তারাবীহ’র শারীরিক উপকারিতা

মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান

পবিত্র রমজানে এশার ফরজ ও সুন্নাত নামাযের পর বিশ রাকা’ত তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ । হাদিস শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনানুসারে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

যখন রমযান মাস আগমন করে, তখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়

অপর হাদীসে ইরশাদ হয় ,

যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের/পূন্যলাভের আশার  সাথে রোজা রাখবে ও রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেবেন। [বুখারী ও মুসলিম]

মু’মিনদের জন্য আল্লাহ্‌ তাআ’লার পক্ষ হতে প্রদত্ত মহান নিয়ামতসমূহের মধ্যে একটি বড় নিয়ামত ও মর্যাদাবান উপহার হল তারাবীহ; যাতে অল্প সময়ে অধিক সওয়াব ও ক্ষমা লাভ হয় । প্রত্যেক মুসলমান যে স্বীয় দ্বীনের শিক্ষার উপর নির্ভর করে যথাযথ ভাবে নিয়ম মেনে ইবাদত আঞ্জাম দেয় সে অবশ্যই সফলকাম হবে । একজন মুসলমান ওযুর শুরু হতে নামায পর্যন্ত চলাকালীন সকল  অনুশীলন (তাকবীর,ক্বিয়াম,রুকু,সিজদাহ,বৈঠক ও সালাম) দ্বারা শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা লাভ করে । পবিত্র রমজান মাসে আমরা রোজা রাখি অর্থাৎ , সাহরী হতে ইফতার পর্যন্ত কেবল স্বীয় নফস বা অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করি না বরং শরীরের প্রতিটি অংশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করি । সাহরী হতে ইফতার পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার হতে বিরত থাকি । ইফতারের অর্থাৎ রোজা ভাঙ্গার আগে আমাদের শরীরে সুগার ও ইনসুলিনের মাত্রা নিচে নেমে আসে । যখন আমরা কোন কিছু খাই তখন সুগারের পরিমাণ বাড়তে থাকে যা রক্তে প্রবাহিত হতে থাকে ও পাকস্থলীতে সঞ্চিত হয় এবং এক ঘণ্টা পর শরীরে রক্তে সুগারের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় আর এখান থেকেই তারাবীহর উপকারিতা শুরু হয় । রক্তে প্রবাহিত গ্লুকোজ (শর্করা) কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানিতে পরিবর্তিত হয় ।

তারাবীহ মানুষের শরীরের জন্য এমন এক উপকারী আধ্যাত্মিক অনুশীলন যার মাধ্যমে মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশ উপকৃত হয় । শরীরের প্রতিটি পেশী ও জোড় স্থিরতা পায় । কিছু পেশী সমান হারে ফুলে আর কিছু সমান হারে দেবে যায় । পেশীর অনুশীলনে (নামাযে) শক্তির প্রয়োজন থাকে যার কারণে এক পর্যায়ে পেশীতে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব পরিলক্ষিত হয় । এর মাধ্যমে রক্ত ধমনী খুলে যায় এবং রক্তসঞ্চালন দ্রুত হয় । হৃদপিণ্ডের দিকে রক্ত সহজেই প্রবাহিত হয় আর শরীরের গুরত্বপূর্ণ অংশে ভার তথা রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধির কারনে অভ্যন্তরীণ পেশীতে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় ।

তারাবীহ, যা ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে মহান দান এবং রমজান মুবারকের নির্বাচিত উপহার, এমন এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন রয়েছে যা ঠিকমত সম্পাদনকারীর আয়ু বৃদ্ধি করে । গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করায় যে শারীরিক প্রভাব রয়েছে তা প্রতি ঘণ্টায় তিন মাইল হাটা বা জগিং করার ন্যয় । হাভার্ডে ১৭০০০ ছাত্রের উপর কৃত এক গবেষণায় জানা যায় যে, ১৯১৬ সাল হতে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত যে সকল ছাত্র কলেজে ভর্তি হয় এবং দৈনন্দিন নিয়মমাফিক তিন মাইল হেঁটেছে অথবা জগিং (হালকা দৌড়) করেছে, তারা কেবল সুস্থ ও সবলই নয় বরং তাদের জীবন আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে আশা করা হয়েছিল । যে সকল ছাত্ররা সপ্তাহে দুই হাজার কেজি পর্যন্ত ঘাম ঝড়ায় (হেঁটে , দৌড়ে, অথবা ব্যায়ামের নানা উপকরণ ব্যবহার করে) তাদের মৃত্যুহার তাদের ঐ সাথীদের চেয়ে (যারা শারীরিক ব্যায়াম এড়িয়ে চলত) একচতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ কম ছিল । নিয়মিত নামায আদায়ের মাধ্যমে নামাযীর শরীরে উপকারিতা প্রত্যক্ষ হওয়া ছাড়াও, অন্যান্য শারীরিক কাজেরও অভ্যাস তৈরী হয় যেমন কোন শিশুকে হঠাৎ উত্তোলন করা, চলন্ত বাসে চড়া অথবা অন্যান্য ঘরোয়া ভারী কাজ ইতাদি । বয়ষ্ক ব্যক্তিদের জন্য এই কাজের অনুশীলন জরুরী এই জন্যই যে, তাদের জন্য তারাবীহ এক ধরণের প্রশিক্ষণের নিমিত্ত, তা নিয়মিত আদায়ের মাধ্যমে তারা শারীরিকভাবে সক্ষম ও নানাবিধ শারীরিক পরিশ্রমে নিজেদের সক্ষম পাবেন ।

গবেষণা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নিয়মিত রোজা রাখার পাশাপাশি তারাবীহ আদায়ের ফলেও মানুষ রোগাক্রান্ত হলে দ্রুত সুস্থতা লাভ করে। বয়সের সাথে সাথে সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে মানুষের শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, হাড় দুর্বল ও পাতলা হয়ে যায় । এইদিকে দৃষ্টিপাত করা না হলে হাড়ের একটি সাধারণ ব্যধি ‘অস্টিওপোরোসিস’ এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । এই রোগে পুরষদের তুলনায় নারীরা বেশী আক্রান্ত হয়। এই রোগ থেকে বাঁচতে খাদ্যে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়ামও জরুরী । তারাবীহ নামাযের মাধ্যমেই হাড়ে প্রয়োজনীয় প্রভাব পড়ে এবং যে ব্যক্তি হাড়ের এই রোগ অথবা ব্যাথায় ভুগেন, তাদের জন্য এটা উত্তম সুযোগ যে তারা এই পবিত্র মাসে অন্যান্য নামাযের পাশাপাশি তারাবীহর নামাযও আদায় করবেন এবং স্বীয় দুর্বল হাড়গুলোকে নতুন করে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করবেন । বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীরের চামড়া শুষ্ক ও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ (হৃদপিন্ড,মস্তিষ্ক) এর কার্যকলাপ নেতিবাচক হয়, বয়স্ক লোকেরা অধিকাংশই শারীরিক দুর্ঘটনার শিকার হন । নামায (পাঞ্জেগানা) ও তারাবীহতে বারবার একইভাবে দাঁড়ানো, ঝুকা (রুকু, সিজদা), বৈঠক ও তা থেকে পুনরায় উঠার মাধ্যমে শরীরের নানা অংশে শক্তি সঞ্চালিত হয় । শরীরের নানা অংশের জড়তা দূর হয়ে যায়, রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হওয়ার ফলে হার্টে উপকারিতা পাওয়া যায়, রক্ত সঞ্চালনের ফলে ত্বক উজ্জ্বল-প্রাণবন্ত হয় আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এমনিভাবে তারাবীহ নামায আদায়ের ফলে বয়ষ্ক লোকদের জীবনযাত্রাই পরিবর্তিত হয়ে যায়, তারা সুস্থ সবল জীবন যাপন করতে আরম্ভ করে এবং সাধারণ চোট সমূহকেও পরাভূত করতে সক্ষম হন ।

তারাবীহ ও অন্যান্য নামাযের বহু উপকারিতা বিদ্যমান। অতিরিক্ত ক্যালরি ঘাটানোর মাধ্যমে ওজনে পরিবর্তন আসে এবং শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত মেদ কমে যাওয়ার ফলে হার্ট ও লিভারে উপকারী প্রভাব দেখা দেয় । এই পবিত্র মাসে মানুষ তাদের খাবার পরিমাণমত গ্রহণ করে রোজা রাখে এবং ঠিকমত পাঞ্জেগানা নামায ও তারাবীহ আদায় করে, তবে নিঃসন্দেহে তার অতিরিক্ত ওজন কমে যাবে । আর ওজন কমে যাওয়ার ফলে হার্ট, লিভার,অগ্ন্যাশয় ইত্যাদির রোগ থেকে মুক্ত থাকে । রোজা রাখায় শরীরে হরমোনের বৃদ্ধি অধিক হয়, যেহেতু হরমোন কোলাজন তৈরী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এজন্যে রোজাদার ও তারাবীহ আদায়কারী ব্যক্তির চেহারায় ভাঁজ দেখা যায়না চাই বয়স্কই হোক না কেন । গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তারাবীহ আদায় করার মাধ্যমে নামাযীর অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে । এটা সত্য যে, প্রত্যহ হালকা পাতলা ব্যায়ামের মাধ্যমে অন্তরে , আচরণে ও চিন্তাধারায় ভাল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আর ব্যায়ামের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রাই পরিবর্তিত হয়ে যায়, মানুষ তার ভেতর প্রশান্তি অনুভব করে সব ধরণের মানসিক চাপ ও বিষন্নতা মুক্ত থেকে । বয়স্ক লোকদের উপকারিতা আরও বেশী । তারাবীহ নামাযে আল্লাহর কালাম বারবার শ্রবণ করার ফলে অন্তরে একাগ্রতা ও প্রশান্তি মিলে এবং গুনাহের চিন্তাধারা থেকে মুক্তি মিলে ।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত অধ্যাপক হার্বার্ট বেনসন তার এক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, তারাবীহর নামাযের সময় পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ বারবার শ্রবণের মাধ্যমে এবং আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে শরীরে কম্পন সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি মন-মস্তিষ্ক মন্দ খেয়াল হতে নিবৃত থাকে, এরূপ পবিত্র অবস্থায় ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক হয় এবং শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যা হৃদপিন্ড ও ফুসফুসের কার্যক্রম উন্নত করে ।

পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যাতে নামাযের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি ও শক্তি লাভ হয় । যদি কোন মুসলমান নিয়মমাফিক নামায (পাঞ্জেগানা) ও তারাবীহ (রমজানে) আদায় করে তবে সে জীবনের সব ধরণের কাজেই নিজেকে প্রস্তুত তথা ফিট পাবে । এমনিভাবে একজন নামাযীর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা লাভ হয় । তারাবীহর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর মাধ্যমে একদিকে শরীরের পেশীর উপর প্রভাব পড়ে অন্যদিকে মস্তিষ্ক সব ধরণের চাপ থেকে মুক্ত হয় । পবিত্র রমজানে নিয়মমাফিক তারাবীহ আদায়ের ফলে নিম্নলিখিত উপকারিতা পাওয়া যায় –

১. অতিরিক্ত ক্যালোরি ও ওজন কমে যায় ।

২. হাড় ও মাংসপেশী মজবুত হয় এবং জয়েন্টগুলো স্বাভাবিক হয়ে যায় ।

৩. রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় ।

৪. হৃদক্রিয়া স্বাভাবিক হয় ।

৫. ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন , একাগ্রতায় বৃদ্ধি দেখা যায় ।

৬. স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ হয় ।

৭. মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা হতে মুক্তি পাওয়া যায়।

৮. মানসিক সমস্যার সাথে লড়াইয়ের মানসিকতা তৈরী হয়।

৯. রোগ-বালাই ও অনিদ্রা দূর হয় ।

১০. অন্তরে পরিশুদ্ধতা আসে ।

১১. হার্ট ও হাড়ের রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায় ।

১২. চেহারায় পরিবর্তন আসে ।

এছাড়াও কোন কোন গবেষক এও মনে করেন যে, এর মাধ্যমে বার্ধক্যকেও দমানো যাবে । এবং সুস্থ সবল জীবন যাপন সম্ভব । বুঝা গেল যে, নামায (ফরজ,সুন্নাত,ওয়াজিব,নফল,তারাবীহ) আদায়ের মাধ্যমে এই সুফল পাওয়া সম্ভব এবং এর দ্বারা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনায় কমে যায়। সুতরাং এই মহান পবিত্র রমজান মাসে রোজা, নামায আদায়ের মাধ্যমে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুকম্পা অর্জনের পাশাপাশি উন্নত মন ও স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করুন । বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন !


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

রোজার শারিরিক ও মানসিক উপকারীতা

মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান অনেক মুসলমানই  স্বাস্থ্যজনিত কারণ দেখিয়ে রোজা রাখেন না,অথচ কুরআনে কারীমে রোজা রাখার ব্যাপারে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading