খতিবে পাকিস্তান, শাইখুল হাদিস আল্লামা শফি উকাড়ভী রাহিঃ
ভাষান্তরঃ মাওলানা মুহাম্মদ মহিউদ্দীন হাফিঃ
কতেক লোক বলে থাকেন যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক হযরত সৈয়দা ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র হক্ব অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। “ফাদাক বাগান” যা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম হযরত সৈয়দাকে দান করেছিলেন কিংবা তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে হযরত সৈয়দার ভাগে এসেছিল তা দেননি। যার কারণে হযরত সৈয়দা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যান এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অসন্তুষ্টই ছিলেন। তাঁর সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি। আর যেহেতু সৈয়দার অসন্তুষ্টি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামেরই অসন্তুষ্টি সেহেতু আবু বকর সিদ্দীক সৈয়দাকে অসন্তুষ্ট করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামকে অসন্তুষ্ট করেছেন। মা’য়াযাল্লাহ!
এটা সত্যনিষ্ঠদের সরদার সিদ্দীক আকবরের প্রতি কেবল একটি মিথ্যা অপবাদ এবং একটি ভিত্তিহীন কুৎসা রটনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। যার কোন হাকীকত নেই। এখনই কয়েক লাইন পাঠ করার পর পাঠকদের নিকট এই অপবিত্র অপবাদের স্বরূপ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং অপবাদ আরোপকারীদের অজ্ঞতা ও অসারতার পুরোপুরি উপলব্ধি হয়ে যাবে। এই সত্যকে প্রকাশ করার পূর্বে সম্মানিত পাঠকদেরকে “ফাদাক”-এর পরিচয় করানো দরকার যে, “ফাদাক” কি?
“ফাদাক” এর পরিচয়
কামূস, লিসানুল আরব, মিসবাহুল লোগাত ও সহীহ বুখারীতে রয়েছে- “ফাদাক” একটি গ্রাম যা খায়বারের উপকণ্ঠে খায়বার থেকে এক মনযিল (একদিনের পথ) এবং মদীনা মুনাওয়ারা থেকে দুই বা তিন মনযিল দূরত্বে অবস্থিত। ওখানে ছিল খেজুর বাগান ও পানির কিছু ঝর্ণা। তার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ফাতহুল বারী, ফুতুহুল বুলদান, তারীখে তাবারী ও ইবনে আসীরের তারীখে কামিলে রয়েছে যে, সপ্তম হিজরীতে যখন খায়বার বিজয় হল তখন তাদের অবশিষ্ট লোক দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। যখন তাদের উপর অবরোধ কঠিন আকার ধারণ করে তখন তারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের খেদমতে আবেদন করল-তাদের হত্যার অপরাধ যেন মাফ করা হয় এবং তাদেরকে যেন খায়বার থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
তিনি তাদের এই আবেদন গ্রহণ করেন। খায়বার থেকে বের হয়ে তারা পুনরায় আবেদন করল-যদি আপনি আমাদেরকে খায়বারেই থাকতে দেন তা হলে আমরা খায়বারের উৎপন্ন শষ্যের অর্ধেক আপনার খেদমতে দিয়ে দেব, বাকী অর্ধেক পারিশ্রমিক হিসেবে নিজেরা রেখে দেব। এতদসত্ত্বেও আপনার জন্য সব সময় এই এখতিয়ার থাকবে যে, যখন ইচ্ছে আমাদেরকে খায়বার থেকে বহিষ্কার করতে পারবেন। তিনি এই শর্ত কবুল করেন।
যখন তিনি খায়বার থেকে প্রত্যাগত হলেন তখন মাহীসা ইবনে মাসউদ আনসারীকে ফাদাকবাসীদের নিকট ধর্মপ্রচারের জন্য পাঠালেন। ফাদাকের অধিবাসীরা ছিল ইয়াহুদী এবং তাদের সরদার ছিল য়ুশা ইবনে নূন নামক এক ইয়াহুদী। সে তাঁর নিকট সন্ধির প্রস্তাব পাঠালো এবং খায়বারবাসীদের ন্যায় ফাদাকের ফসল থেকে অর্ধেক দেয়ার আবেদন করল। তিনি তা মঞ্জুর করলেন। এইভাবে “খায়বার” ও “ফাদাক” ইসলামের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। খায়বার যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ফাদাক যুদ্ধ ছাড়াই বিজিত হয়। শরীয়তের পরিভাষায় যে ভূমি বা সম্পদ বিনা যুদ্ধে হস্তগত হয় তাকে “ফাই” বলে। প্রতীয়মান হল-ফাদাক ও তার আয় ‘ফাই’ এর সম্পদ এবং ‘ফাই’ সম্পদের ব্যয়খাত কুরআন শরীফে পরিষ্কার ও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
ইরশাদ হচ্ছে:
مَّاۤ أَفَاۤءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِی ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡیَتَـٰمَىٰ وَٱلۡمَسَـٰكِینِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِیلِ …. لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
আল্লাহ তায়ালা এই জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের এবং ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের…. অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। (সূরা হাশর, আয়াত-৭ ও ৮)
এই আয়াত থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হল- “ফাই” সম্পদ যা যুদ্ধ ব্যতিরেকে হস্তগত হয়েছিল তা কারো ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল না বরং তার হকদার ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ও তাঁর স্বজনগণ ছাড়াও সেই সমস্ত মুসলমান যারা ছিল ফকীর, মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত।
এটা এক স্বীকৃত বিষয় যে, কোন বাদশাহ বা নবী বা ইমাম বা নেতা যদি তার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা; প্রভাব ও প্রতিপত্তি দ্বারা কোন ভূসম্পত্তি বা অন্য কিছু শত্রু হতে যুদ্ধ করে বা বিনা যুদ্ধে সন্ধির মাধ্যমে লাভ করে সেটা তার ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়ে যায় না এবং তার এই অধিকারও থাকে না যে, সেটা তার সন্তানদের মালিকানায় প্রদান করবে বরং তার জীবদ্দশায় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা ও অধিকার থাকে যে, তিনি বিধি মোতাবেক তা ব্যবহার করবেন। তার ইন্তেকালের পর হতে উত্তরাধিকারও চালু হয় না যে, মীরাস হিসেবে তাদের ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। যখন এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, এই ভূসম্পত্তি তাঁর ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল না। কেননা ব্যক্তি মালিকানাধীন তো সেটাই হয়ে থাকে যা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় বা নিজের উপার্জিত সম্পদ দিয়ে ক্রয় করা হয়। এখানে এই দু’টোই অনুপস্থিত। অতএব তাঁর পবিত্র সত্তার পক্ষে এটা কিরূপে সম্ভব হতে পারে যে, তিনি এই ওয়াকফ ভূসম্পত্তি যার মধ্যে গরীব ও অভাবগ্রস্ত মুসলমানদের হক ছিল; তা কেবল সৈয়দা ফাতেমাকে দান করতঃ তাঁর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। এতে তো এই অভিযোগ আসছে যে, তিনি গরীব ও অভাবগ্রস্তদের হক আত্মসাৎ করে সৈয়দাকে প্রদান করেছেন এবং আল্লাহর নির্দেশের কোন গুরুত্ব দেননি। (নাউযুবিল্লাহি মিন্ যালিক)
কোন মুসলমান এইরূপ কিছু কল্পনাও করতে পারে না যার ফলে তাঁর সত্তায় এক অশোভনীয় কলঙ্ক আসতে পারে। আমাদের ঈমান তো এটাই যে, তিনি একজন বিশ্বস্ত কোষাধ্যক্ষ হিসেবে তার উপর নির্বাহী ক্ষমতা রাখতেন এবং আল্লাহ তায়া’লার বিধান মোতাবেক তা ব্যবহার করতেন। তদুপরি শস্য, ফসল ইত্যাদি যা ফাদাক থেকে আসতো তাও এই পরিমাণ ছিল না যা মুসলমানদেরকে জীবনোপকরণের চিন্তা মুক্ত করবে। অতএব হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম তা থেকে নিজের পরিবার-পরিজনের মামুলী প্রয়োজন মোতাবেক পৃথক করে বাকীগুলো হকদার মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। এতদসত্ত্বেও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের যুগে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা যা ছিল তা সর্বজনবিদিত।
এবার আমাদের বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের কথাও শুনুন- তাদের মতে ‘বাগে ফাদাক’ কি? অতএব তাদের প্রমাণ্য ও নির্ভরযোগ্য আল্লামা বাকের মাহলাবী ‘বিহারুল আনওয়ারে’ হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একদিন রাসূল মাককূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম সৈয়দা ফাতেমা যাহরার গৃহে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় জিব্রীল আমীন এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! উঠুন, আল্লাহ তায়া’লা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন- আমি যেন পাখা দ্বারা আপনার জন্য “ফাদাক”র চৌহদ্দি নির্ধারিত করে দিই।
অতঃপর হুজুর তাঁর সাথে গমন করেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। তখন খাতুনে জান্নাতের জিজ্ঞাসার জবাবে ফরমালেন, “জিবরীল আমার জন্য তাঁর পাখা দ্বারা ফাদাকের চৌহদ্দি নির্ধারিত করে দিয়েছেন।” এই রেওয়ায়তে এটা বলা হয়নি যে, ফাদাকের নির্ধারিত চৌহদ্দি কি ছিল এবং তা কি উদ্দেশ্যে কায়েম করা হয়েছিল? কিন্তু অপর রেওয়ায়ত যা উক্ত কিতাবে আল্লামা সাহেব উদ্ধৃত করেছেন; তাতে ফাদাকের উল্লেখ রয়েছে। তা হল এই যে-খলীফা হারুনুর রশীদ হযরত ইমাম মূসা কাযেম রেযা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কয়েকবার আরজ করলেন যে, আপনি ফাদাক নিয়ে নিন। কিন্তু তিনি বরাবর প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। পরিশেষে যখন খলীফা বারংবার অনুরোধ করেন তখন তিনি বললেন, আমি ফাদাক তাবৎ গ্রহণ করব না যাবৎ তা চৌহদ্দিসহ আমাকে প্রদান করা হবে না। খলীফা চৌহদ্দিসহ ফাদাক প্রদানের কসম করলেন এবং চৌহদ্দি জিজ্ঞেস করলেন। ইমাম সাহেব বললেন, তার প্রথম সীমানা “এডেন”, দ্বিতীয় সীমানা “সমরকন্দ।” এটা শুনে খলীফার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তারপর ইমাম সাহেব বললেন, তার তৃতীয় সীমানা আফ্রিকা এবং চতুর্থ প্রান্ত সমুদ্র যা আর্মেনিয়ার সাথে যুক্ত। খলীফা বললেন, আপনি আমাদের জন্য তো কিছুই বাকী রাখেননি। ইমাম সাহেব বললেন, এইজন্যই তো আমি বলেছিলাম, চৌহদ্দি শুনে আপনি কিছুই দিবেন না। উক্ত কিতাবে আরো একটি রেওয়ায়ত রয়েছে যা মূল বিষয়বস্তুর দিক থেকে অভিন্ন হলেও তার চৌহদ্দিতে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। যেমন এতে বর্ণনা করা হয়েছে, “প্রথম সীমানা আরীশে মিশর, দ্বিতীয় সীমানা দাওমাতুল জানদাল, তৃতীয় উহুদ এবং চতুর্থ সাগর যা শুনে খলীফা বললেন, এতো সারা দুনিয়া। তখন ইমাম সাহেব বললেন, এগুলো সব ইয়াহুদীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আল্লাহ যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই তা “ফাই” করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন- এগুলো আপনার তনয়া ফাতেমাকে দান করুন।”
এটাও আফসোসের বিষয় যে, তাদের নিকট অন্য কোন রেওয়ায়ত বিদ্যমান নেই। নচেৎ বিচিত্র ছিল না যে, পাক-ভারত ও অপরাপর ইসলামী দেশ যা মুসলমানগণ পরে জয় করেছে; তাও ফাদাকের হুকুমে চলে আসতো। যা হোক, এই রেওয়ায়তসমূহ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইসলামী সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত নামক “ফাদাক” যা আল্লাহ যুদ্ধ-বিগ্রহ ব্যতীত তাঁর পয়গাম্বরের জন্য “ফাই” করেছিলেন এবং নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এর সবটুকু সৈয়দাকে হস্তান্তর করুন। জ্ঞানী ও বিদ্বান লোকদের নিকট এই রেওয়ায়তসমূহের যা মূল্যায়ন হতে পারে তা প্রকাশমান। এই মুহূর্তে এই প্রসঙ্গে এছাড়া আর কি বলা যাবে
برین عقل و دانش بباید گریست
(এই জ্ঞান ও বুদ্ধির জন্য ক্রন্দন করা উচিৎ?)
নবীদের উত্তরাধিকার
আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরাধিকার কি? তাঁদের পরিত্যক্ত সম্পদ তাঁদের ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন হয় কি না? এর উত্তর প্রথমেই শিয়া মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাব “উসূলে কাফী”র দু’টি সহীহ রেওয়ায়ত থেকে পেশ করা হচ্ছে।
ইমামুল আয়িম্মা হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
انَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَذَاكَ أَنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوْرِثُوا دِرْهَمَا وَلَا دِينَارًا وَانَّما أَوْرِثُوا أَحَادِيثَ مِنْ أَحَادِيثِهِمْ فَمَنْ أَخَذَ بِشَيْءٍ مِنْهَا فَقَدْ أَخَذَ حَظًّا وَافِرًا
নিঃসন্দেহে আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। কারণ আম্বিয়ায়ে কেরাম তাঁদের উত্তরাধিকারে দেরহাম ও দীনার রেখে যান না বরং তাঁদের উত্তরাধিকার হল জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বাণীসমূহ। অতএব যে ব্যক্তি তাঁদের জ্ঞানপূর্ণ বাণীসমূহ থেকে কিছু গ্রহণ করে সে অনেক বড় হিস্যাই গ্রহণ করে। (উসূলে কাফী শরহে সাফী সহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা ৮৩)
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ النُّجُومِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ وَأَنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوْرِثُوا دِينَارًا وَلَا دَرْهَمَا وَلكِنْ أَوْرِثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَ مِنْهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন, জ্ঞানহীন আবেদের উপর আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব এইরূপ যেমন পূর্ণিমা রজনীতে সমস্ত নক্ষত্ররাজির উপর চন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব। আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী এবং নবীগণ তাঁদের উত্তরাধিকারে দেরহাম ও দীনার নয় বরং ইলম রেখে যান। সুতরাং যে ব্যক্তি এই ইলম থেকে কিছু গ্রহণ করেছে সে অনেক বড় ভাগ নিয়েছে। (উসূলে কাফী শরহে সাফীসহ, খণ্ড-১, পৃষ্টা-৮৭)
এই রেওয়ায়তদ্বয় থেকে প্রমাণিত হল-নবীদের উত্তরাধিকার ইলম, মাল নয়।’
আহলে সুন্নাতের কিতাব থেকে
আমীরুল মো’মেনীন হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا نُورِثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন, আমরা নবীদের সম্পত্তির কোন ওয়ারিশ হয় না, আমরা যা কিছু রেখে যাই তা সাদকা। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা-৫৫০)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يُقْسِمُ وَرَثَتِي دِينَارًا مَّا تَرَكْتُ بَعْدِ نَفَقَةٍ نِسَائِي وَمُوْنَةٍ عَامِلِي فَهُوَ صَدَقَةٌ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন (আমার ইন্তেকালের পর) আমার ওয়ারিশগণ দেরহাম, দীনার ইত্যাদি (তর্কা হিসেবে) বন্টন করবে না এবং যা কিছু আমি রেখে যাব তা থেকে আমার স্ত্রীদের ব্যয় নির্বাহ ও শ্রমিকের পারিশ্রমিকের পর যা থাকবে তা হবে সাদকা। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা-৫৫০)
হযরত আমর ইবনে হারেস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
ما تَرَكَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمَا وَلَا عَبْدًا وَلَا امَةً إِلَّا بَغَلَةَ الْبَيْضَاءَ الَّتِي كَانَ يُرْكَبُهَا وَسَلَاحَةً وَأَرْضًا جَعَلَهَا لِابْنِ السَّبِيلِ صَدَقَةً
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম দেরহাম, দীনার, দাস, দাসী কিছুই রেখে যান নি। রেখে যান একটি সাদা খচ্চর যার উপর তিনি আরোহণ করতেন, কিছু সমরাস্ত্র এবং কিছু জমি। এগুলো মুসাফিরদের জন্য সাদকা করে যান। (বুখারী শরীফ)
উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
إِنَّ أَزْوَاجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ تُوَفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرَدْنَ أَنْ يَبْعَثْنَ عُثْمَانَ إِلى أَبِي بَكْرٍ يَسْئَلْنَهُ مِيرَاثَهُنَّ فَقُلْتُ أَلَيْسَ قَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا نُورِثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর তাঁর পবিত্র বিবিগণ হযরত ওসমানকে হযরত আবু বকরের নিকট তর্কার দাবী নিয়ে পাঠাতে ইচ্ছে করলেন। উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা বলেন, আমি বললাম, তোমাদের কি জানা নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন, আমরা নবীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কেউ হয় না, যা কিছু আমরা রেখে যাই তা সাদকাই হয়ে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)
উভয় দলের এই রেওয়ায়তসমূহ থেকে প্রমাণিত হল- সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরাধিকার ইলম এবং তাঁদের ওয়ারিশ হয়ে থাকেন আলেমগণ। বাকী যা কিছু তাঁরা রেখে যান তা সাদকার মতই। যখন এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আম্বিয়ায়ে কেরামের তর্কা তাঁদের মধ্যে বন্টন হয় না, কেননা তাদের তর্কা হয়ে থাকে ইলম; এছাড়া যা কিছু থাকে তা সাদকাই হয়ে থাকে, অতঃপর এই উক্তি করা যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু সৈয়দা ফাতেমাতুয যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র হক জবরদখল করেছেন এবং বাগে ফাদাক যা হুজুরের উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর ভাগে এসেছিল তা প্রদান করেননি; কি পরিমাণ সীমালঙ্ঘন ও জ্ঞানহীনতার দলীল?
আর যদি ধরে নেয়া হয় যে, বাগে ফাদাক তর্কা হিসেবে বণ্টনযোগ্য ছিল তা হলেও ওতে কেবল সৈয়দার হক ছিল না। কারণ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় তাঁর নয় পত্নী এবং (চাচা) হযরত আব্বাসও ছিলেন। শরীয়তের বন্টন নীতি অনুযায়ী তাঁরা কি হকদার ছিলেন না? নয় পত্নীদের মধ্যে একজন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কন্যা (আয়েশা সিদ্দীকা) এবং হযরত ওমর ফারুকের কন্যা (হযরত হাফসা)ও তো ছিলেন। কি তাঁদের প্রতিও হযরত আবু বকর সিদ্দীকের শত্রুতা ছিল যে, তাঁদের হকও নষ্ট করেছেন? বস্তুতঃ হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু কারোও হক নষ্ট করেন নি, বরং কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক তা খরচ করেছেন।
দ্বিতীয় পর্বে ফাদাক সংক্রান্ত কিছু আপত্তি ও তার অপনোদন সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। ইন শা আল্লাহ
:: ২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ::
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.