অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী
হজ্ব ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত এ ইবাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসে বহু আয়াত ও বাণী বিধৃত হয়েছে। এ মাসের গুরুত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের একান্ত প্রয়োজন। নবম হিজরী সনে হজ্ব ফরজ করা হয়েছে অকাট্য দলিলাদি দ্বারা তা প্রমাণিত। আর্থিক স্বচ্ছলতা, শারীরিক সুস্থতা ও যাতায়াতের নিরাপত্তার শর্তে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর জীবনে একবার হজ্ব পালন করা ফরজ। মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় হজ্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঐক্য ও শৃঙ্খলা ঈমানের দু’টি শাখা। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা মুনাফিক্বীর দু’টি শাখা, ঐক্য জাতীয় উন্নতি অগ্রগতি ও সংহতির প্রতীক। অনৈক্য ধ্বংস ও পতনের মূল কারণ। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
“তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।”
পবিত্র হজ্ব এমন এক মহান পবিত্র ইবাদত যা মুসলিম মিল্লাতকে চিন্তা-চেতনায় ঐক্যের প্রেরণা সঞ্চার করে। হজ্বে বায়তুল্লাহ্ আদায়ের প্রয়াসে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে লাখো লাখো খোদা প্রেমিক মুসলমান নর-নারী। যাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয় “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাইব্বাইক” এটা হচ্ছে আল্ কোরআনের চিরন্তন ঘোষণার বাস্তবরূপ। এখানে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, শাসক-শাসিত, শিক্ষিত- অশিক্ষিত, রাজা-প্রজা, নারী-পুরুষ সকলে একাকার হয়ে যায়, মুছে যায় ভাষা ও বর্ণের সব ব্যবধান। গৌরব-অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকলের কন্ঠে উচ্চারিত হয় তাওহীদ ও রিসালাতের ধ্বনী। স্ব-স্ব সভ্যতা তাহজীব তমুদ্দুন সংস্কৃতি সব বিসর্জন দিয়ে দেহে ধারণ করে ইহরাম নামের শ্বেত শুভ্র একক ইসলামী জাতীয় পোষাক। এটা মুসলিম ঐক্যের এক অনুপম নিদর্শন। ইহরামের শুভ্র লেবাসে আচ্ছাদিত লাখো কন্ঠের উচ্চারিত ধ্বনিতে ভেসে উঠে সার্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। পবিত্র হজ্ব প্রমাণ করে পৃথিবীর দেশে দেশে বসবাসকারী মুসলিম জনতা ভাষা ও বর্ণের বিচিত্র ও ভৌগোলিক সীমারেখা কৃত্রিম বিভক্তি সত্ত্বেও সাম্য শান্তি সম্প্রীতি ও ইসলামে সৌভাতৃত্বের পবিত্র বন্ধনে তারা চির আবদ্ধ। মুসলিম উম্মাহর পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব কলহ, বিবাদ, বিসংবাদ অনৈক্য ও সংঘাতের কারণে খোদা দ্রোহীরা আজ ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পবিত্র হজ্ব খোদাদ্রোহীতার মূলোৎপাঠন, ঈমান-আকীদা তাহজীব তামুদ্দুন সংরক্ষণ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সাধনসহ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন। ইসলামী শরীয়তের বিধানকে বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার কবল থেকে মুক্ত রাখার শপথ গ্রহণের মহা সম্মেলন পবিত্র হজ্ব। সকল প্রকার অন্যায় অনাচার পাপাচার ব্যাভিচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন নিষ্পেষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার এক আন্তর্জাতিক ইসলামী মহা সম্মেলন এই পবিত্র হজ্ব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী আজ নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত; সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে পরষ্পরের মধ্যে রয়েছে বহুমুখী সম্পর্ক। পবিত্র হজ্ব একটি বিশেষ সময়ে একই স্থানে বিশ্বের লাখো লাখো মুসলমানকে একত্রিত করেছে। কাবা কেন্দ্রিক ঐক্যের এই মহাসমাবেশ মুসলিম উম্মাহকে অভিন্ন পন্থায় জীবনের লক্ষ্য অর্জনে প্রেরণা যোগায়। প্রকৃত পক্ষে খানায়ে কাবা ও মদীনা মুনাওয়ারা ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রতম স্থানগুলো মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সৃষ্টির সেতুবন্ধন রচনা করেছে। আল্লাহ্ এক সর্বশেষ প্রেরিত রসূল এক, কাবা এক, কোরআন এক, স্রষ্টার মনোনীত মানবজাতির মুক্তির অবলম্বন পবিত্র ধর্ম আল্ ইসলাম এক। পবিত্র হজ্ব মুসলমানদের জীবনে একত্ববাদের অনুপম শিক্ষা প্রতিবৎসর দ্বীপ্তকন্ঠে ঘোষণা দিয়ে থাকে। খানায়ে কাবার তাওয়াফ, আরাফাত, মিনা, মুযদালাফায় একত্রে অবস্থানসহ পবিত্র হজ্বের করণীয় ও পালনীয় বিধানাবলীর যথার্থ অনুসরণ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের পূর্ণতা এবং বিকাশ প্রস্ফুটিত হয়।
মুসলিম জাতির গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অতীত ইতিহাসের এক অমোঘ বাস্তবতা মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব ও অতীত ঐতিহ্য পূনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াসের বিকল্প নেই। পবিত্র হজ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক অনন্য প্রতীক। জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ, মদীনাতুর রসূল এর প্রতি অকৃত্রিম প্রেম-ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে মুসলিম মিল্লাত অন্তরে লাভ করে এক অনাবিল তৃপ্তি ও আÍপ্রশান্তি। মহিমান্বিত বরকতময় ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান ও নিদর্শনসমূহ স্বচক্ষে অবলোকনে অন্তরাত্মায় অনুভূত হয় এক অপূর্ব শিহরণ ও জাগরণ। খোদাপ্রেম ও নবীপ্রেমের স্নিগ্ধতায় লাভ হয় ঈমানী প্রাণস্পন্দন। আল্লাহ্ আমাদেরকে হজ্বের তাৎপর্য উপলব্ধির তাওফীক নসীব করুন; আমীন।