আরবি হিজরির নবম মাস রমজান। ঈমাম বাগাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মতে রমজান শব্দটি আরবি রমদা শব্দ থেকে উদ্ভুত, অর্থ উত্তপ্ত পাথর।এছাড়া ও রমদা-এর আভিধানিক অর্থ দাহ, উত্তাপ, দহন, সূর্যের প্রখর তাপে উত্তপ্ত মাটি। আরববাসী তীব্র গরমের মৌসুমে রোজা রাখত। যে সময় আরবি মাসের নামকরণ শুরু হয় সে সময়ের ধারাবাহিকতায় মাসটি ভীষণ গরম থাকায় এর নামকরণ করা হয় রমজান।অন্য এক মতে রোজা, মানুষের গুনাহ সমূহকে জ্বালিয়ে দেয় তাই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করে এ মাসের নামকরণ করা হয় রমজান।
আরবিতে সওম বা সিয়াম যার অর্থ পানাহার পরিহার, রোজা, উপবাস, নিরবতা, মৌনতা ইত্যাদি। যেহেতু রমজান মাসে মানুষ ফজরের পূর্বে পানাহার (সাহরী) শেষ করে পর দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করে এবং পুনঃরায় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে উপবাস ভঙ্গ (ইফতার) করে। তাই একে সিয়াম সাধনার মাস ও বলা হয়।
কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত হলো ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভ। রোজা বা সিয়াম সাধনা ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি ফরয হয় হিজরি দ্বিতীয় বছর।
প্রবৃত্তি জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে রাখাতে সাফল্য আসে যেটা যুগে যুগে মহান আল্লাহ্র নৈকট্য প্রাপ্তগণ কঠোর সাধনার মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এই প্রবৃত্তি কখনো কখনো বিদ্রোহী হয়ে যায়, কখনো জ্ঞানের নির্দেশ মানে আবার কখনো মানে না। এই প্রবৃত্তি যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে তার জন্য কঠোর সাধনা প্রয়োজন। তাই প্রবৃত্তি দমনের জন্য মানুষ উপবাস করে, স্ত্রী সহচর্য ত্যাগ করে, মুখ, অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণে রেখে আত্মিক ব্যাধির চিকিৎসা করে। রোজার মাধ্যমে মানুষের পশু স্বভাব দুর্বল হয় এবং ফেরেশতা স্বভাব প্রবল হয়।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন-“হে ইমানদারগণ!তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে সংযমী হতে পার।“-সূরা বাকারা,আয়াত-১৮৩।
অন্য সব ইবাদত মানুষ দেখতে পায় কিন্তু রোজা এক আল্লাহ্ ব্যতিত কেউ দেখতে পায় না। রোজার দ্বারাই আল্লাহ্র খাঁটি মহব্বতের পরিচয় পাওয়া যায় এবং আল্লাহ্র প্রতি আন্তরিক ভক্তি ও ভয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। সেজন্য হাদিসে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেছেন “মানুষের সব আমল তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা শুধু আমার জন্য খাস”।
মানুষ যখন কোনো গুনাহ করে তখন তার মধ্যে খোদার মহব্বত ও ভয় কম হয়ে যায়। তাই রোজাদার ব্যক্তি যখন রোজা পালন করেন তখন তার মধ্যে খোদার ভয় পয়দা হয়। আর খোদার ভয়ের কারণেই বান্দা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আর গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাই দোযখ থেকে বেঁচে থাকা। সেজন্যই রোজাকে দোযখ বা আজাব থেকে বেঁচে থাকার ঢাল বলে।“রোজা দোযখের আজাব হতে রক্ষা করার জন্য একটি অতি শক্ত ঢাল এবং একটি অতি দৃঢ় প্রাচীর”-বায়হাকি।
রোজার সংযমের ফলে যেমন আত্মা শাসনে থাকে তাই পাপ কম হয় তেমনি শারীরিক রোগ থেকে ও রোজা আমাদের রক্ষা করে। কেননা অধিকাংশ রোগ পানাহারের দোষেই হয়ে থাকে। রোজার কারণে পানাহারের দোষ দূর হয় এবং অনেক রোগ হতে ও মুক্তি পাওয়া যায়।
আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক জিনিষেরই যাকাত আছে অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন জিনিষের যাকাত (পবিত্রতা) আদায় হয় বিভিন্নরূপে। আর শরীরের যাকাত (পবিত্রতা) সাধিত হয় রোজার দ্বারা।” এ হাদিস হতে আমরা এ কথা বুঝতে পারি যাকাত দ্বারা যেমন ধন সম্পদের ময়লা দূর হয় তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে আমাদের শরীরের সারা বছরের জমাট হওয়া দূষিত ময়লা দ্বারা যে রোগের জন্ম হয় তা দূর হয়।
এক হাদিসে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক জিনিষের একটি দরজা আছে। ইবাদতের দরজা হল রোজা। আরো বলা হয়েছে, রোজাদারের ঘুম হল ইবাদত।”
ঈমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “রোজার প্রাধান্য দুটি কারণে।
(১) রোজা রাখার অর্থ কয়েকটি বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং কয়েকটি বিষয় ত্যাগ করা। এটি অভ্যন্তরীণ কাজ। এতে এমন কোনো আমল নেই যা খালি চোখে দেখা যায়। অন্যান্য ইবাদত মানুষ চোখে দেখতে পায়। কিন্তু রোজা আল্লাহ্ ব্যতিত কেউ দেখে না।
(২) রোজা আল্লাহ্ তায়ালার দুশমনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রবল হয়। কেননা, কামনা বাসনা হচ্ছে শয়তানের হাতিয়ার যা পানাহারের মাধ্যমে প্রবল হয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে।” সুতরাং ক্ষুৎ-পিপাসার মাধ্যমে তার রাস্তাসমূহ সঙ্কীর্ণ করে দাও।এদিকে লক্ষ্য করে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা’কে বলেছিলেন, “সব সময় জান্নাতের দরজা নাড়া দাও। আরজ করা হল কিসের মাধ্যমে? তিনি বললেন, ক্ষুধার মাধ্যমে”। তাই যেহেতু রোজা শয়তানের চলার পথ সঙ্কুচিত করে তাই রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে বিশেষ ভাবে সম্পর্ক যুক্ত হওয়া যায়।রোজার আর একটি শিক্ষা হল সহমর্মিতা। আমরা যখন ক্ষুধা পেটে নিয়ে সারাদিন উপবাস করি তখন সেটাকে নিছক উপবাস হিসেবে না দেখে যদি এটা ভাবি, যেসব ভাগ্যাহত মানুষ, যাদের সারা বছর কাটে মাত্র এক বেলা খাবারের জন্য চিন্তা করে তার সঙ্গে আমাদের কতটুকু তফাৎ।
প্রথমেই মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ যে মহান আল্লাহ্ তাঁর অশেষ রহমতে আমাকে সে দলভুক্ত করেন নি। সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষ গুলোর জন্য মহান আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করা এবং যতটুকু সম্ভব তাদের সাহায্য করা। সামর্থ্য না থাকলে অন্তত তাদের সঙ্গে দূর্বব্যবহার না করা। নিজের যেমন ক্ষুধার জ্বালা আছে তেমনি অন্যের ও ক্ষুধার জ্বালা আছে এটা অনুভব করা। একটা চিত্র হর হামেশাই দেখা যায় যা রোজার শিক্ষার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ যেমন. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অধৈর্য হয়ে যাওয়া, রাস্তা ঘাটে কর্মস্থলে হুটহাট যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। এসব কোনো ভাবেই কাম্য নয়। এগুলো রোজার শিক্ষার সঙ্গেও মেলে না।
একটু চিন্তা করে দেখি, যে লোকটি সারা বছর দিনে মাত্র একবেলা খাবারের চিন্তায় থাকে তাও কখনো জোটে আবার কখনো জোটে না সেই মানুষটি মনের অবস্থা। অন্য জনের ক্ষুধার জ্বালা বুঝে ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, তাদের অবহেলা না করা এবং অন্যের কষ্ট অনুধাবন করে ধৈর্যের সঙ্গে কাম, ক্রোধ, পানাহার, ঝগড়া-বিবাদ হতে সংযমের নামই রোজা।
হযরত আবু হুরায়রা(র.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “রোজা (দোযখের আজাব হতে বাঁচাবার পক্ষে) ঢালস্বরূপ।(ঢাল দুর্বল হলে শত্রুর আক্রমণ হতে জীবন রক্ষা করা কঠিন। অতএব, প্রত্যেক মোমেনের কর্তব্য, যে সব কারণে রোজা দুর্বল হয় তা থেকে বিরত থাকা)। সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি গালি, গীবত ইত্যাদি কোনো খারাপ কথা মুখে উচ্চারণ করা হতে বা কোনো খারাপ কাজ করা হতে বিশেষ রূপে বিরত থাকবে। যদি কোনো ব্যক্তি তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ গালাগালি করে তবে (তার কর্তব্য হবে, কোনো প্রকার প্রতি উত্তর না করে নিজেকে পূর্ণ সংযমী রাখবে এই ভেবে যে আমি রোজাদার, আমি এরূপ কাজ বা কথার প্রতি উত্তর করতে পারি না; আবশ্যক বোধে ওই ব্যক্তিকে ক্ষান্ত করার জন্য মুখে হলে ও এটা) প্রকাশ করে দিবে যে, আমি রোজাদার (আমি ঝগড়ায় লিপ্ত হব না। প্রয়োজন হলে একাধিক বার এরূপ বলবে)।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “যে আল্লাহ্র হাতে আমার প্রাণ সে আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, রোজাদার ব্যক্তি না খেয়ে থাকার দরুণ তার মুখে যে বিকৃত গন্ধ সৃষ্টি হয় (মূল্য ও প্রতিদানের দিক দিয়ে) তা আল্লাহ্ তা’লার নিকট মেশক ও কস্তূরীর সুগন্ধি অপেক্ষা উত্তম গণ্য হবে।”
রোজাদারের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ ও তার প্রশংসা স্বরূপ আল্লাহ্ তা’লা বলে থাকেন সে আমার আদেশ পালনার্থে ও আমার সন্তুষ্টি লাভের আসায় স্বীয় খাদ্য, পানীয় ও কাম স্পৃহা পরিত্যাগ করেছে। সে মতে রোজা খাস আমার উদ্দেশে। সুতরাং আমিই (আমার মনঃপুত ও মনমতো) তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দিব।”
নেক আমলে প্রতিফল দানে সাধারণ নিয়ম এই রাখা হয়েছে যে, দশ গুন (হতে সত্তর গুন পর্যন্ত) দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু রোজার প্রতিদানের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যার নিয়ম রাখা হয় নি। রোজার জন্য রয়েছে আল্লাহ্ তা’লার এই ঘোষণা, রোজা আমার জন্য, উহার প্রতিদান আমি দেব। বোখারি শরীফ দ্বিতীয় খণ্ড-হাদিস নম্বর-৯৭২।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.