বংশ-পরিচয়, শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ
উপমহাদেশের যে কয়েকজন আলেমে দ্বীন তাদের সূতীক্ষ্ণ মেধায়, নিরলস অধ্যাবসা ও সুউচ্চ যোগ্যতার মাধ্যমে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র আরব জগতকেও মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকার্রমের সর্বপ্রথম খতীব (১৯৬৪-১৯৭৪) মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি। তিনি ছিলেন একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ (ইসলামী গবেষক) ও মুফতী । ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু উচ্চ মানসম্পন্ন গ্রন্থাবলীর রচয়িতা ও সংকলক ছিলেন তিনি।
জন্মঃ
হযরত মুফতী সাহেব রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারী (১৩২৯ হিজরী ২২ মুহাররম) রোজ সোমবার বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা নামক গ্রামে শুভ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাকিম আবদুল মান্নান রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি এবং মা সৈয়দা সাজেদা রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহা। তিনি চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। পিতা ও মাতা উভয় সূত্রেই তিনি (নাজিবুত্তারাফাইন)। জন্মের পর মুফতী সাহেবের নাম রাখা হয় ‘ মুহাম্মাদ ’ এবং লকব আমীমুল ইহসান । স্বয়ং মুফতী সাহেব রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি বলেন, ‘‘আমার চাচা মাওলানা সাইয়্যেদ আবদুদ দাইয়ান রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি আমাকে বলিয়াছেন যে, আমার দাদী সাহেবা আমার জন্মের কয়েক মাস পূর্বে এক মুবারক স্বপ্ন দেখেন, যাহাতে আমার লকব আমীমুল ইহসান রাখিবার জন্য সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছিল।’’‘আত-তাশাররূফ লি আল-আদাবিত তাসাওউফ’ গ্রন্থে হযরত মুফতী সাহেব নিজেই উক্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁহার চাচাও অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁহার পরবর্তী জীবনের প্রতিটি স্তরেই এই সুসংবাদপ্রাপ্ত নাম সার্থক প্রমাণিত হইয়াছিল। আল্লামা মুফতী সাহেবের দাদা সাইয়্যেদ নূরুল হাফেয আল-কাদেরী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি একজন কামেল সাধক ছিলেন। তিনি কুরআন করীমে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল-কাদেরী আল মোজাদ্দেদী আল মুংগেরীর রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি’র একজন খলীফা ছিলেন।
বংশ পরিচয়ঃ
মহান চরিত্রের অধিকারী হযরত আল্লামা মুফতী সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে নিজ বংশ-পরিচয় রেখে গিয়েছেন। এর মাধ্যমে এবং তার নসবনামা থেকে যতদূর জানা যায় কারবালার শোকাবহ ঘটনার পর আহলে বাইতের সদস্যরা বিশেষ করে সাইয়্যেদ ইমাম হোসাইন এর একমাত্র পুত্র যিনি কারবালার যুদ্ধে অসুস্থ থাকার কারনে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারেন নি এবং জীবিত বেচে যান ইমাম যয়নুল আবেদিন রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু। সেই ইমাম যয়নুল আবেদিন এর সন্তানদের অনেকেই ইয়ামানে বসবাস শুরু করেন। তাদেরই সেই সাইয়্যেদ বংশের কোনো বুজুর্গ ব্যক্তি হিন্দুস্তানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তাঁদের বংশধারাতেই হযরত আল্লামা মুফতী সাহেবের পূর্বপুরুষগণ জন্মগ্রহণ করেন। ‘আত তাশাররুফ লি আল-আদাবিত তাসাওউফ নামের প্রসিদ্ধ তাসাওফ শাস্ত্রের একটি আরবি গ্রন্থে তিনি স্বয়ং তাঁর বংশ পরিচয় উল্লেখ করেছেন। তাঁর বংশ-তালিকা বা নসবনামা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা বিনতে সাইয়েদুল মুরসালিন ওয়ান নবীঈন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই কারণে তাঁর পূর্ব-পুরুষগণ নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন।
শিক্ষাজীবনঃ
মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি তাঁর পিতা ও চাচার নিকট থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে তাঁর চাচা সাইয়্যেদ আব্দুদ দাইয়্যানের রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি নিকট হতে পূর্ণ ত্রিশ পারা কুরআন খতম করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর (সুবহানাল্লাহ !)। তাঁর শ্রদ্ধেয় চাচা সাইয়্যেদ আবদুদ দাইয়ান সাহেব তাঁকে ফার্সি ভাষায় বিশেষ জ্ঞান দান করেন। পাঞ্জাবের মহান সাধক সাইয়্যেদ আল্লাহ ইয়ার শাহ্ কাদেরীর রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি (ওফাত- ১১৫৩ হি.) বংশধর হযরত সাইয়্যেদ আবু মুহাম্মাদ বারকত আলী শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি কলকাতায় বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মোহাদ্দেস, ফকীহ, সূফী ও আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ জ্ঞানের অধিকারী। মুফতী সাহেবের শিক্ষার প্রতি এমন অদম্য স্পৃহা দেখে তাঁর পিতা তাকে সাইয়্যেদ বারাকাত আলী শাহ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি এর দরবারে নিয়ে যান। শাহ সাহেব নিজ ভক্ত মুরীদদের সাথে আসা শিশু আমীমুল ইহসান কে দেখে মুগ্ধ হন। মাত্র দু বছরের ব্যবধানে মুফতী সাহেব হযরত বারকাত আলী শাহ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি এর নিকট থেকে আরবী ব্যাকরণের (মীজান-মুন্শায়েব) প্রাথমিক জ্ঞান রপ্ত করেন এবং পাশাপাশি উচ্চতর ফার্সী সাহিত্য ও তাজবীদের প্রাথমিক জ্ঞান গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মুফতী সাহেব রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি হযরত শাহ বারকাত আলী শাহ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি-এর মুরীদ হন। তাই মুফতী সাহেব নিজের নামের শেষে ‘বারকাতী’ কথাটি যুক্ত করেন।মাত্র দশ বৎসর বয়সে তিনি তাঁর ভাবী শ্বশুর উক্ত আল্লাহর ওলী হযরত সাইয়্যেদ বারকাত আলী শাহ নিকট কুরআন মাজীদের অনুবাদ, সূফী মতবাদ সম্পর্কিত পুস্তক-পুস্তিকা, ইলমে সরফ, তফসীর, হুসনে হাসিন ও ফার্সি সাহিত্যের উচ্চতর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন।
উচ্চশিক্ষাঃ
১৯২৬ সালে পনের বছর বয়সে মুফতী সাহেব কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ফাযিল ও ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদীস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং “মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন” উপাধি প্রাপ্ত হন তিনি আলিম পরীক্ষায়ও হাদীস বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মাওলানা মুফতী মুশতাক আহমেদ কানপুরী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি সাহেব এর নিকট থেকে ‘মুফতী’ সনদ লাভ করেন। তখন থেকে তিনি ‘মুফতী’ খেতাবে আখ্যায়িত হন।
কর্মজীবনঃ
হযরত আল্লামা মুফতী সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আমীমুল ইহসান রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি ১৩৪৬ হিজরীতে তাঁর আব্বাজানের ওফাতের দুই মাস পূর্বে তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এই সম্পর্কে তিনি “ফিক্হুস সুনান ওয়াল আসার’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, “আমার পিতা আমাকে তাঁর জামা পরিধান করান, তাঁহর তাবাররুকাত দান করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন ইন্তেকালের মাত্র দুই মাস পূর্বে।” ১৯২৭ সালে মুফতী সাহেব পিতৃহীন হয়ে পড়েন। পিতার জীবিত সন্তানদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। উল্লেখ্য মুফতী সাহেবের বড় ভাই সাইয়্যেদ আযীমুশ্শান কলকাতা মাদ্রাসা আলিয়ার ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। পিতা হযরত সাইয়্যেদ আবদুল মান্নানের ইন্তেকালের পর ছোট ভাই বোনের লালন-পালন ও শিক্ষার দায়িত্ব, পিতার চিকিৎসালয় ও পারিবারিক প্রেস পরিচালনা, গৃহ সংলগ্ন (জালুয়াটুলীস্থ) মসজিদের ইমামের দায়িত্ব প্রভৃতি তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। আল্লাহর অসীম দয়ায় তিনি নবীন হলেও এসব দায়িত্ব অত্যন্তসুষ্ঠুভাবে ও কৃতিত্বের সাথে পালন করেন।
কলিকাতার নাখোদা মসজিদ ও মাদ্রাসায় মুফতী সাহেবঃ
১৯৩৪ সালে মুফতী সাহেবকে কলকাতার বৃহত্তর জামে মসজিদ “নাখোদা মসজিদ” এর সহকারী ইমাম ও মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তাকে ‘নাখোদা মসজিদ’ এর মাদ্রাসার দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাকল্পে প্রায় লক্ষাধিক ফাতওয়া প্রদান করেন। এ সময় তার সুনাম ও যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নাখোদা মসজিদের ও দারুল ইফতার দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করেন। এইজন্য ১৯৩৫ সালে কলকাতা সরকার তাকে একটি বিশেষ সীলমোহর প্রদান করে যাতে লেখা ছিল গ্রান্ড মুফতী অফ কলকাতা GRAND MUFTI OF CALCUTTA । তখন থেকে আজ অবধি তিনি অধিক সমাদৃত হন মুফতী-এ-আযম উপাধি এর মাধ্যমে।
কলিকাতার কাযী পদে হযরত মুফতী সাহেবঃ
১৯৩৭ সালে বৃটিশ সরকার হযরত মুফতী সাহেবকে মধ্য কলিকাতার কাযী পদে নিয়োগ করেন। এই সময় তিনি একাধারে নাখোদা মসজিদের ইমামত, মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনার দায়িত্ব এবং কাযী পদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে থাকেন। ১৯৪৩ সালে মাদ্রাসায়ে আলিয়ায় অধ্যাপনার কাজে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এইসব কাজ যথারীতি পালন করেন। ১৯৪০ সালে তিনি আঞ্জুমানে কুররায়ে বাংলার (বাংলার ক্বারী সমিতি) সভাপতি নিযুক্ত হন।
আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতাঃ
১৯৪৩ সালে মুফতী সাহেব কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ভারত বিভাগ (১৯৪৭) পর্যন্ত তিনি টাইটেল কামিল ক্লাসে হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ এবং ফাযিল শ্রেণীতে উর্দু-ফার্সী শিক্ষা দিতেন। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এই দেশে হিজরত করে আসেন। তখন তিনি নতুনভাবে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনার কাজে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী অবসর গ্রহণের পর মুফতী সাহেব অস্থায়ীভাবে সেই পদে নিয়োগ পান। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মুফতী সাহেব স্থায়ীভাবে সেই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
আলিয়া মাদ্রাসায় কর্মরত অধ্যাপক হিসাবে মুফতী সাহেব ব্যাখ্যাসহ বুখারী শরীফ পড়াইতেন। তাঁর নিজের উক্তি হইতে জানা যায়, তিনি কমপক্ষে পঁচিশবার বুখারী শরীফের মতো সিহাহ্ সিত্তাহ্ অন্যতম সুবৃহৎ কিতাবটি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। হাজার হাজার হাদীস তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। হাদীসের ওস্তাদ হিসাবে তাঁর পাণ্ডিত্য-প্রতিভা অল্প সময়ের মধ্যেই আলেম সমাজে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দ্বীনী কিতাব প্রণয়ন এবং ধর্মীয় কাজে সময় দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ১৯৬৯ সালের ১ লা অক্টোবর উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।
কলকাতা থেকে ঢাকায় হিজরতঃ
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুফতী-এ আযম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ২২ তারিখে হিজরত করে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। তখন তিনি আলিয়া মাদ্রাসার পাশেই থাকতেন। মুফতী সাহেবের ঢাকায় আগমনের বছর খানেকের মাথায় ১৯৪৮ সালের ফ্রেবুয়ারী মাসের ৫ তারিখে ঢাকায় আসেন তারই ছোট ভাই সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নোমান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি।
ঢাকায় বসবাস ও মসজিদ নির্মাণঃ
১৯৪৭-৪৮ এর কোন এক সময় জনৈক এক ব্যক্তি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নোমান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি-কে বর্তমান মসজিদে মুফতী-এ আযম – (পুরানো ঢাকায় কলুটোলায় অবস্থিত) এর বর্ণনা দিয়ে বলল, সেখানে একটি মসজিদের মতো ইমারত আছে। আপনি যদি আপনার ভাইয়ের সাথে সেই মসজিদটির ব্যাপারে চিন্তা করেন তবে খুব ভাল হয়। প্রথমে হযরত নোমান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি নিজে উক্ত ব্যক্তির সাথে এসে এই জায়গা পরিদর্শন করেন। যখন তিনি দেখে বুঝতে পারেন এটি একটি মসজিদ ছিল তখন হযরত নোমান বারকাতী সাহেব বিষয়টি তার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইকে জানান। এরপর একদিনে উভয় ভাই মিলে মসজিদ দেখতে আসেন। উভয় ভাই মিলে যখন মসজিদ দেখতে আসেন তখন আল্লাহর ঘরের এই ভগ্নদশা দেখে ব্যথিত হন এবং উদ্যোগ নেন নবরূপে এটিকে মসজিদ হিসেবে গড়ে তোলার। তারা এখানে এসে মসজিদকে পরিষ্কার করেন ও নামাযের উপযোগী করে তোলেন।তখন অনেক দিন পর এই মসজিদে আযান দেন হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নোমান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি। আর ইমামতি করেন মুফতী আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি। তাঁদের সেই الله اكبر আল্লাহু আকবার ধ্বনির তাকবীর এত বছর আর এই মসজিদে বুলন্দ করণের আজ অবধি সেই الله اكبر এর তাকবীর জারি আছে। বলাবাহুল্য এই দুই ভাইয়ের অসীম দৃঢ়তা ও প্রাণান্তর চেষ্টার ফলেই আস্তাকুড়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদে মুফতী-এ আযম। মুফতী সাহেব হুজুর এই মসজিদের নাম দিয়েছিলেন নকশবন্দী মসজিদ। তবে ১৯৯৪ সালে মসজিদকে যখন সম্পূর্ণ নতুন ভিত্তি দিয়ে গড়া হয় সেই সময় থেকে মহল্লাবাসীর উদ্যোগে এই মসজিদের নাম রাখা হয় মসজিদে মুফতী-এ আযম। উল্লেখ্য,মুফতী সাহেব হুজুর এই মসজিদের খেদমতের জন্য মসজিদ সংলগ্ন একটি বাড়ী ক্রয় করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই বসবাস করেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তানে) কাবা শরীফের গেলাফ প্রস্তুত করা হয়। তখন সেই গেলাফটি ঢাকায় আনা হয় প্রদর্শনীর জন্য। ঢাকায় কাবা শরীফের গেলাফ প্রদর্শনীর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মুফতী সাহেবের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ গোফরান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি।
দুই বাংলার ঈদগাহ্তে ইমামতির গৌরব অর্জনঃ
মুফতী সাহেবের একটি অনন্য অর্জন রয়েছে যে তিনি দুই বাংলার ঈদগাহ্তে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতা থাকার সময় ১৯৪৭ সালে তিনি কলিকাতার ঈদগাহে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানার পদে উন্নীত হবার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দানে ঈদের জামাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
বায়তুল মুকাররমের প্রধান খতীব ও ইমামঃ
১৯৬৪ সালে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে তিনি সেই মসজিদের খতীব এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এই মহান দায়িত্ব কৃতিত্ব সহকারে পালন করেন। হযরত মুফতী সাহেব রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি প্রতি শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়াতেন এবং আরবীতে স্বরচিত খুৎবা পড়তেন। খুৎবার বঙ্গানুবাদ পূর্বেই শ্রোতাদেরকে শোনানো হত। অভিনব পদ্ধতিতে অনর্গল বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় তাঁর খুৎবা প্রদানের অপূর্ব দৃষ্টান্ত বাস্তবিকই বিরল ব্যাপার। আরবদেশ থেকে আগত অনেক উচ্চশিক্ষিত আলেম ও রাষ্ট্রনায়ক তাঁর খুৎবা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন।
তাসাউফ এর পথে মুফতী-এ আযমঃ
মুফতী-এ আযম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি যেমন একজন হাক্কানী আলেমে দ্বীন ছিলেন তেমনি ইলমে তাসাউফ এর প্রাণপুরুষও ছিলেন। নিজ প্রাথমিক জীবনে তিনি তাঁর চাচা হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আব্দুদ দাইয়্যান বারাকাতী এবং শশুর সাইয়্যেদ আবু মুহাম্মাদ বারকত আলী শাহ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহিম এর কাছ থেকে বিভিন্ন তরীকতের ইজাজাত গ্রহন করেন। ঢাকায় আগমনের পর তার সুহৃদ হযরত শাহ সাইয়েদ আবদুস সালাম আহমদ রহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি তাকে বায়আত প্রার্থীদের মুরিদ করিতে অনুরোধ করেন। এর ফলে তিনি নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া বারকাতীয়া তরীকা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
হযরত মুফতী সাহেব নকশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরীকার মহান সাধকগণের উসিলা দিবার সময় নামের আদ্যাক্ষর বিশিষ্ট ফার্সী কবিতাটি (শাজরা শরীফ) মনমাতানো আবেগাপ্লুত কন্ঠে পড়তেন।
শাজরা শরীফঃ
সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া বারকাতীয়া
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বাহাক্কে আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিদ্দিক ও সালমাঁন কাসেম ও জা’ফর,
হুযুরে বা-ইয়াযিদ ও বুল হাসান হাম বু আলী রাহবর।
বা ইউসুফ গাজদাওয়ানী আরিফে দ্বীন সাইয়েদী মাহমুদ
আযীযান শায়খ শাম্মাসী কুলালে মীর দ্বীনে মাকসুদ।
বাহাউদ্দিন আলাউদ্দিন ও ইয়াকুব উবায়দুল্লাহ,
মুহাম্মাদ জাহেদ ও দরবেশ খাজা আমকীনা আগাহ।
মুহাম্মাদ বাকী ও আহমদ শাহ মাসুম সাইফুদ্দিন,
বা আঁ নূর মুহাম্মাদ জানজানান আবদল্লাহ হক বাঁ।
বাশাহে বু-সায়ীদ আহমদ সায়ীদ ও দোস্ত হক উসমান,
সিরাজে মিল্লাত ও দ্বীন কেবলায়ে মা বারকাতে দাইয়ান।
সিরাজে মিল্লাত ও দ্বীন কেবলায়ে মা আহমাদে যীসানঁ।
সিরাজে মিল্লাত ও দ্বীন কেবলায়ে মা সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান।
সিরাজে মিল্লাত ও দ্বীন কেবলায়ে মা সাইয়্যেদে নোমান ।
সিরাজে মিল্লাত ও দ্বীন কেবলায়ে মা সাইয়্যেদে গোফরান,
সালামে মা রাসায়ে রব্বায়ে পীরানে রাব্বানী, রাযায়ে হক্ব হো হার দাম বা রুহে খোদা দানী। মুনাওয়ার কুনদলাম ইয়া রাব বা নুরে ফায়েজে এহসানী। যো হুব্বে মুস্তাফা মাহকাম বে যিকরে খোশে গীরদানী।
হযরত মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এমনই “বাহরুল উলূম” (জ্ঞানের সাগর) যাকে আল্লাহ পাক দ্বীন ইসলামের ইলমের ফায়েজ ও বারাকাত দিয়ে ধন্য করেন। হযরত মুফতী সাহেব ইসলামের আসল খিদমত করেছেন অসংখ্য দ্বীনি কিতাব রচনার মাধ্যমে। তিনি নিজ জীবনে ২০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন(সুবহানাল্লাহ !)। নিচে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কিতাবের নামের তালিকা দেয়া হল।
ইলমে তফসীর এবং উসূলে তফসীরঃ
- ইতহাফুল আশরাফ বি হাশিয়াতিল কাশশাফ।
2. আল ইহসানুস সারী বিত তাওযিহ ই তাফসির-ই সহীহিল বুখারী।
3. আত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির।
4. আত- তাবশীর ফি শরহিত তানবীর ফি উসূলিত তাফসির।
ইলমে হাদীস এবং উসূলে হাদীসঃ
- মীযানুল আখবার।
2. আল ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার।
3. মানাহিজুস সু’আদা।
4. উমদাতুল মাযানী বি তাখরিজে আহাদীস মাকাতিবুল ইমামুর রাব্বানী।
5. আল আরবাঈন ফিস্ সালাত।
6. আল-আরবাঈন ফিল মাওয়াকিত।
7. আল আরবাঈন ফিস্ সালাতি আলান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
8. জামে জাওয়ামেউল কালাম।
9. ফিহিরস্তত কানযুল উম্মাল।
10. মুকাদ্দামায়ে সুনানে আবু দাউদ।
11. মুকাদ্দামায়ে মারাসিলে আবু দাউদ।
12. লাইল ওয়ান নাহার।
13. মীযানুল আখবার।
14. মিয়ারুল আসার।
15. হাশিয়ায়ুস সাদী।
16. তোহফাতিল আখিয়ার।
17. তালিকাতুল বারকতী।
18. তালখীসুল মারাসিল।
19. আসমাউল মুদিল্লীন ওয়াল মুখতালিতীন।
20. কিতাবুল ওয়ায়েযীন।
21. মিন্নাতুল বারী।
ইলমে ফিকহ এবং উসূলে ফিকহঃ
- তরীকায়ে হজ্জ।
2. ফাতাওয়ায়ে বারকাতীয়া।
3. তরীকায়ে হজ্জ।
4. আল কুরবাহ ফিল কুরা।
5. হাদিয়াতুল মুসাল্লীন।
6. আত্ তানবীহ লীল ফকীহ।
7. লুববুল উসূল।
8. মালাবুদ্দা লিল ফকীহ
9. আত- তারীফাতুল ফিকহিয়্যাহ।
10. উসূলুল কারখী।
11. উসূলুল মাসায়েলীল খিলাফিয়্যাহ।
12. কাওয়ায়েদুল ফিকহ।
13. আদাবুল মুফতী।
14. তুহফাতুল বারকাতী বি-শরহে আদাবুল মুফতী।
সীরাতঃ
- আওজায়ুস সিয়ার।
2. আনফাউস সিয়ার।
3. সীরাতে হাবিবে ইলাহ।
4. রেসালা-হায়াতে আবদুস সালাম।
5. ইলমে তাসাওউফ।
6. রেসালায়ে তরীকাত।
7. আততাশাররুফ লি আদাবিত তাসাওউফ।
(ইতিহাস) তারীখঃ
- তারীখে ইসলাম।
2. তারিখে আম্বিয়া।
3. তারিখে ইলমে হাদীস।
4. তারীখে ইলমে ফেকাহ।
5. আল হাভী ফি যিকরিত তাহাভী।
6. তারিফুল ফুনুন ওয়া হালাতে মুসান্নেফিন।
7. নাফয়ে আমীম।
(ব্যাকরণ বিদ্যা) ইলমে নাহু ও সরফঃ
- মুকাদ্দামাতুন নাহু।
2. নাহু ফারসী।
ওয়াজ ও মিলাদঃ
- মজুমায়ে খুতবাত।
2. মজুমায়ে ওয়াজ।
3. ওয়াজিফায়ে সাদিয়া বারকাতীয়া।
4. শাজারা শরীফা।
5. সিরাজাম মুনীরা ও মিলাদ নামা।
উর্দু সাহিত্যঃ
- আদবে উর্দু।
2. শরহে শিকওয়াহ ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহ।
বিবিধঃ
- মুযীলুল গাফলাহ আন সিমতিল কিবলাহ।
2. মুয়াল্লেমুল মীকাত।
3. নিযামুল আওকাত
4. ধোপঘড়ি।
5. ওয়াসিয়াতনামা।
হযরত মুফতী সাহেবের অনেক গ্রন্থ মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকাভুক্ত। তাঁর প্রধান কিতাবসমূহ যেমন- ফিকহুস সুনানে ওয়াল আসার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ, তারীখে ইলমে ফিকাহ, তারীখে ইসলাম, তারীখে ইলমে হাদীস, আদাবুল মুফতী, কাওয়ায়েদুল ফিকাহ, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার প্রভৃতি মিসরের জামে আল আজহার, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দসহ, পাকিস্তান সিরিয়া, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল আলিয়া ও কওমী মাদ্রাসা গুলোতে পাঠ্য বই হিসাবে পড়ানো হয়।
এছাড়াও তাঁর রচিত “কিতাবুল আওকাত” এর উপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁর রচিত নামাযের সময়সূচি অনুযায়ী বর্তমানে সারা বাংলাদেশে নামাযের সময় ও ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়। হযরত মুফতী সাহেব একজন বই প্রেমিক মানুষ ছিলেন। কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও যিকির এর মাঝেই নিয়মিত কিছু সময়ই দ্বীনি কিতাব অধ্যয়ন করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে ছিল সাড়ে তিন হাজারের অধিক বিভিন্ন ইসলামী কিতাব, এরমধ্যে কিছু প্রাচীন ও দুর্লভ কিতাব তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর পীর ও মুর্শীদ এবং শশুর সাইয়্যেদ আবু মুহাম্মাদ বারকত আলী শাহ (রহঃ) এর নিকট থেকে। হযরত মুফতী সাহেবের ছাত্ররা এইজন্য গর্ব করে বলত আলিয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরীর চেয়ে অধিক বই মুফতী সাহেবের কাছে আছে।
হজ্জ পালনঃ
হযরত আল্লামা মুফতী সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি জীবনে তিনবার বায়তুল্লাহর হজ্জে মবরূর পালন করেন। সর্বপ্রথম এবং ফরয হজ্জ আদায় করেন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে, ১৯৬৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সস্ত্রীক এবং ১৯৭১ সালে তৃতীয় হজ্জ পালন করেন।
পারিবারিক জীবনঃ
হযরত মুফতী সাহেবের আদব ও আখলাকে সন্তুষ্ট হয়ে সাইয়্যেদ আবু মুহাম্মাদ বারকত আলী শাহ সাহেব ১৯২২ সনে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা সাইয়্যেদা মায়মুনার সঙ্গে নিকাহ করান। অল্প দিন পরই ১৯২৯ সালে তার এই সহধর্মীনি ইন্তেকাল করেন। হযরত মুফতী সাহেবের এই স্ত্রী থেকে এক কন্যা সাইয়্যেদা সুলতানা খাতুন এর জন্ম হয়েছিল, ছোট বয়সেই তার ইন্তেকাল হয়। অতঃপর তিনি ১৯৩০ সনে দ্বিতীয়বার সাইয়্যেদা ফাতেমার সঙ্গে নিকাহ করেন। ১৯৩৭ ঈসায়ী সনে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীও ইন্তেকাল করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি তৃতীয়বারের মত দ্বিতীয়া স্ত্রীর ভগ্নিকে সাইয়্যেদা খাদিজাকে বিবাহ করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর এই স্ত্রী ১৯৮৫ সনের ১৮ জানুয়ারি মোতাবেক ১৪০৫ হিজরীর ২৫ রবিউস সানী ইন্তেকাল করেন।হযরত মুফতী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী থেকে এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র সাইয়্যেদ মুনায়েম জন্মের কিছুদিন পরেই তার ইন্তেকাল হয়। আর মেয়ে সাইয়েদা আমেনা খাতুনই ছিলেন মুফতী সাহেবের সন্তানদের মধ্যে একমাত্র সন্তান যিনি তাঁর ওফাত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ১৪১১ হিজরী মোতাবেক ১৯৯১ সালে তিনি এই নশ্বর দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
পরম মাওলার সান্নিধ্যে যাত্রাঃ
মানুষ যত বড় জ্ঞানী-গুণীই হউন কিংবা আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যের যত উচ্চ দরজার অধিকারী হউন না কেন, একদিন মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই নিতে হবে।অনুরুপ ভাবে সাইয়্যেদ বংশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (১৩৯৫ হিজরীর ১০ই শাওয়াল) এ দুনিয়াবাসীকে বিদায় জানিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে জান্নাতবাসী হন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ইন্তেকাল কোন সাধারণ মানুষের ইন্তেকাল নয়, বরং একজন “বাহরুল উলূম” এর ইন্তেকাল ছিল। তাই তো বলা হয়:
موت العالِمِ موت العالَمُ
আলিমের মৃত্যু জনপদের মৃত্যুসদৃশ
এ জ্ঞান তাপসের ইন্তেকালে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে শোকের কালোছায়া নেমে আসে। তাঁর জানাযায় লাখো মানুষের ঢল নামে। বায়তুল মুকার্রম জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন নারিন্দার মরহুম পীর সাহেব হযরত সাইয়্যেদ নযরে ইমাম মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি।ইন্তেকালের পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলুটোলা মসজিদের দক্ষিণ পাশের কামরায় তাঁকে কবরস্থ করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই মসজিদটি এখন তাঁরই নামে “মসজিদে মুফতী-এ আযম” নামে পরিচিত। তাঁর মাযার ফলকের উপর খোদাই করা করে লেখা রয়েছে এই ফার্সী কবিতা যা তাঁর মতো আল্লাহওয়ালা বান্দাদের জন্য অত্যন্ত সত্য।
هرگز نميرِ دانكه دل ارر نده شدبه عشق ثبت است برجريده عالم دوام ما
যাদের মনপ্রাণ পরম মাওলার প্রেমে বিভোর থাকে তাদেরকে কোন অবস্থায় মৃত বলে ধারণা করবে না। তারা কিয়ামত পর্যন্ত আছেন, জীবন্ত ও প্রাণবন্ত।
মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী এর খলিফাবৃন্দঃ
- আলহাজ্ব সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নোমান বারকাতী (মেজ ভাই)।
2. আলহাজ্ব মাওলানা কাজী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ গোফরান বারকাতী (ছোট ভাই)।
3. মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ ইমরান (চাচাত ভাই ও ভগ্নিপত)।
4. আলহাজ্ব সৈয়দ মুহাম্মাদ মুসলিম আমীমী (জামাতা)।
5. আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম ওয়াহেদী (ভাগ্নে)।
6. আলহাজ্ব মাওলানা আবদুল গনি।
7. মাওলানা আবদুল কাদের।
8. আলহাজ্ব মুহাম্মাদ মইজ-উদ্দিন।
9. আলহাজ্ব আযিয আহমদ।
10. আলহাজ্ব হাফেয আবদুল হাকেম।
11. আলহাজ্ব মাওলানা লোকমান আহমদ আমীমী।
12. আলহাজ্ব কারী মোহাম্মদ আবিদ।
13. আলহাজ্ব ডা: মনসুর রহমান।
14. আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল মুনয়েম।
15. জনাব ফযলে এলাহী।
ইসলামের সেবায় ও দাওয়াতি কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে (১৪০৫ হিজরী) মুফতী সাহেবকে মরণোত্তর স্বর্ণপদক ও সনদ দান করেন। মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে এই বিশ্বনন্দিত আলেম এর জীবন ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দান করুন। (আমীন)
নিবন্ধ রচনায়ঃ
সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নাইমুল ইহসান বারকাতী
পরিচালকঃ মুফতী আমীমুল ইহসান একাডেমী
(পৌত্রঃ মুফতী সাইয়্যদে মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি)
ওয়েব সম্পাদনায়ঃ গোলাম হুসাইন