ইতিহাস আমাদেরকে কী এভাবে স্মরণ করবে যে , আমরা আমদের ইমাম , আমাদের সরদার এবং চাচাতো ভাইদেরকে ছেড়ে পলায়ন করেছিলাম ; যেখানে না কোন তীর নিক্ষেপ হয়েছে আমাদের উপর , না কোন বর্শা বা না কোন তলোয়ার !
আল্লাহ্র শপথ ! আমরা এমন জীবন চাই না । আমরা তো চাই আমাদের জান-মাল এবং সন্তান সবকিছুকে আপনার প্রতি উৎসর্গীত করতে ! মুসলিম বিন আওসজা বলেন – আমি ততক্ষন পর্যন্ত লড়তে থাকবো , যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে রক্তের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত বাকী থাকে ।
সা’দ বিন আব্দুল্লাহ হানাফী আরয করলেন , “হে সত্যের ইমাম ! আমরা ততক্ষন পর্যন্ত আপনার জন্য লড়াই করতে থাকবো , যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই সান্তনা না মিলবে যে আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের হক্ব আদায় করেছি । আল্লাহর শপথ ! যদি আমি এ কথা জানি যে , আমাকে হত্যা করা হবে বা আগুনে জ্বালানো হবে অথবা আমার দেহ বাতাসের সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে এবং আমার প্রতি এরকম আচরণ সত্তরবার করা হবে , তবে তখনও আমি আপনার সংস্পর্শ ত্যাগ করবনা । যুহায়ের বিন কায়েস বললো– হে আল্লাহ্র রাসূলের নাতি ! আল্লাহ্র শপথ নিয়ে বলছি – আমার দেহকে যদি আড় ভাবে হাজার বারও বিদারণ করে ফেলা হয় , তবুও আমি আপনার সঙ্গ ছাড়বোনা ।
ইমামে আলী মাক্বাম হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন তার সাথীদের এরকম শিষ্টাচার ও আনুগত্যমূলক বক্তব্য শুললেন , তিনি তাঁদের জন্য অনেক দোয়া করার পর বললেন – যদি আপনাদের সবার বাসনা এটাই হয় , তবে উঠুন এবং আমার সাথে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিন । সেই সকাল এসে পড়বে আর কিছুক্ষণের মধ্যে , যখন আমার এবং আপনাদের লাশ মাটি এবং রক্তের সাথে আলিঙ্গন করবে । সময় আর বেশি নাই । তোমাদের তাবু সমূহ উঠিয়ে কাছাকাছি করে লাগাও এবং সেগুলোর আশে পাশে একটি গর্ত খনন করে সেটাকে লাকড়ি দিয়ে ভর্তি করো । আমি জানি যে , ইয়াজিদি সৈন্যরা নবীজীর সম্মানকে বিন্দু পরিমাণও তোয়াক্কা করবে না । তারা (ইয়াজিদিরা) আমাদের তাবুর উপরও হামলা চালাবে । এখন জলদি জলদি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করো । সকাল হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধের সূত্রপাত হবে । অতঃপর ইমাম হুসাইন রাদিয়ল্লাহু আনহু নিজ সাথীদেরকে যার যার দায়িত্ব বন্টন করে দিয়ে তাঁর আহলে বাইতদের তাবুর মধ্যে তাশরীফ নিলেন ।
[প্রবন্ধটি খতীবে পাকিস্তান , কলম সম্রাট আল্লামা সায়েম চিশতী রাহিমাহুল্লাহ’র “শহিদ ইবনে শহিদ” কিতাবখানা হতে অনূদিত – মহিউদ্দীন]Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.