বিশ হাদীসের আলোকে বিশ রাক’আত তারাবীহ

মূলঃ ফকীহে মিল্লাত আল্লামা ইউসুফ শরীফ কুটলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান    ওয়েব সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ মহিউদ্দীন

 

তারাবীহ’র পুরস্কার

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

যে ব্যক্তি ঈমান ও  পূন্য লাভের আশায় রমজানের রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করবে, ( আল্লাহ তা’আলা) তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।

হাফেজ ইবনে হাজর আসকালানী ফাতহুল বারী’ তে  ইমাম নাসাঈ এর উদ্ধৃতিতে এবং ইমাম আহমদ ও প্রমুখ  এই হাদীসে “وما تأخر” যোগ করেন । অর্থাৎ তারাবীহ আদায়ের ফলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ সমূহ মাফ করে দেওয়া হয় ।

হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান সম্পর্কে বলেন এবং অন্যান্য মাস হতে একে অধিক মর্যাদাবান ঘোষণা করেন। এবং ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমযানের রাতসমূহে ঈমান এবং সাওয়াব অন্বেষনের জন্য কিয়াম করে (তারাবীহ পড়ে)  , সে তার গুনাহ সমূহ হতে এমনভাবে মুক্ত হয় অর্থাৎ গুনাহ হতে পবিত্র হয়ে যায়। অর্থাৎ সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে,যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল ।

এর মানে হল – মানুষ যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় স্বীয় মায়ের গর্ভ হতে জন্ম নেয় তেমনি ঐ ব্যক্তি নিষ্পাপ মানুষে পরিণত হবে।

তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ

জেনে রাখা ভালো যে, রমজান মাসে ইশার নামাজের পর শোবার পূর্বে যে নামাজ আদায় করা হয় তাকে তারাবীহ বলে। আর ঘুম থেকে উঠে যে নফল নামাজ আদায় করা হয় তাকে তাহাজ্জুদ। হোক সেটা রমজান বা অন্য কোন মাসে ।

  • প্রথম হাদীসঃ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,

নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে বিতর ব্যতীত বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করতেন ।

হাদীসটি আবদ বিন হুমায়দ তার মুসনাদে, ইমাম তাবরানী তার মু’জামে (কবীর ও আওসাত) এবং ইমাম বায়হাক্বী তার সুনানে বর্ণনা করেন । এই হাদীস বিশ রাক’আত তারাবীহ যে সুন্নাত, তা প্রমাণ করে ।

  • দ্বিতীয় হাদীসঃ

হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

আমরা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে বিশ রাক’আত তারাবীহ ও বিতর আদায় করতাম ।

এই হাদীসে  হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় আমল বিশ রাক’আত তারাবীহ হিসেবে বর্ণনা করেন । এই হাদীসের সনদকে ইমাম সুবুকী শরহে মিনহাজে সহীহ বলেছেন, মোল্লা আলী ক্বারী তাঁর শরহে মুয়াত্তায় একে সহীহ বলেন ।

এই হাদিসকে হযরত মালিক ইয়াযিদ ইবনে কুসায়ফাহ হতে বর্ণনা করেন । আর ফাতহুল বারীতে বর্ণিত হাদীস হয় সহীহ নতুবা হাসান হয়ে থাকে, যে ব্যাপারে ঐ কিতাবের সূচনায় বলা হয়েছে ।

  • তৃতীয়হাদীসঃ

হযরত ইয়াযিদ ইবনে রুমান রহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত,

হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যামানায় লোকজন (সাহাবা ও তাবেয়ীন রাদিয়াল্লাহু আনহুম) তারাবীহ ও বিতর সহ ২৩ রাক’আত (২০ রাক’আত তারাবীহ ও ৩ রাক’আত বিতর) পড়তেন আর তা রমজান মাসে ।

  • চতুর্থ হাদীসঃ

হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন যে ,

নিশ্চয় হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে সকল লোকদের নিয়ে বিশ রাকা’ত তারাবীহ নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন ।

হাদীসটিতে বিশ রাকা’ত তারাবীহর ব্যাপারে হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আদেশও বিদ্যমান আছে । এই হাদীসের প্রত্যেক রাবী নির্ভরযোগ্য।

  • পঞ্চম হাদীসঃ

হযরত মুহাম্মদ বিন কা’ব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যামানায় লোকজন (সাহাবা ও তাবেয়ীন রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বিশ রাকা’ত তারাবীহ আদায় করতেন । আর তাতে দীর্ঘ ক্বিরাত হত এবং (তারপর) তিন রাক’আত বিতরও আদায় করতেন ।

 

  • ষষ্ঠ হাদীসঃ

হাফেজ ইবনে হাজর আসকালানী তার তালখীস কিতাবে, ইমাম সূয়ুতী মাসাবীহ কিতাবে, বায়হাক্বী ও ইবনে আবী শায়বার উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন,

হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু রমজানে লোকদের একত্রিত করে উবাই বিন কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে বিশ রাকা’ত তারাবীহ পড়াতেন । ইবনে আব্দুল বার বলেন, উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিশ রাক’আত তারাবীহর বর্ণনাই বিশুদ্ধ ।১০

ইবনে তাইয়্যিমাও হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বিশ তারাবীহ পড়ানোর ব্যাপারে একই মত পোষণ করেছে ।১১

  • সপ্তম হাদীসঃ

ইবনে আবী শায়বাহ স্বীয় মুসান্নাফে তাবেঈ আব্দুল আযীয বিন রফী হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন ,

হযরত উবাই ইবনে কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রমযান মাসে মদীনা শরীফ-এ মাসে বিশ রাক’আত তারাবীহ এবং তিন রাক’আত বিতর পড়াতেন। ১২

  • অষ্টম হাদীসঃ

শাইখুল ইসলাম আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইবনে আব্দুল বার রহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণনা উপস্থাপন করেন যে,

সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে কিয়াম (তারাবীহ) বিশ রাকা’আত ছিল ।১৩

  • নবম হাদীসঃ

শাইখুল ইসলাম আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইমাম আব্দুর রাযযাক তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেন,

হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু লোকদেরকে রমজান মাসে  হযরত উবাই বিন কা’ব এবং তামীম আদ দারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার নেতৃত্বে ২১ রাকা’আত(বিতর সহ) তারাবীহ আদায়ে একত্রিত করেছেন ।১৪

ইবনে আব্দুল বার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে,এক রাক’আত বিতর হিসেবে। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দেখুন আমার অন্য রিসালা “কিতাবুল বিতর”) এই হাদীস শরীফ দ্বারা এও বুঝা গেল যে,হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায়ে লোকদেরকে একত্রিত করেছেন। ইবনে আব্দুল বার হাদীসটিকে ২৩ রাক’আতের বিরোধী বলেন এবং তা সহীহ বলেন ।১৫

  • দশম হাদীসঃ

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে রমযানের রাত্রিতে তারাবীহ পড়াতে নির্দেশ দিলেন। ( তিনি বলেন ) লোকেরা দিনের বেলায় রোযা রাখার কারণে ভালভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না। তুমি তাদেরকে নিয়ে রাতে কুরআন তিলাওয়াত করলে ভাল হয়।( তখন) উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরয করলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! এ পদ্ধতি তো ইতিপূর্বে ছিল না। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন তা তো আমি জানি, কিন্তু এটা তো একটা উত্তম আমল। এরপর হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে বিশ রাকা’ত পড়ালেন । কানযুল উম্মাল গ্রন্থকার অত্র হাদীসের ব্যাপারে নিরবতা প্রদর্শন করেছেন।১৬

এই দশটি হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবা ও তাবেয়ীনে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমগণ হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যামানায় বিশ রাকা’ত আদায় করতেন । বরঞ্চ চতুর্থ হাদীসে তো তা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিশ রাক’আতের তারাবীহ পড়ার আদেশ দিয়েছেন। সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন ব্যক্তি কখনোই একথা মানবে না যে, হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যামানায় যে সকল সাহাবা-তাবেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহুমগণ ছিলেন, তাঁরা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর নির্দেশ ছাড়াই বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করেছেন। আর এ ব্যাপারে তিনি জানতেন না। নিঃসন্দেহে তিনি জানতেন।এজন্যই তিনি তাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি বরং তা জামা’আতে রুপান্তর করেন । আর এমনও না যে সাহাবা-তাবেঈগণ রাদিয়াল্লাহু আনহুম এ নামাজ (বিশ রাকা’ত তারাবীহ) নফল হিসেবে আদায় করছিলেন। যদি এমন হত তাহলে অবশ্যই ২০ রাক’আতের সংখ্যায় তারতম্য থাকত। প্রত্যহ বিশ রাকা’ত আদায় নফল হতে পারে না।বিশ রাক’আতে নির্দিষ্ট করায় তা ঐ দিকে ইঙ্গিত করে যে, সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম বিশ রাক’আতের ব্যাপারে সরকারে দো আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে নির্দেশনা পেয়েছেন ।

 

  • এগারো তম হাদীসঃ

রমজান মাসে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ক্বারীদের ডাকতেন। অতঃপর তাদের মধ্য হতে একজনকে ইমাম বানিয়ে বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায়ের নির্দেশ দিতেন। আর স্বয়ং আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজে তারাবীহ’র পর বিতর পড়াতেন । ১৭

এই হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যামানায়ও লোকজন তাঁর আদেশে বিশ রাকা’আত তারাবীহর পড়তেন । এ হাদীস অন্য সনদেও বর্ণিত হয়, তা নিম্নে প্রদত্ত হল।

  • বারতম হাদীসঃ

হযরত আবুল হাসানা রহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত,

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে ডেকে লোকদেরকে পাঁচ তারাবীহ তথা বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়াতে নির্দেশ দিলেন। ১৮ 

এই হাদীসটি আরও একটি সনদে বর্ণিত হয়েছে, তা হল –

  • তেরতম হাদীসঃ

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একজন ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যে,রমযান মাসে লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করতে।১৯

এই তিনটি বর্ণনা একে অপরকে শক্তিশালী করেছে।

  •  চৌদ্দতমহাদীসঃ

আল্লামা আইনী তাঁর সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে কিয়ামুল লাইল মারুযী’র উদ্ধৃতিতে বর্ণনা আনেন, যায়েদ বিন ওহাব বর্ণনা করেন,

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে রমযান মাসে নামায পড়াতেন এবং বের হয়ে যেতেন। (কিন্তু) তারপরও রাত বাকী থাকত । আ’মাশ বর্ণনা করেন, তিনি বিশ রাক’আত তারাবীহ এবং তিন রাক’আত বিতর পড়াতেন ।২০

এই হাদীস দ্বারা ফকীহকূল সম্রাট হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু  কর্তৃক বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়ানোও প্রমাণিত হয়।

  • পনেরতম হাদীসঃ

বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে আবী রিবাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,আমি সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম’দেরকে ২৩ রাক’আত তারাবীহ বিতর সহকারে পড়াতে দেখেছি।২১

ইমাম নববী এই হাদীসের সনদকে হাসান বলেছেন । এই হাদীসটি মারুযী তাঁর কিয়ামুল লাইল পৃষ্ঠা ৯১ তে বর্ণনা করেন ।সুতরাং জানা গেল যে,সাহাবা কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়তেন ।

  • ষোলতম হাদীসঃ

ইমাম বায়হাক্বী তার সুনানে বর্ণনা করেন যে,

আবুল খুসাইব বলেন – তাবেয়ী সুওয়াইদ বিন গাফলাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি রমজান শরীফে আমাদের সামনে নামাযে ইমামতি করতেন।তিনি আমাদেরকে বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়াতেন ।২২ 

সুওয়াইদ বিন গাফলাহ শীর্ষস্থানীয় সম্মানিত তাবেয়ী ছিলেন, এমনকি ইবনে কা’নিয় তাকে সাহাবীও বলেন।২৩  যেদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে দাফন করা হয় সেদিন তিনি মদীনায় আসেন।২৪  অথবা ৮১ হিজরীতে তিনি ১২৩ বছর বয়সে ওফাত লাভ করেন । তিনি চার খলীফার শাসনামল প্রত্যক্ষ করেন এবং তাদের থেকে হাদীস গ্রহণ করেন ।২৫  এমন একজন শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ী বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করেছেন । বিবেকবান ব্যক্তি কি তা মেনে নিবেন যে, তাঁদের নিকট বিশ রাক’আত তারাবীহর কোন দলীল ছিল না ! এ কথাটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন । এই হাদীসের সনদ হাসান । আসারুস সুনান,তাহযীবুত তাহযীব পৃষ্ঠা – ২৭৮,খন্ড – ৪ এবং তাযকীরাতুল হুফ্‌ফায ২য় খন্ড পৃষ্ঠা – ১৬ এর মধ্যে হযরত সুয়াইদকে উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার দ্বারা বুঝা গেল যে, হযরত সুয়াইদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করাটা উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এসেছে।

  • সতেরতম হাদীসঃ

ইবনে আবী শায়বাহ তার মুসান্নাফে বর্ণনা করেন,

তব তাবেয়ী নাফে ইবনে উমর রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন – তাবেয়ী হযরত ইবনে আবী মুলাইকাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাদেরকে রমযান মাসে বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়াতেন ।এই হাদীসটি সহীহ ।২৫

হযরত ইবনে আবী মুলাইকাহ রহমতুল্লাহি এমন শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ী ছিলেন, যিনি কিনা ৩০ জন সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম বরঞ্চ (“তাহযীব” গ্রন্থের মধ্যে আছে) তিনি ৮০ জন সাহবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে তাঁর জীবদ্দশায় দেখেছেন । যদি সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম দের মাঝে ২০ রাক’আত তারাবীহ এর প্রচলন না থাকতো,তাহলে তিনি তাবেয়ী হয়ে কেন বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়তেন ? অতঃপর বুঝা গেল যে,সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর যুগেও বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করা হত।এবং এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে,রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর সুন্নাত পালনে উনারা আমাদের চাইতে অধিক অগ্রগামী ছিলেন। যদি বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়া সুন্নাত প্রমাণিত না হতো,তবে তাঁরা কখনোই বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়তেন না।  অর্থাৎ বিশ রাক’আত তারাবীহ পড়া সুন্নাত।

  • আঠারোতম হাদীসঃ

তব তাবেয়ী সাঈদ ইবনে উবায়দ রহমাতুলাহি আলাইহি বর্ণনা করেন,

নিশ্চয় তাবেয়ী হযরত আলী ইবনে রবীয়াহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি রমযান মাসে আমাদেরকে নিয়ে পাঁচ তারাবীহ তথা বিশ রাক’আত তারাবীহ ও তিন রাক’আত বিতর নামায পড়তেন ।হাদীসটি ইবনে আবী শায়বা ফযল বিন ওয়াকিন হতে তিনি সাঈদ ইবনে উবায়েদ হতে বর্ণনা করেন।হাদীসটির সনদ সহীহ।২৬

  • উনিশতম হাদীসঃ

আব্দুল্লাহ বিন কায়স রহমাতুলাহি আলাইহি বর্ণনা করেন,

তাবেয়ী শুতাইর বিন শেকাল (যিনি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথী ছিলেন) রমযান মাসে বিশ রাক’আত তারাবীহ ও বিতর পড়াতেন । হাদীসটি আবু বকর বিন শায়বা বর্ণনা করেন।২৭

  • বিশতম হাদীসঃ

তাবেয়ী হযরত আবু বুহতারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রমজান শরীফে পাঁচ তারবীহ অর্থাৎ বিশ রাক’আত তারাবীহ ও তিন রাক’আত বিতর নামায পড়তেন । হাদীসটি ইবনে আবী শায়বা বর্ণনা করেছেন।হাদীসটির সনদ রদমূক্ত।২৮

উপরে বর্ণিত দলীল সমূহ ও সালফে সালেহীনদের আমল হতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবা কেরাম  এবং তাবেয়ীনে কিরামগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম সহ তৎকালীন সর্বসাধারণ সকলেই বিশ রাক’আত তারাবীহ আদায় করতেন। তখন  আট রাক’আত তারাবীহ এর উপর কোন আমলই ছিল না । ইমাম তিরমিযি রহমাতুল্লাহি আলাইহি; যিনি  হাদীস শাস্ত্রের মধ্যে মাযহাব বিষয়ক বর্ণনায় বিশেষ অবদান রাখেন, তিনিও আট রাক’আত তারাবীহ’র ব্যাপারে কোন মত উল্লেখ করেননি।

অতঃপর প্রমাণিত হলো যে, মুহাদ্দেসীনদের সময়েও আট রাক’আত তারাবীহ এর ব্যাপারে কোন মতামত ছিল না। থাকলে ইমাম তিরমিযি তা অবশ্যই বর্ণনা করতেন ।

[ ইমাম তিরমিযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন –  আলেমগণের আমল ওটার উপর, যা হযরত আলী, উমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে অর্থাৎ বিশ রাক’আত । এটাই হযরত সুফিয়ান সওরী, ইবনে মুবারক এবং ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহিম এর অভিমত । ইমাম শাফেয়ী স্বীয় শহর পবিত্র মক্কায় এরই অনুশীলন দেখতে পান অর্থাৎ সেখানকার মুসলমানেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন ।২৯ – অনুবাদক ]

 

আলহামদুলিল্লাহ ! সমাপ্ত

  • >>। তথ্যসূত্রঃ
[১] বুখারী ও মুসলিম শরীফ।

[২] ইবনে মাজাহ শরীফ।

[৩] মুসান্নাফে আবী শায়বাহ, হাদীস-৭৬৯২ ।

[৪] মা’রেফাতুস সুনানি ওয়াল আছার – ৫৪০৯ ।

[৫] আসারুস সুনান,পৃষ্ঠা-৫৫ ।

[৬] ফাতহুল বারী,  ৮ম খন্ড, ৫৫ পৃষ্ঠা।

[৭] হাদীসটি ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মুয়াত্তায় [হাদীস নং-৩৮০] ও ইমাম বায়হাক্বী তাঁর সুনানে কুবরায় বর্ণনা করেন ।

[৮] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ – ৭৬৮২।

[৯] কিয়ামুল লাইল মারুযী ৯১ পৃষ্ঠা। বলা হয় হাদীসটি মুনকাতি । কিন্তু অধিকাংশ  মুহাদ্দিসে কেরামের মতে এই প্রকার হাদীস দলীল হিসেবেও আসবে । বিশেষ করে যতক্ষন না হাদীসটিকে অন্য হাদীস দ্বারা সংশোধন করা না হয় ।

[১০] আল ইস্তিযকার, খন্ড-২,পৃষ্ঠা-৭০।

[১১] মাজমাউল ফাতাওয়া, ২৩:১১২।

[১২] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ-৭৬৮৪। বলা হয় এটা মুনকাতি, আমার মতে মুনকাতি হাদীসও শরীয়তের দলীল হিসেবে আনা যায়।

[১৩] উমদাতুল ক্বারী ,খন্ড-৫,পৃষ্ঠা- ৩৫৭।

[১৪] উমদাদুল কারী, খন্ড-৫,পৃষ্ঠা- ৩৫৭।

[১৫] প্রাগুপ্ত।

[১৬] আসারুস সুনান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৭ এবং কানযুল উম্মাল-২৩৪৭১ ।

[১৭] বায়হাক্বী আস সুনানুল কুবরা, খন্ড- ২,পৃষ্ঠা- ৬৯৯ হাদীস নং-৪২৯১, ইবনে তাইয়্যিমাহ, মিনহাজুস সুন্নাহ খন্ড ৮,পৃষ্ঠা-৩০৮।
[১৮] বায়হাক্বী আস সুনানুল কুবরা, খন্ড – ২, পৃষ্ঠা-৬৯৯, হাদীস নং- ৪২৯২।
[১৯] আল্লামা আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাদুল ক্বারী’ র খন্ড-৩,পৃষ্ঠা- ৫৯৮ এর মধ্যে মুগনী এর উদ্ধৃতিতে এই হাদীস উল্লেখ করেন ।
[২০] উমদাদুল ক্বারী,খন্ড-৫,পৃষ্ঠা-৩৫৭।
[২১] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ-৭৬৮৮।
[২২] আস সুনানুল কুবরা, খন্ড-২,পৃষ্ঠা-৬৯৯, হাদীস- ৪২৯০] [২৩] তাহযীবুত তাহযীব
[২৪] তাক্বরীব।
[২৫] তাহযিব।
[২৫] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ-৭৬৮৩।
[২৬] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ-৭৬৯০] [২৭] মুসান্নাফে আবী শায়বাহ-৭৬৮০] [২৮] মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ-৭৬৮৬।
[২৯] সুনানে তিরমিযি-৮০৬, ৩:১৬০

 

 


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

রোজার শারিরিক ও মানসিক উপকারীতা

মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান অনেক মুসলমানই  স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে রোজা রাখেন না,অথচ কুরআনে কারীমে রোজা রাখার ব্যাপারে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading