যাকাত না দিলে যা হবে

মুহাম্মদ মহিউদ্দীন

সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য,যিনি কিনা সমস্ত সৃষ্টিরাজির স্রষ্টা।অসংখ্য দরুদ ও সালাম তাঁরই প্রিয় হাবীব ও প্রথম সৃষ্টি নূর নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর প্রতি,যার অবদানে আজ আমরা একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হতে পেরেছি।ইসলাম ধর্ম হচ্ছে একটি শাশ্বত জীবন বিধান।এমন কোন বিষয় অবশিষ্ট নাই,যা কিনা এতে বিদ্যমান নাই।এই জীবন ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম হল যাকাত ব্যবস্থা।সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূলোৎপাটনে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম।ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত এর স্থান হলো পঞ্চম অবস্থানে।যাকাত আদায় যেমন নিজের সম্পদের পবিত্রতা নিশ্চিত করা পূর্বক অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ ,তেমনি যাকাত অনাদায়ে রয়েছে ভয়ংকর পরিণতি।এর ভয়ংকর পরিণতিগুলো জানার আগে আসুন প্রথমে সংক্ষেপে জেনে নিই যাকাত এর পরিচয় ও তার বিধান সম্পর্কে।

যাকাত এর পরিচয়

যাকাত এর পরিচয় প্রদানে বিশ্বখ্যাত ফেকাহ শাস্ত্রবিদ আল্লামা শামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি  বলেন,

শরিয়ত কতৃক একটি নির্ধারিত অংশ কোন ফকির বা গরিব মানুষকে মালিক বানিয়ে দেয়াকে যাকাত বলে।[১]

যাকাত এর বিধান

মহান রাব্বুল আলামীন কুর’আনে যাকাত সম্পর্কে সরাসরি ইঙ্গিত দিয়ে ইরশাদ করেন,

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ

নামায কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো।[২]

সর্বসম্মতভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিকের জন্য ইসলামে যাকাতের বিধান হচ্ছে ফরয।এর অস্বীকার,তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা ঠাট্টাকারী কাফের।যাকাত অনাদায়কারী ফাসিক ও কঠিন শাস্তির যোগ্য।

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক, যাকাত না দিলে কি হবে?

যাকাত না দিলে যা হবে

যাকাত আদায়কারীর জন্য যেমন রয়েছে ক্ষমা ও পরকালীন মর্যাদা,তেমনি এর অনাদায়কারীর জন্য রয়েছে চরম শাস্তি।কোর’আন এবং হাদীসের আলোকে আসুন জানি এ ব্যাপারে।

কুরআনের আলোকেঃ

মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর কালামে মাজীদে ইরশাদ করেন,

وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ – يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ-

আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। [৩]

হাদীসের আলোকেঃ

  • আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত,রাসূলে পূরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেন,

যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করেনঃ

“আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথছ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং উহা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরে কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃংখলাবদ্ধ করা হবে। ” (৩:১৮০) [৪]

  • হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত,রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেন,

যে ব্যক্তি তার মালের যাকাত আদায় না করে,তার মালকে কিয়ামতের দিন বিষধর সাপের আকৃতিতে পরিণত করা হবে,এমনকি তার গলায় তা লটকিয়ে দেয়া হবে।এরপর হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এ প্রসঙ্গে কুর’আনের নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করেন,

“আর আল্লাহর নিজ অনুগ্রহে তোমাদের যা দিয়েছেন,এতে যারা কৃপণতা করে,তাদের জন্য তা মঙ্গল একথা যেন তারা মনে না করে।(৩:১৮০)” [৫]

তাছাড়া যাকাত অনাদায়কারীর ব্যাপারে তিরমিযী শরীফে একটি লম্বা হাদীস উল্লেখ আছে,হাদীসটি হলো

  • হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত।তিনি বলেন,

আমি একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাজির হলাম, এই সময় তিনি কা’বা শরীফের ছায়ায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি আমাকে সামনে দেখে বলতে লাগলেনঃ কাবা’র রবের কসম! কিয়ামতের দিন এরাই হবে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত। আবূ যার্ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন , আমি মনে মনে ভাবলাম, কী হল আমার , আমার ব্যাপারে হয়ত কিছু নাযিল হয়েছে। যা হোক আমি আরয করলাম, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হউক, এরা কারা ? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেনঃ এরা হল অধিক সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিগণ, কিন্তু যারা এরূপ করে তারা ছাড়া এরপর তিনি সামনে ডানে বামে দুই হাত মুবারকের অঞ্জলী ভরে ইশারা করে দেখালেন।তিনি আরো ইরশাদ করলেনঃ কসম সে সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ! কোন ব্যক্তি যদি উট বা গরু রেখে মারা যায় আর এগুলোর যাকাত আদায় না করে যায় তবে সেগুলো কিয়ামতের দিন আরো বেশী মোটা-তাজা হয়ে আসবে এবং ঐ ব্যক্তিকে পায়ের খুরে দলিত করবে এবং শিং দিয়ে গুতোতে থাকবে। যখনই শেষেরটির কাজ শেষ হবে,তখনই প্রথমটি আবার শুরু করবে। সব মানুষের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরূপই চলতে থাকবে। এই বিষয়ে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। আলী ইবনু আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, যাকাত অস্বীকারকরীকে লা’‘নত করা হয়েছে। কাবীসা ইবনু হুলব তদীয় পিতা হুলবের বরাতে এবং জাবির ইবনু আবদুল্লাহ ও আবদুল্লাহ ইবনু মাসুদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আবূ যার্‌ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণিত হাদিসটি হাসান-সহীহ আবূ যার্ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর নাম হল, জুনদাব ইবনুস সাকান। কেই কেউ বলেন, ইবনু জুনাদা। আবদুল্লাহ্ ইবনু মুনীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি যাহ্হাক ইবনু মুযাহিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, অধিক সম্পদশালী হল তারা যাদের কাছে দশ হাজার (বা তকোধিক দিরহাম) আছে। আবদুল্লাহ্ ইবনু মুনীর মারওয়াযী একজন সৎব্যক্তি।[৬]

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাঁর হাবীবে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র অসিলায় সময়মত যাকাত দেয়ার তাওফিক দান করুন এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি হতে নাজাত দান করুন।আমিন, বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন।

 

যেখান থেকে পেয়েছিঃ

  • ১- ফাতওয়ায়ে শামী,৩য়, ১৭১ পৃষ্ঠা।
  • ২- আল-কোর’আন,সূরা বাকারা,আয়াত-৪৩।
  • ৩- আল-কোর’আন,সূরা তাওবা,৩৪-৩৫।
  • ৪- সহীহ বুখারী,হাদীস শরীফ-১৩২১।
  • ৫- সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদিস শরীফ-১৭৮।
  • ৬- জামে তিরমিযী,হাদীস শরীফ-৬১৫।

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

2 comments

  1. আলোচনাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো, নিজেকে অনেক উকৃতবোধ মনে হচ্ছে এখন। আলোচনাটি শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

  2. Mohammad delwar hossain

    আসসালামু আলাইকুম পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় সালাত কায়েম করার কথা বলা হয়েছে ,যাকাত আদায় করার কথা বলা হয়েছে, আমরা নিজেরাও সালাত আদায় করছি বা অন্যদের ও সালাত আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহ উদ্দীপনা করে যাচ্ছি, আলেম সম্প্রদায় থেকে শুরু করে সমস্ত মাযহাব পন্থী সালাত কি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে থাকে অথচ পবিত্র কুরআনে সালাত কায়েম এর বৈশিষ্ট্য বা দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়নি, সালাত আদায় কারী বা সালাত প্রতিষ্ঠা করে সমাজের কল্যাণ বা পরকালের মুক্তির দিশারী হিসাবে আল্লাহতালা এর ফজিলত প্রদান করবেন তা খুব একটা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেননি কিন্তু পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় আমি দেখতে পেয়েছি সৎকর্মশীল জীবন-যাপন আল্লাহতে সমর্পিত ও নৈকট্য লাভের জন্য অসহায় দরিদ্র এতিম মুসাফিরদের দানের কথাই সর্বাঙ্গে প্রকাশ করেছেন, হতে পারে সম্পদের কিছু অংশ অথবা সম্পদের ব্যবহারের অতিরিক্ত অংশ দান ও যাকাতের কথ কোরআনে উল্লেখ করেছেন কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা সালাত আদায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে দেখি দান বা যাকাত প্রসঙ্গে আলেম সম্প্রদায় বা ইসলামিক স্কলারদের প্রচারণা অত্যন্ত দুর্বল .এর কারণ জানতে ইচ্ছে করে. মানুষের কল্যাণ মানবতার প্রতিষ্ঠিত দারিদ্র্য বিমোচনে আল্লাহকে কর্জে হাসানা প্রদান যা বিভিন্ন আয়াত সমূহ উল্লেখ করা হয়েছে এবং আমি খুব মুগ্ধ চিত্রে পবিত্র কোরআনের বাংলা মর্মবাণী বা তাফসীর পাঠ করেছি, আমার প্রশ্ন হচ্ছে সালাতের গুরুত্ব এত বেশি প্রকাশ করা হয় প্রচার করা হয় কিন্তু জাকাত হজ রোজা বা অন্যান্য কল্যাণমূলক ইবাদত গুলির গুরুত্ব পবিত্র কোরআনে বিধিবিধান আকারে আল্লাহতালা ইসলামের মাধ্যমে নাযিল করেছেন তা প্রচার করা হয় না কেন এই বদান্যতার কারণ কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading