আল্লামা মুফতী ক্বাজী মুহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ
ইসলামের পরিভাষায় ‘শাহাদাত’ অর্থ সাক্ষ্য প্রদান করা, প্রত্যক্ষ করা এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র দ্বীনকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে বিচ্ছিন্নবাদী ও বিরোধীদের সাথে লড়াই করে বিরোধীদের হাতে মৃত্যুকে শাহাদাত বলে।এই শাহাদাত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি মোহনীয় মর্যাদা।মানুষ পার্থিব দিক দিয়ে বিভিন্ন পদে ভূষিত হয়ে থাকেন।যেমন- অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, ব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি। এসব পদ মর্যাদার পদ।পাশাপাশি এগুলোর বিপরীতে এমন কিছু নাম আছে যেগুলোকে মানুষ ঘৃণার মাধ্যমে বর্জন করে।
ইসলামী দিক দিয়ে মানবজাতী দু‘ভাগে বিভক্ত। মুসলিম আর কাফির।আবার কাফিরদের মধ্যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে।তম্মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য হলো মুরতাদ (ধর্মত্যাগী বা ধর্মের মৌলিক যেকোন অংশকে অস্বীকার করে বা উপহাস করে অথবা বেআদবী করে) মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোচ্চ স্থানে আসীন (আল্লাহর পরে এবং সকল সৃষ্টির উপর সর্বোচ্চ মর্যাদাবান)হলেন- হুজুরে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এরপর পর্যায়ক্রমে সমস্ত ও অন্যান্য পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণ, ছিদ্দিকীনগণ, শুহাদায়ে কেরাম, ছালিহীন বা আউলিয়া কেরামের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের পদ মর্যাদা রয়েছে। যেমন- গাউস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, নুকুবা, নুজুবা, আমদ ইত্যাদি। এরপর উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন পদ মর্যাদা রয়েছে। যেমন- মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফক্বীহ্ (মুফ্তী) ইত্যাদি। এরপরের স্তরে রয়েছেন মুত্তাক্বী মুমিন। এর পরবর্তী স্তরে রয়েছে গুনাহ্গার ঈমানদার। মুসলমানদের মর্যাদার স্তর সমূহের মধ্যে শাহাদাতের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী।কারণ শাহাদাত বরণকারীরা কবরের সাওয়াল-জাওয়াব, আযাব ও আখেরাতের হিসেব-নিকেশ ব্যতীত সহজে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে। তাঁরা অতি সহজে ও স্বল্প সময়ে সাধারণ স্তর থেকে এই ঈর্ষনীয় মর্যাদার স্তরে পৌঁছে যান।এ প্রসঙ্গে ১৯৩৪ সালের করাচীর শহীদ আবদুল কাইয়ুমের ঐতিহাসিক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।আবদুল কাইয়ুম একজন সাধারণ গাড়ী চালক ছিলেন।তিনি বসবাস করতেন একটি ছোট্ট ঝুপরীতে।তখন তার আপন হিসেবে ছিল ঘোড়ার গাড়ী ও কয়েকজন বন্ধু।সে সময় কোন এক নাস্তিক হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র শানে বেআদবী করার অপরাধে কোর্টে অভিযুক্ত হয়েছে।অভিযুক্ত ব্যক্তি কোর্টে বিচারপতির সামনে হাজির ছিল।এমতাবস্থায় আবদুল কাইয়ুম গাড়ী চালিয়ে সেখানে হাজির হলেন।বিচারপতি ছিলেন তৎকালীন জনৈক ইংরেজ ব্যক্তি।আবদুল কাইয়ুম সেখানে উপস্থিত হয়ে আকস্মিকভাবে নাস্তিককে হত্যা করেন এবং স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দিলেন।এ ঘটনা মুহর্তের মধ্যে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল এবং আলোড়ন সৃষ্টি করল।এই অখ্যাত আবদুল কাইয়ুম তাৎক্ষণিক রাসূলপ্রেমিক মুসলমানদের অন্তরে জায়গা করে নিলেন।ফলে তার পক্ষে মুসলিম আইনজীবীগণ অতি আগ্রহের সাথে আইনী লড়াই করতে প্রস্তুতি নিলেন।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম আইনজীবীগণও তার পক্ষে অবস্থান নিলেন এবং তাঁকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।তাঁরা আবদুল কাইয়ুমকে পরামর্শ দিলেন, তার স্বীকারোক্তি একটু রদবদল করে বলার জন্য; যাতে এ অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু আবদুল কাইয়ুম তাঁর বক্তব্যের উপর অনঢ় যে, তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ঐ নাস্তিককে হত্যা করেছেন এবং তিনি বলেন- এই হত্যার কারণে আমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলে আমি হাসিমুখে বরণ করে নেব। এটা আমার জন্য শাহাদাতের মর্যাদা হবে। এদিকে আবদুল কাইয়ুমের মুক্তির জন্য মসজিদ, মক্তবে ও ঘরে ঘরে আবাল-বৃদ্ধ বণিতা হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে তাঁর জন্য প্রার্থনা করতে থাকে, কিন্তু আবদুল কাইয়ুমের আশা পূর্ণ হল তাঁর মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে। (তিনি শাহাদাতের মর্যাদা বুঝেছেন, বাস্তবে তাই)তাঁর নামাযে জানাযায় পঁচিশ লক্ষেরও অধিক মুসলমান উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা জ্ঞাপন করেন।তাঁর কফিনও ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।
যে আবদুল কাইয়ুম ছিলেন একজন সাধারণ ব্যক্তি।তিনি আল্লাহর পথে নবীর প্রেমে শহীদ হয়ে অসংখ্য মুসলমানদের হৃদয়ে ভক্তি, মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র হয়ে উঠেন।এভাবে শহীদগণও মুহর্তের মধ্যে সাধারণ স্তর অতিক্রম করে উচ্চস্তরে আসীন হয়ে থাকেন।
যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِنْ لَا تَشْعُرُونَ
অর্থাৎ – আল্লাহর পথে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা বুঝতে পারনা। (সূরা বাকারা-১৫৪)
আল্লাহ পাক অপর আয়াতে করীমায় এরশাদ করেন-
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
অর্থাৎ – যারা আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করেছেন,তাঁদেরকে তোমরা মৃত ধারণা করোনা বরং তারা জীবিত এবং তারা প্রভূর নিকট থেকে রিযিক পায়। (সূরা আলে ইমরান-১৬৯)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
শহীদদের রূহ সবুজ পাখীরূপে আরশের নিচে ঝুলন্ত বাতির উপর অবস্থান করে এবং সেখান থেকে বেহেশতের যেকোন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে এবং যা নিয়ামত, ফলমল খাওয়ার ইচ্ছা থাকে তা খেয়ে থাকে। – (মুসলিম ও মিশকাত শরীফ)
অপর এক হাদীসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
ইসলামে শহীদগণের জন্য ছয়টি বিশেষত্ব রয়েছে।
(১) রক্তের প্রথম ফোঁটা পতিত হওয়ার আগে তাঁর সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হয় এবং রূহ বের হয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বেহেশতে তাঁর ঠিকানা দেখিয়ে দেয়া হয়।
(২) কবরের আযাব থেকে মুক্তি পায়।
(৩) জাহান্নামের আযাবের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পায়।
(৪) মাথায় মূল্যবান ইয়াকুতী পাথর খচিত তাজ পরানো হয়।
(৫) তাঁকে বেহেশতের বাহাত্তরটি হুরের সাথে বিয়ে দেয়া হবে।
(৬) তাঁর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ৭০জনের ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ কবুল হবে।- (তিরমিযী ও মিশকাত শরীফ)
অপর এক হাদীসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
আল্লাহর পথে লড়াই করে শাহাদাত বরণকারীগণ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
(১) ঐ মুমিন যিনি জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করতে করতে দুশমনের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এমন ব্যক্তি ধৈর্য্য ও কষ্টের পরীক্ষায় কামিয়াব হয়েছে।এ ধরণের শহীদদের স্থান আল্লাহর আরশের নিচে নূরানী তাঁবুর মধ্যে হবে।আম্বিয়া কেরাম ও তাঁদের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি হবে এবং সমস্ত কামালাত তাঁদেরকে দেয়া হবে।নবীদের এবং তাঁদের মাঝখানে শুধু নবুয়ত নিয়েই পার্থক্য হবে।
(২) এমন মু’মিন যার আমলের মধ্যে ভাল-মন্দ রয়েছে।কিন্তু তিনি জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শত্রুর হাতে শহীদ হয়েছে।এ ধরণের শাহাদাতের দ্বারা ঐ বান্দার সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে। বেহেশতের যেকোন দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে।
(৩) ঐ মুনাফিক যে জান-মাল দিয়ে মুসলমানদের সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছে এবং কাফিরের হাতে মৃত্যু বরণ করেছে।এমন ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে।এ কারণে যে, “নিশ্চয় তরবারী অন্তরের কুফুরীকে মুছতে পারেনা।” – (দারেমী শরীফ ও মিশকাত শরীফ)
উক্ত হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয়, লোক অন্তরে নবীর দুশমনী রেখে ইসলামের বা জিহাদের কথা বলে, বিপ্লবের শ্লোগান দিয়ে থাকে এবং তাদের তথাকথিত ইসলামী আন্দোলনের জন্য জান বিসর্জন দেয়, একে শাহাদাত বলা যাবে না বরং তাঁদের ঠিকানা জাহান্নামেই।
শাহাদাতে কারবালাই তুলনাহীন শাহাদাতঃ
ইসলামের প্রচার-প্রসারের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যে সমস্ত ঈমানদার শাহাদাতের রক্ত ঢেলেছেন তম্মধ্যে ‘ইমাম আলী মকাম হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু‘র শাহাদাত বরণই তুলনাহীন।কারণ শাহাদাত বরণকালে যে সমস্ত পাহাড় সমতুল্য মুছিবত তাঁর সম্মুখে এসেছিল তা অন্য কারো ক্ষেত্রে হয়নি।তিনি একাধারে তিন দিনের ক্ষুধার্ত ছিলেন এবং তাঁর সাথে পরিবার পরিজনের যারা ছিল সবাই পানির জন্য হাহাকার করেছিল এমনকি ছোট শিশু আলী আছগর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একফোঁটা পানির জন্য কিভাবে ছটফট করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যে করুণ ঘটনার দৃষ্টান্ত নেই।কোন ব্যক্তি নিজে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্থ হলে কিছুটা হলেও সহ্য করা যায়।কিন্তু পরিবার পরিজন ও শিশুরা যখন কঠিন মুছিবতের শিকার হয় তখন ঐ ব্যক্তি উন্মাদের মত হয়ে যায়।এ ছাড়া পানি যদি না থাকত তাহলে তৃষ্ণার কষ্ট কম হত।কিন্তু যেখানে পানির ছড়াছড়ি এবং সাধারণ মানুষ নির্বিচারে ব্যবহার করছে এমনকি পশুরা পর্যন্ত।এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তির যদি তিন দিন তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি থেকে বঞ্চিত রাখা হয় এমনকি তাঁর ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে পানির কাছে যাওয়া মাত্র তীর দিয়ে শহীদ করা হয় তখন ঐ ব্যক্তির উপর কি পরিমাণ মুছিবতের বোঝা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।এ ছাড়া যারা পানি বন্ধ করে দিয়েছিল তারাও মুসলমান ছিল ! তারাও কলেমা পড়েছিল, নামাযের আযান দিয়েছিল অথচ এই মুসলমানরা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে যেভাবে একের পর এক জুলুম অত্যাচার করেছিল তা ইমাম আলী মক্বামের পক্ষে কতই দুঃখজনক তা বর্ণনাতীত।হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ঘরে বন্দী রেখে পানি না দিয়ে শহীদ করা হয়েছিল কিন্তু এ ঘটনা তাঁর দেশেই হয়েছিল।ইমাম আলী মক্বামের শাহাদাত হয়েছে দেশ থেকে অনেক দূরে যা ছিল উত্তপ্ত মরুভূমি।কাজেই এটা কত যে মুছিবত আর কষ্টের তা বলার ভাষা নেই।অপরদিকে হযরত ইমাম আলী মক্বামের আশঙ্কা ছিল যে, তাঁর নিজের শাহাদাতের পর পরিবার পরিজন এবং আহলে বায়তের মহিলাগণ বেছাহারা হয়ে যাবেন।তাঁদের মালামাল লুন্ঠিত হবে এবং তাঁদেরকে কি পরিমাণ অত্যাচার করা হবে এবং বন্দী অবস্থায় রাখা হবে তা ভাবতেন।এই মুছিবতের সময় বিশ্বখ্যাত ‘বলীয়ান’ রুস্তম যদি ইমাম আলী মক্বামের স্থানে হত তাহলে তাঁর মনোবলও ভেঙ্গে যেত এবং বিপক্ষের সব কথা এবং বিধানাবলী মাথা পেতে মেনে নিত।কিন্তু শাহাদাতের সম্রাট হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মুছিবত ও দুঃখের কঠিন পরীক্ষায় প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেন পাহাড়ের মত ধৈর্য্য এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে। যার সামনে আপন পরিবার ও ভক্তদের ৭২জন শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করলেন।পাশাপাশি যাঁর নূরানী শরীরে ৭৩টি জখম হয়েছিল। এরপরও তাঁকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব হয়নি।শাহাদাতের পরে তাঁর লাশ মোবারককে ঘোড়া দ্বারা পদদলিত করা হয়েছিল।তাই শাহাদাতের জগতে তাঁরই শাহাদাত তুলনাহীন হিসেবে জগতে প্রসিদ্ধ।যা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানের অন্তরে ও আক্বীদায় জাগরিত থাকবে।খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি কতইনা সুন্দর বলেছেন-
شاہ ہست حسین، بادشاہ ہست حسین
دین ہست حسین، دین پناہ ہست حسین
سر داد نہ داد در دست یزید
حقا کہ بنائے لا الہٰ ہست حسین
(ইমাম হুসাইন রাজা এবং সম্রাট তিনিই দ্বীন, তিনিই দ্বীনের রক্ষক। দ্বীন রক্ষার্থে শির দিলেন ইয়াজিদের হাতে হাত রাখলেন না। বাস্তবিকই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ কলেমার ভিত্তিই ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে কারবালার প্রান্তরে ইসলামের ভিত রচিত হয়েছে।
মহাকবী আল্লামা ইকবাল বলেন-
হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস্ সালাম‘র একটি রহস্য ছিলেন, হযরত ইসমাঈলের কোরবানীকে তিনি শাহাদাতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে ইবরাহীম খলীল আলাইহিস্ সালাম‘র স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
তাঁর রক্ত হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস্ সালাম‘র রহস্যকে উম্মুক্ত করে দিলেন এবং ঘুমন্ত মুসলিম মিল্লাতকে জাগ্রত করে দিলেন।
হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‘র তরবারী খাপ থেকে বের করলেন তখন বাতেলদের উপর আঘাত হেনে রক্তাক্ত করে দিলেন।
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর এই শাহাদাতের রক্ত দিয়ে কারবালার ময়দানে ইল্লাল্লাহ্‘র (আল্লাহর একত্ববাদ) ও ইসলামের নক্শাকে রচিত বা খচিত করেছেন।শুধু তাই নয় এ দ্বারা আমাদের মুসলিম মিল্লাতের মুক্তির পরোয়ানা লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইসলাম নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন।বাতিলশক্তি ইসলামকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের লিপ্ত।যে ইয়াযিদী শক্তিকে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর বিপক্ষে ব্যবহার করা হয়েছিল তা মূলতঃ ইয়াহুদী চক্রের পরোক্ষ নির্দেশ ছিল।ইয়াহুদী খ্রিষ্টানের চক্রান্ত ইসলামের শুরু থেকেই ছিল।কখনো এ চক্র মুনাফিক নামধারী মুসলমান বানিয়ে ইসলামের মধ্যে বিপর্যয় ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।কখনো ইসলামের শাসকদের প্রিয়ভাজন হয়ে তাদেরকে বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের পরামর্শ দিত।ফলে কতিপয় শাসকের মধ্যে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ পাওয়া যেত।পরোক্ষভাবে ইয়াহুদী চক্রের শাসকদের এই কার্যকলাপকে ইসলামের কালো অধ্যায় হিসেবে রচনা করত এবং তা বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা দিত এবং ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে প্রচার করত।এভাবে বর্তমানেও অনেক মুনাফিক মুসলমানকে অর্থ ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছে।যেন তারাই শুধু ইসলামের একমাত্র রক্ষক এবং ইসলামের কর্ণধার।ইয়াহুদী চক্রের অর্থায়নে ইসলামের মৌলিক আক্বীদা বিরোধী নানা রকম ভ্রান্ত আক্বীদা বিভিন্ন বই-পুস্তকের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছ।ইয়াহুদী চক্রের পরামর্শে কোরআনের ভ্রান্ত তাফসীর লিখানো হয়েছ এবং বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বব্যাপী এগুলোকে প্রচার করা হচ্ছে।সুফী-দরবেশ, আউলিয়া কেরাম, উলামায়ে হক্কানী, আইম্মায়ে মুজাতাহিদীন, তাবিয়ীন এবং সাহাবায়ে কেরাম এমনকি নবী রাসূলগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কটুক্তি করা হচ্ছে, যা বাহ্যিকভাবে মুনাফিক নামধারী আলেমদের মাধ্যমে কোরআন-হাদীসের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করানো হয়েছ।অন্যদিকে ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছ।কিন্তু সঠিক হুসাইনী ইসলামের নমুনার মধ্যে যারা রয়েছেন তারাই আহলে সুন্নাতের অনুসারী।যদিও রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের কোথাও এই সুন্নীদল প্রতিষ্ঠিত নন।কিন্তু বাস্তবিকভাবে হক্বের উপর রয়েছেন।যেমনি- ইমামে আলী মক্বাম রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অধিকারী হননি এরপরও তিনি হক্বের উপর ছিলেন।নৈতিকদিক থেকে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু‘র বিজয় রচিত হয়েছে।যা তার শাহাদাতের মাধ্যমে হয়েছিল।ইসলামের সেই সঠিক ধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর মধ্যে সঞ্চারিত।এই দলের বিপক্ষে অন্যান্য দল-উপদল যা রয়েছে তা মূলতঃ হুসাইনী ইসলামের ভিত্তি নয়।বরং বাতিল ধর্মের ভিত্তি নেফাক্ব বা আন্তরিক কুফরীর উপরই রয়েছে।যার মধ্যে হাত রয়েছে ইয়াহুদী চক্রের।যদিও বর্তমানে তথাকথিত ইসলামের নামে আন্দোলন করা হচ্ছে, ইসলাম কায়েমের নামে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে মূলতঃ তাঁদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রের।এটাই বাস্তব যে, এই ইসলামের লেবেলধারী দল উপদলের যে আক্বীদা বিশ্বাস রয়েছে তা ইসলামের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।সুতরাং মুসলিম মিল্লাতকে আহ্বান করব এই বাতিল ফিরকার ধোঁকার বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত যেমনিভাবে আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি প্রেমভক্তি রাখাকে ঈমানের অংশ মনে করেন তেমনি সমস্ত সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকেও আক্বীদার অংশ মনে করেন।
আহলে বায়তকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের মুক্তির জন্য নূহ আলাইহিস্ সালাম‘র কিশ্তী স্বরূপ বলেছেন, অপরদিকে সাহাবায়ে কেরামকে হেদায়াত গগণের উজ্জ্বল নক্ষত্র বলেছেন।এই উম্মত আহলে বায়তের মুহাব্বতের তরণীতে আরোহন করবে আর হেদায়তের গগণের নক্ষত্র দেখে দেখে এই পার্থিব জীবনের সাগর পেরিয়ে মুক্তির ঘাটে অবতীর্ণ হবে।এটা ছাড়া এ উম্মতের জন্য আর কোন বিকল্প পথ বাকী নেই।তাই হুসাইনী ইসলাম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।এ ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র সুসংবাদও রয়েছে এ দল টিকে থাকার ব্যাপারে।আল্লাহর পক্ষ থেকে যুগে যুগে ইমাম হুসাইনের অনুসারীদেরকে প্রেরণ করা হবে।যাঁদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মাধ্যমে এই ইসলাম প্রচার-প্রসার হতে থাকবে এবং মানুষের অন্তর-এ আলো জ্বলতে থাকবে। এ কথা নয় যে, রাজনৈতিকভাবে এ দল প্রতিষ্ঠিত না হলে দুনিয়া থেকে বিলীন হয়ে যাবে। ইসলাম টিকে থাকার জন্য রাজনীতির মুখাপেক্ষী নয়।অবশ্য রাজনীতি আর একটি প্রচারের মাধ্যম মাত্র।এটা নয় যে, রাজনীতি না হলে এটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাধ্যমে ইসলামের প্রয়োজনীয় খেদমত হচ্ছে।আল্লাহ জাল্লা শানুহ মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফীক নছীব করুন।মুসলিম মিল্লাতের মধ্যেমে হুসাইনী জয্বা (চেতনা) প্রদান করুন; যাতে জিহাদের প্রেরণা নিয়ে মুনাফিক চক্র ইয়াজিদের দোসর, নামধারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইসলামের মূলধারাকে সমুন্নত রাখা যায় এবং ইসলামকে কালজয়ী শক্তি হিসেবে বিশ্বের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়।
লেখকঃ
ফকীহ,জামেয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া,চটগ্রাম।
এবং বিশিষ্ট ইসলামী দার্শনিক ও গবেষক।