দেওয়ান আজিজুর রহমান
যে কয়েকটি রাত্রি তাৎপর্যবহ ইবাদতের রাত্রি হিসেবে ইসলামী বিধানে অতি স্মরণীয় হয়ে আছে শবে ক্বদর তন্মধ্যে অন্যতম। শবে ক্বদরকে কোরআন মজীদে ‘খায়রুম্ মিন আল্ফি শাহ্র’ অর্থাৎ ‘হাজার মাস হতেও শ্রেষ্ঠ’ রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাত্রির মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন এই রাত্রিকে কল্যাণময় মহিমান্বিত রজনী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক মুসলিম মনীষী এ রাতকে সম্মানিত রাত্রি এবং ভাগ্য নিরূপণ বা নিয়ন্ত্রণ রজনী হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
এ রজনী মানুষ জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অধিক সম্মানিত। আসলে এ রাত আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত। কেননা, এ রজনীতে মানব জাতির মুক্তিসনদ তথা মহাগ্রন্থ আল্-কোরআন অবতীর্ণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার মধ্যে নিহীত রয়েছে মানুষের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ ও শান্তির নিশ্চয়তা। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন “রমজান মাস, যার মধ্যে কোরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এটি মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যা প্রার্থক্যকারী।
এ মহান রাত রমজান মাসের মধ্যে নিহিত থাকলেও ঠিক কোন তারিখে তা কোরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা নেই। তবে শবে ক্বদর রমজান মাসের শেষ দশ দিনের কোন এক বিজোড় তারিখে তা বিভিন্ন বর্ণনায় আভাস রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, হুজূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “শবে ক্বদর রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রজনীগুলোয় তালাশ কর।” -(বুখারী)
হযরত সূফিয়ান সওরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মতে শবে ক্বদর কোন নির্ধারিত তারিখ নয় বরং রমজানের শেষ দশকের রাত্রিগুলোর মধ্যে ঘুর্ণয়মান হতে থাকে। ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মতে একুশতম রজনীতে অর্থাৎ শেষ দশকের প্রথম রজনীতে। -(ফতহুল বারী)
আর ইমাম আবূ হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং জমহুর উলামার মতে রমজানের সাতাশের রাত্রিই শবে ক্বদরের রাত্রি। -(খাজায়েল আল্ কোরতবী, ২০ পৃষ্ঠা, রবহুল মায়াযী, ৩০ পৃষ্ঠা)
হযরত ইবনে কাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ়তার সাথে বলেছেন সাতাশের রজনীই শবে ক্বদরের রাত্রি। শবে ক্বদর সম্পর্কে বলা হয়েছে “ক্বদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম” এটার ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “আল্লাহ্ তা’আলা রাতগুলোকে শবে ক্বদর দ্বারাই সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন তোমরা ক্বদরের রাতে বেশি বেশি করে ইবাদত-বন্দেগী কর যেহেতু এটা সর্বশ্রেষ্ঠ রাত।”
হুজূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: “আল্লাহ্ পাক মানব জাতির সম্মুখে এ রাত্রিকে নির্দিষ্ট করে দেননি; যেন বান্দারা কেবল একটি নির্দিষ্ট রাতের ইবাদতকেই যথেষ্ট মনে না করে। বরং এই রাতকে ঘিরে সকলেই যেন বেশি করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে এবং প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা তার আমলনামায় হাজার মাসের ইবাদতের সাওয়াব প্রদান করেন।”
বস্তুতঃ আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন রমজানের শেষ দশকে অনেক ফযীলত রেখেছেন। রমজানের শেষ দশকে দোযখ থেকে নাজাতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। রোযাদার যেন এই দশ দিনে বেশি করে ইবাদত করে দোযখের ভয়াবহতা থেকে মুক্তির সন্ধান লাভ করতে পারে এবং সে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভসহ বেহেশতে প্রবেশের আশা রাখতে পারে।
এই দশ দিন রব্বুল আলামীন ই’তিকাফের যে বিধান দিয়েছেন, তা এই মুবারক রাত অর্জনের জন্য এক উত্তম পন্থা। মূলতঃ শেষ দশ দিন মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ রেখে শবে ক্বদর অন্বেষণ করাই হল ই’তিকাফের উদ্দেশ্য। আল্লাহ্ ছাড়া দুনিয়াবী সকল সংশ্রব থেকে বিরত থেকে নিজেদের দেহমনকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ’র ধ্যানে মগ্ন থাকা সম্ভব হয় এই দশ দিনের ইবাদতের মাধ্যমে। আসলে একজন মুসলমান যখন ই’তিকাফের মাধ্যমে সকল কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানে নিজেকে মশগুল রাখে তখন তার জন্য এই মুবারক রাত অন্বেষণ করা সম্ভব হয়।
মহান আল্লাহ্ পাক দয়াপরবশ হয়ে তাঁর বান্দাদের নাজাতের লক্ষ্যে তোহ্ফা স্বরূপ এই মর্যাদামণ্ডিত ও অধিক সাওয়াবপূর্ণ রাত এই শ্রেষ্ঠনবীর উম্মতকে দান করেছেন। আর এই রাতকে গোপন রেখেছেন যেন মানুষ আল্লাহর সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে অধিকতরভাবে আল্লাহমুখী হয়।
আসলে আল্লাহ্ তা’আলা এই রাতে তার বান্দাদেরকে বিশেষ অনুগ্রহ করতে চান। তিনি চান তার প্রতিটি বান্দা সেই সুযোগ গ্রহণ করুক। অর্থাৎ বান্দা তার অতীত গুনাহর কথা স্মরণ করে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলুক। অনুশোচনা করে তাওবা করুক এবং অতীত জীবনে সংগৃহীত অপকর্ম-কুকর্মগুলো ঝেড়ে মুছে নবজাত শিশুর মত পূত-পবিত্র হয়ে একমাত্র আল্লাহ্ ও আল্লাহ’র রসূলের নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলুক।
এতক্ষণে আমাদের আলোচনায় যে বিষয়গুলো বেড়িয়ে এসেছে তা হল রমজানের শেষ দশক হল খুবই গুরুত্বপূর্ণ দশক এবং এ দশকেই শবে ক্বদর বিদ্যমান। তবে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ২৭ রমজানকে যতখানি গুরুত্ব দেন অন্যদিনকে ততখানি গুরুত্ব দেন্ না। বস্তুতঃ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে শবে ক্বদরের লাভ পেতে হলে রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতকে সমপরিমাণ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
এই রাত ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনে পরীক্ষিত এক রাত। কাজেই প্রত্যেকেরই এই সৌভাগ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকা একান্ত অপরিহার্য। আসুন, আমরা প্রত্যেকেই মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে এ রাতকে তালাশ করি। কেউ যেন এ রাত থেকে বঞ্চিত না হই। আল্লাহ্ পাক আমাদের প্রত্যেককেই শবে ক্বদরের তাৎপর্য বুঝার ও সে মতে আমল করার তাওফীক্ব এনায়েত করুন; আ-মীন, বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরাসালিন।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.