বিবাহ: সুন্নাত পদ্ধতির অনুসরণ প্রয়োজন

অধ্যাপক মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী

বিবাহ ইসলাম ধর্মে একটি অত্যন্ত পবিত্র বিষয়। এই বিয়ে প্রথার মাধ্যমে পরিবার নামক একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। সে সংগঠনটি সৃষ্টির শুরুতে যদি কুসংস্কৃতি অপসংস্কৃতি মুক্ত না থাকে তাহলে পুরো পারিবারিক জীবনে নেমে আসতে পারে অশান্তি। আজকাল পাত্রীর পক্ষ যেভাবে ধনবান, সৌখিন, স্পার্ট পাত্র খোঁজে সেভাবে সৎ নীতিবান ধার্মিক পাত্র খোঁজে না। মনের মত পাত্র পেলে প্রচুর যৌতুক পাত্রীর পক্ষ হতে প্রদান করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে দুই পক্ষের নতুন নতুন কত আয়োজন-অনুষ্ঠান-প্রথা তার শেষ নেই। এমন নিকৃষ্ট অনুষ্ঠানও থাকে, যার ফলে পবিত্র আয়োজনটি অপবিত্র হয়ে যায়।

অনেক ধনাঢ্য পরিবার দেখেছি, ভালো পাত্র না খোঁজে ধনী পাত্র খোঁজতে গিয়ে মেয়ের বিয়ের বয়স অতিক্রম করে ফেলেছে। ইসলামে এ ধরনের চিন্তা, কর্ম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মেয়ের বিয়ের বয়স হলে বিয়ে না দিলে মারাত্মকভাবে পাপের ঝুঁকি থাকে। তার চেয়ে চরিত্রবান গরীব সন্তানকে পাত্র হিসেবে নির্বাচন করা খুবই উত্তম কাজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গরীবকে বেশী ভালো বাসতেন। আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতেন, ‘‘হে আল্লাহ্ তুমি আমাকে গরীব অবস্থায় আমার জিন্দেগী অতিবাহিত কর, গরীব অবস্থায় ইন্তেকাল কর, গরীব অবস্থায় হাশর কর। কারণ গরীব ধনীর চেয়ে চল্লিশ বছর আগেই জান্নাতে যাবে।’’
তিনি তাঁর উম্মতগণকে সম্পদ ও সৌন্দর্য্য নয় ধার্মিক দেখে বিয়ে করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ধার্মিকতার সাথে সম্পদ ও সৌন্দর্য্য থাকতে পারে। এক হাদিসে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তিন ধরনের সম্পদের মধ্যে বরকত নেই। এক. জমির অর্থাৎ জমি বিক্রি করে পাওয়া অর্থে। দুই. মেয়ের টাকা যা পাত্র পক্ষ থেকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। তিন. পাত্রীর পক্ষ হতে নেওয়া যৌতুক। এ সবের ওপর নির্ভর না করে নিজ পায়ে দাঁড়ানোতে তিনি নির্দেশ প্রদান করেছেন।

বর্তমান বিয়েতে যৌতুক নামক একটি কুপ্রথা চালু হয়েছে। এই প্রথার কারণে অনেক মা-বাবা আর্থিক সংকটে জর্জরিত হয়ে অত্মহত্যার পথ বেচে নিয়েছে। যে প্রথা অন্য সবার পালন করা সম্ভব নয় সে প্রথা নিষিদ্ধ। যৌতুক হিসেবে নয় পাত্রীর পক্ষ ইচ্ছে করলে উপহার হিসেবে শুধু দুটি প্লেইট, দুটি গ্লাস, একটি লেপ-তোশক, দুটি বালিশ, একটি চাদর, বর কন্যার জন্য এক সেট করে কাপড়, একটি পবিত্র ক্বোরআন সামর্থবান হলে শুধু একপদ (বেশী দামী নয়) অলংকার দেওয়া জায়েয আছে, কিন্তু বাবার সম্পত্তির প্রাপ্ত অংশ বুঝিয়ে দিতে পারে। যে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ তা আমাদের সমাজে অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। আর মেয়ের প্রাপ্য সম্পত্তির অংশ যা আল্লাহ্ পাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা দেওয়া হতে বঞ্চিত করি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর পক্ষের ওয়ালিমা (খাওয়ার আয়োজন) করা সুন্নাত, তা পালন না করে পাত্রীর পক্ষের খাওয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এ সব ইসলামের আদর্শ কথা আমরা জানি, কিন্তু কয়জনই মানি! কোনো কোনো পরিবার আছে যারা যৌতুক না পেলে নববধুকে তিরস্কার করে । এ ক্ষেত্রে পাত্রী তাদেরকে বলা উচিত আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত তরিকায় হযরত ফাতেমাতুজ্জাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বিয়ে অনুসরণে তোমার ঘরে এসেছি। এ পদ্ধতিকে নিন্দা করা মানে সুন্নাতকে নিন্দা করা, ইসলামকে ভর্ৎসনা করা। মুসলমান তা কোনদিন করতে পারে না।

এখন বিয়ের অনুষ্ঠানে যৌতুক প্রদানের প্রতিযোগিতা চলছে। এ সব সুস্থ সংস্কৃতি নয়। দুই-এক যুগ আগেও আমরা দেখেছি বিয়েতে উপহার হিসেবে ক্বোরআন শরীফ, অজিফা, বিভিন্ন ধর্মীয় বই, গল্পের বই ও উপন্যাস প্রদান করা হতো। সে যুগ বর্তমান আর নেই। এখন মন সাজানোর পরিবর্তে ঘর সাজানোর জিনিস প্রদানের প্রতিযোগিতা চলছে।

হযরত ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র কাছে এক ব্যক্তি হাজির হয়ে বললেন, আমি অঙ্গীকার করেছি যে, আমার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে সব জিনিস প্রদান করবো। আপনি বলুন সব জিনিস প্রদান করা রাজা-বাদশাহরও সম্ভব নয়। এখন আমি কী করব? তিনি বললেন, আপনার মেয়েকে একটি ক্বোরআন উপহার দিন, এ মহান গ্রন্থে প্রত্যেক জিনিস আছে।

নবী নন্দিনী হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বিয়ের অনুষ্ঠানটিকে আমরা সুন্নতি বিয়ের মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল পনের। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বয়স বাইশ। দু’জনের সম্মতিতে দ্বিতীয় হিজরিতে ১৭ রজব সোমবার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সবাইকে খবর দেওয়া হলো মসজিদে নববিতে জোহরের নামায আদায় করতে। মসজিদে উৎসবের মত হলো। এক পাশে বসলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, অন্য পাশে হযরত ওসমান বিন আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বসলেন, মাঝখানে বসলেন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাঁকে সামনে নিয়ে বসলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। হুযূর করিম মাহবুবে খোদা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিয়ের খোৎবা পাঠ করলেন। ১০৫ ভরি চান্দি মোহরানা হিসেবে ধার্য করা হলো। আক্দ পড়ানো হলো। অতঃপর খোরমা ছিটিয়ে দেওয়া হলো। প্রত্যেকে স্বাগত জানালেন। ঘর হতে বিদায় বেলায় হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মায়ের স্মরণে কাঁদতে লাগলেন, তখন নবীজি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি কান্না কারছো কেন? তুমি তো সবদিক দিয়ে ভাগ্যবান। তোমার পিতা নবীদের ইমাম, আর তোমার স্বামী অলিদের ইমাম। হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মাওলা আলীর ঘরে যাওয়ার একদিন পর দশ সের যবের রুটি, কিছু পনির এবং খোরমা দ্বারা ওয়ালিমার আয়োজন করা হয়। এই ধরনের অনাড়ম্বর খাবারের ব্যবস্থা করার নামই সুন্নতে রাসূল বা ওয়ালিমা। কাজেই সকল কুপ্রথা বাদ দিয়ে মুসলমানদের সুন্নাত তরিকা অনুসরণ করা উচিত।


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading