কালিমা তাইয়্যিবা: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মুহাম্মদ জিয়াউল হক রিযভী

আল্লাহ ও রাসূল। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সত্য ও বাস্তব দু’টি নাম। তাওহীদ ও রেসালত একটি অন্যটির পরিপূরক। একজন মুসলিমের জন্য যেভাবে আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয সেভাবে তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার প্রতি ঈমান আনা, শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আনুগত্য সমভাবে আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে ورفعنا لك ذكرك অর্থাৎ এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিকর্তা আর তাঁর রাসূল মুহাম্মদ মোস্ত¡ফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁরই প্রথম সৃষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের বিকাশ ও পরিচয় রাসূলের মাধ্যমেই হয়েছে। আর রাসূলের ইলাহ (মাবূদ) হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই কালিমা তাইয়্যিবায় (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ) আল্লাহর নামের পাশে তার রাসূলের নামের সংযোজন শোভা পাচ্ছে। এ কালিমায় দু’টি অংশকে (বাক্যকে) মিলিয়ে দূরত্ব ও ব্যবধান ছাড়া একটি সার্থক বাক্যে পরিণত করা হয়েছে। প্রথমাংশ কলেমা-ই লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ(لاَ اِلهَ إِلاَّ اللهُ) আর দ্বিতীয়াংশ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ)। আর প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশ। অর্থাৎ এক আল্লাহর একত্ববাদের পূর্ণ পরিচিতি কেবল নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব।
সাম্প্রতিককালে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী আলিমের আলখেল্লা পরিধান করে কিছু ব্যক্তি তাওহীদ-রিসালতের মূলবাণী কালিমা তাইয়্যিবার ধরণ ও অবকাঠামো নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য শুরু করেছে। মিডিয়া এবং মাঠে-ময়দানের আলোচনা-বক্তব্যে সরলমনা মুসলিম ভাই-বোনদের আকীদা-বিশ্বাসে দারুণভাবে আঘাত হানছে। তারা বলতে চায়- বর্তমানে কালিমা তাইয়্যিবার অবকাঠামো রাসূল,সাহাবী ও তাবঈদের যুগে ছিল না, আল্লাহর নামের পাশাপাশি রাসূলের নাম থাকা দারুণ আপত্তিকর, কুরআন-হাদীসের কোন জায়গায় এ কালিমার অস্থিত্ব নেই। এভাবে কত অপাংক্তেয় প্রশ্ন ছুঁড়ে মেরে মুসলিম জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। এমন বে-ঈমানী বক্তব্য গাইরে মুকাল্লিদ ও সালাফীরাই করছে। তারা আজ মুসলিম জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে দারুণভাবে। ইহুদী-নাসারা নিঃসন্দেহে তাদের দোসরদের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে ধর্মহীন করার অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। আমি আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন-হাদীসের অকাট্য প্রমাণ দিয়ে তাদের খন্ডন করে কালিমা তাইয়্যিবার উপর নাতিদীর্ঘ আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।

  • কালিমা তাইয়্যিবার শাব্দিক ও পারিভাষিক বিশ্লেষণ

‘কালিমা তাইয়্যিবা’ (طيبة كلمة) একটি বিশেষণমূলক যৌগিক শব্দ। আরবি ভাষায় كلمة শব্দটি একবচন। শব্দটির বহুচন কালিমুন (كلم)। পবিত্র কুরআনে শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ইরশাদ হচ্ছে- (وَاِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ) অর্থাৎ এবং তাঁরই দিকে (আল্লাহ তা‘আলার দিকে) পবিত্র শব্দ উত্থিত হয়। অভিধানপ্রণেতাদের মতে কালিমা শব্দটির শাব্দিক অর্থ- অর্থবিশিষ্ট একক শব্দ। আবার এটি একটি সার্থক বাক্যকেও বুঝায়। এভাবে ভাষণ,বক্তব্য,প্রবন্ধ ও কাসীদার জন্যও কালিমা শব্দ ব্যবহার হয়। এ অর্থেই আরবরা তাওহীদের বাণী অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ مُحَمَّدُ رَّسُوْلُ اللهِ) কালিমা বলে। কুরআনুল কারীমের নিম্নলিখিত আয়াত দু‘টিতে কালিমা শব্দটি বাক্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন- أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ অর্থাৎ আপনি কি লক্ষ করেননি,আল্লাহ কিভাবে উপমা দিলেন পবিত্র বাক্যের? যেমন পবিত্র বৃক্ষ,যার মূল সুদৃঢ় এবং শাখা প্রশাখা আসমানে।

(খ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ অর্থাৎ এবং অপবিত্র বাক্যের উপমা যেমন একটি অপবিত্র বৃক্ষ,যা ভূপৃষ্ঠের ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়েছে এখন সেটার কোন অবস্থা নেই।

আর طَيِّبَةً শব্দটি طَيِّبَ-এর স্ত্রীলিঙ্গ। শাব্দিক অর্থ- পূত:পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত। আরবি ভাষায় কল্যাণ,শান্তি ও সমৃদ্ধিমূখর শহরকে بلدة طيبة (বলদাতুন তাইয়্যিবিয়া) বলা হয়। ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় তাওহীদ ও রিসালতভিত্তিক পূত:পবিত্র বাণীকে কালিমা তাইয়্যিবাহ্ বলা হয়। আর তা হল لااله الا الله محمد رسول الله (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)। এ কালিমায় দু‘টি অংশ রয়েছে যথা ক. উলূহিয়্যাত তথা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কীয় (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ) এবং খ. রিসালত তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা সম্পর্কীয় বাক্যকে- মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে উলূহিয়্যাত ও রিসালত সম্পর্কীয় উভয় বিষয় সম্বলিত জ্ঞানকে কালিমা তাইয়্যিবাহ্ বলে ঘোষণা করেন। ইরশাদ হচ্ছে- أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা আবূ বকর আল্-জাযায়িরী বলেন, এখানে কালিমা তাইয়্যিবা দ্বারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ উদ্দেশ্য, যেটি মুসলমানদের মূল কালিমা।

  • কুরআনের আলোকে কালিমা তাইয়্যিবায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র পাশে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’র ব্যবহার

কুরআনুল কারীম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী ঐশীগ্রন্থ; যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্ত¡ফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের আয়াতে আয়াতে এবং সূরায় তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান ও আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। এক কথায় ঈমানের মূলভিত্তি রচিত হবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান ও অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পার্থক্য ও দূরত্ব বজায় রাখা কুফরির শামিল। দুঃখের সাথে বলতে হয়, যেখানে আল্লাহ’র সাথে ও পাশে একমাত্র তাঁর রাসূলের নাম সংযোজন থাকা একজন মুসলিমের ঈমান ও যৌক্তিক দাবী, সেখানে আল্লাহ’র নামের পাশে দূরত্ববিহীন তাঁর রাসূলের নাম (মূল অথবা গুণবাচক) লিখা বা সংযোজন করাকে শিরক বলা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। আসলে এরা হলো আলিম বা মুসলিম বেশে নব্য আবূ জাহল, আবূ লাহাব, ইবন উবাই এবং ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা। তাদের পূর্ববর্তীরাও এভাবে ইসলাম, রাসূল এবং কুরআনুল কারীমের বিকৃত ও অপব্যাখ্যার প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদেরসমূহ ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে- يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَঅর্থাৎ তারা (কাফিররা) আল্লাহর নূর (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা) কে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহ তায়ালাই তার নূরকে পূর্ণতাদাতা, যদিও কাফিররা অপছন্দ করে।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে ৪০টি আয়াতে নিজের নামের পাশাপাশি তাঁর রাসূলের নাম উল্লেখ করেছেন। এতদ্ সংক্রান্ত কিছু আয়াত পেশ করা হলো:

১. وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا

২. قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ

৩. مَا آَتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ
৪. لا تقدموا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ

৫. وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا

উপরে বর্ণিত আয়াতসমূহ সহ কুরআনুল কারীমের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমানের সাথে সাথে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওপর ঈমান ও আনুগত্যের উপর সমভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটা এ কথাই বুঝায়, কালিমা তাইয়্যিবায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (لا اله إلا الله)-এর পাশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (محمد رسول الله) এক সাথে হওয়াই অপরিহার্য।

পবিত্র কুরআনুল কারীমের আলোকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হল কালিমা তাইয়্যিবার অস্তিত্ব। তবে যদি প্রশ্ন করা হয় কুরআনুল কারীমেতো উভয় অংশ পৃথকভাবে উল্লেখ আছে সাথে উল্লেখ নেই। এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যাবে- শরী‘আত প্রবর্তক রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এ রকম অনেক পৃথক পৃথক বিষয়কে একত্রিত করে বিন্যস্ত করেছেন। তাই মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদগণ (কুরআন-সুন্নাহর গবেষকগণ) এ একত্রিতকরণের ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। অতএব প্রমাণিত হলো- কালিমা তাইয়্যিবা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (لا اله الا الله محمد رسول الله)।

  • হাদীসের আলোকে কালিমা তাইয়্যিবায় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র পাশে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ থাকার প্রমাণ

ইমাম বায়হাক্বী ও ইমাম ত্বাবরানীসহ অসংখ্য মুহাদ্দিছ হযরত ‘ওমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন-

عن عمر بن الخطاب رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لما اقترن آدم الخطئية قال يا رب بحق محمد غفرت لي كيف عرفت محمدا قال لانك لما خلقتني بيدك ونفخت من روحك رفعت راسي على قوائم العرش مكتوبا لا اله الا الله محمد رسول الله فعلمت انك لم تضف الى اسمك الا احب الخلق اليك قال صدقت يا آدم ولو لا محمدا ما خلقتك

অর্থাৎ হযরত ‘ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন- হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ভুল স্বীকার করত আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আরয করলেন, হে আমার প্রতিপালক,আমাকে আপনি (আপনার রাসূল) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওসীলায় ক্ষমা করুণ। তখন আল্লাহ আমাকে বললেন,হে আদম! তুমি (আমার নবী) মুহাম্মাদকে কিভাবে চিনলে? হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম বললেন- আপনি আমাকে আপনার কুদরতের হাতে সৃষ্টি করে যখন আমার ভিতর রূহ প্রদান করলেন, তখন আমি মাথা উঁচিয়ে আরশে আযীমে দেখতে পেলাম যে,তাতে লিখা আছে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (لا اله الا الله محمد رسول الله। এতে বুঝতে পারলাম,সৃষ্টির সবচেয়ে প্রিয় বস্তুই আপনার নামের পাশে সংযোজন করেছেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, হে আদম, তুমি ঠিক বলেছ। আমার নবী মুহাম্মদিকে সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।

عن يونس بن صهيب عن عبد الله بن بريدة عن ابيه قال انطلق ابو ذر ونعيم ابن عم ابي ذر وانا معهم يطلب رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو مستقر بالجبل فقال له ابو ذر يا محمد اتيناك لنسمع ما تقول قال اقول لا اله الا الله محمد رسول الله فامن به ابو ذر وصاحبه

অর্থাৎ প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা ইবন হাজর ‘আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত ইউনুস ইবন সোহাইব আব্দুল্লাহ ইবনে বোরাইদা থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সাহাবী হযরত আবূ যার এবং তার চাচাত ভাই হযরত আবূ নু‘আয়ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সন্ধানে বের হলেন। তখন আমিও তাঁদের সাথে ছিলাম। এমতাবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্জনে কোন পাহাড়ে একাকী ছিলেন। অতঃপর তিনি রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘‘হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা) (এ আহবান রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে নাম ধরে আহবান করার নিষেধ সম্পর্কিত হুকুম আসার পূর্বেকার) আমরা আপনার কথা মনোযোগ সহকারে শুনার জন্য এসেছি। অতঃপর রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন, আমি এ কথাই বলছি, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (لا اله الا الله محمد رسول الله) অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এর পরপরই আবূ যার এবং তার সাথী (তাঁর চাচাত ভাই) এই কালিমার ওপর ঈমান আনলেন।

৩. ইবনে ‘আদী ও ইবনে ‘আসাকির খাদিমুর রাসূল হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি মি‘রাজ রাতে ‘আরশের পায়ায় কালিমা তাইয়্যিবাটি অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লিখিত অবস্থায় দেখতে পেয়েছি।

৪.প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ইমাম আবূ নূ‘আইম হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন, বেহেশতের প্রতিটি গাছের পাতায় লেখা আছে, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাল্লাহ’ (لا اله الا الله محمد رسول الله)।

৫. ইমাম ইবনে ‘আসাকির প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবন আব্দিল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন: বেহেশতের দরজায় লিখা আছে: (لا اله الا الله محمد رسول الله) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

৬.হযরত আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু’র অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, আল্লাহ তা‘আলা যখন বেহেশত সৃষ্টি করার পর (আর এটা হলো বেহেশতের মধ্যে প্রথম সৃষ্টি) একে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার বেহেশত, তুমি কথা বল। এরপরই বেহেশত বলে উঠল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। (لا اله الا الله محمد رسول الله)।

৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পতাকা ছিল কালো এবং এর নিশান ছিল সাদা। আর এ পতাকায় লিখা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ رسول الله لا اله الا الله محمد।

উপরিউক্ত হাদীসসমূহ প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী থেকে সংগৃহীত। এ হাদীসগুলো এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রত্যয়ন করছে যে, কালিমা তাইয়্যিবা হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (لا اله الا الله محمد رسول الله)। অতএব, এ কালিমায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নাম ‘মুহাম্মদ’ শব্দটি একই লাইনে আল্লাহ’র নামের পাশে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ কালিমায় ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ মহিমান্বিত পাশাপাশি লিখা হয়েছে। সুতরাং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (محمد رسول الله) বাক্যটির ক্ষেত্রে কোন আপত্তি নেই। শুধু তা নয়, তাফসীর ও হাদীছের কোন গ্রন্থে উভয় অংশে উপরে-নীচে লিখা আছে বলেও কোন প্রমাণ নেই এখানে অতি দুঃখের সাথে লক্ষণীয় যে, এসব হতভাগা নিজেদেরকে তথাকথিত ‘আহলে হাদীস’ দাবী করে। অথচ সহীহ্ হাদীস সম্পর্কে না তাদের কোন জ্ঞান আছে, না হাদীসের উপর ঈমান আছে। ইসলামের কলেমা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেও তাদের বুক কাঁপে না, কাফিরদের খুশী করার জন্য তারা এতটুকু নিচে নামতে পারে।

  • কালিমা তাইয়্যিবায় ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ থাকার আপত্তি

সম্প্রতি কিছু আলিমধারী লোক মৌখিকভাবে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমানের কথা বলে, কিন্তু কালিমা তাইয়্যিবাকে মানতে নারায। কালিমা তাইয়্যিাবাকে নিয়ে এমন মারাত্মক ও বিস্ময়কর। এ আপত্তি তাদের পূর্ববর্তীদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। এমনকি এখন উত্তরসূরিরা পূর্ববর্তীদেরও ডিঙ্গিয়ে অনেক মাত্রায় এগিয়ে। ফলে তারা (উত্তরসূরিরা) ঈমানের মূল বাণী কালিমা তাইয়্যিবার বিরুদ্ধে আঘাত হানার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

نقل كفر نيست কারো খন্ডনের জন্য কুফরী বাক্য উদ্ধৃত করাতে দোষ নেই। সুতরাং আহলে হাদীস লা-মাযহাবী ভ্রান্তদের কিছু আপত্তি নিম্নে উদ্ধৃতি করার প্রয়াস পাচ্ছি:

ক. কালিমা তাইয়্যিবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (لا اله الا الله محمد رسول الله) কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নেই। শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লা’র বর্ণনা আছে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা’র বর্ণনা নেই।

খ. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র পাশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লিখা ছিলনা, বরং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ একটু নিচে লিখা ছিল।

গ. রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নুবূওয়্যাতের মোহরে কালিমা তাইয়্যিবা ছিল না। শুধু লেখা ছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ,তাই কালিমা তাইয়্যিবার কোন অস্তিত্ব নেই ইত্যাদি। তারা তাদের পক্ষে নিম্নলিখিত হাদীসগুলো পেশ করার ধৃষ্ঠতা দেখায়:
১.عن عثمان رضى الله عنه قال قال رسول الله من مات وهويعلم انه لا اله الا الله دخل الجنة
অর্থাৎ হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন মাবূদ নেই’ এ কথায় বিশ্বাস রেখে মৃত্যুবরণ করবে সে বেহেশতের প্রবেশ করবে।
২. عن معاذ بن جبل من كان أخر كلامه لا اله الا الله دخل الجنة
অর্থাৎ হযরত মু‘আয ইবন জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির জীবনের শেষ বাক্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতিত কোন মাবূদ নেই)’ হবে, অর্থাৎ এ কালিমা উচ্চারণের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করবে,তাহলে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে।

এক কথায় তারা (বিরোধী পক্ষরা) ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ উল্লেখ আছে এমন সব হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকে।

  • খন্ডন

প্রিয় পাঠক! এ বিরোধী পক্ষের (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধীর) কুরআন-হাদীস ও আরবি ব্যাকরণের ন্যূনতম জ্ঞানও নেই। আসলে তাদের মাকড়সার জাল সদৃশ খোঁড়া যুক্তি আহলে হক বা সত্যপন্থীদের শানিত তলোওয়ারের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে ও হতে থাকবে।

তাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উক্ত হাদীসের ব্যাখায় বলেন- রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যাক্ত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সম্পর্কে জেনে মৃত্যুবরণ করবে অবশ্যই সে বেহেশতে প্রবেশ করবে। لا اله الا الله বাক্যটি শাহাদাতের দুই কালেমার মূল নাম। এ জন্য এ হাদীসে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ (محمد رسول الله) উল্লেখ না করে শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র لا اله الا الله উপর সংক্ষেপ করা হয়েছে। এ হাদীসের শিক্ষা হলো- মূলত কালিমা তাইয়্যিবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লুল্লাহ (لا اله الا الله محمد رسول الله) সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখানেও ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ মানে পূর্ণ কলেমাই। অর্থাৎ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্’।

খ. খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ ‘উমদাতুল কারী’র প্রণেতা মহোদয় বলেন, আবূ হারব ইবন খালিদ জুহানী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি আমার পিতার ব্যাপারে সাক্ষী দিচ্ছি, তিনি বলেছেন রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এ আহবান করার জন্য আদেশ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষী দেবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ হাদীসের ব্যাখায় আল্লামা কিরমানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাদীসে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উল্লেখ থাকলেও উদ্দেশ্য হলো এ বাক্যের পরিপূরক ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ সহকারে বলা। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়- ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্যটি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাথে রয়েছে।

গ. আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন
فان قلت هل يكفي مجرد قول لا اله الا الله دون محمد رسول الله قلت لايكفي لكن جعل الجزء الاول من كلمة الشهادة شعارا لمجموعها فالمراد بتمامها كما تقول قرآت (آلم وذلك الكتاب) أي السورة بتمامها
অর্থাৎ যদি তুমি প্রশ্ন কর ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ ব্যতীত ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যটি যথেষ্ট হবে কি? তখন আমি উত্তরে বলবো, না, কখনো যথেষ্ট হবে না। কিন্তু কালিমার প্রথমাংশ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে (لا اله الا الله) পূর্ণ কালিমা শাহাদাতের নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য হবে পূর্ণ কালিমা অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (لا اله الا الله محمد رسول الله)। যেমন তুমি বল- আমি আলিফ লাম মীম, পড়েছি। তখন এ বাক্যের মমার্থ হবে- ‘সূরা বাকারা’ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেছি। আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আইনীর ব্যাখ্যায় এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে সব হাদীসে শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উল্লেখ আছে সে হাদীসসমূহে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অংশটি বিদ্যমান আছে। শুধু কথার সংক্ষেপের জন্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ব্যবহার করা হয়।

ঘ. মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম নাওয়াভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি কালিমা তাইয়্যিবায় শুধু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র (لا اله الا الله) উপর সংক্ষেপ করবে এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (محمد رسول الله) বলবে না, তখন এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আমাদের সকল আলিমের বক্তব্য হলো- সে ব্যক্তি মুসলমান হবেন। আমাদের থেকে কিছু আলিম বলেন, সে ব্যক্তি এ শর্তে মুসলমান হবে, যদি সে ‘মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ’ (محمد رسول الله) অংশের ও শাহাদাত বা সাক্ষ্য দেয়। পক্ষান্তরে, যদি সে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (محمد رسول الله) অংশটি মানতে অস্বীকার করে তবে তাকে মুরতাদ্ বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করতে হবে।

আল্লামা শরফুদ্দীন ইমাম নাওয়াভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র এ ব্যাখায় স্পষ্টতর হয়ে উঠে, যে সকল হাদীসে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (لا اله الا الله) অংশ উল্লেখ আছে ঐ সব হাদীসে কালিমা তাইয়্যিবাকে সংক্ষেপ করা হয়েছে। কারণ ‘লা-ইলাহা ইল্লাহ’র সাথে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (محمد رسول الله) অসংখ্য বর্ণনায় পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ, নিম্নে একটি হাদীস পেশ করা হলো।
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم امرت ان اقاتل الناس حتى يشهدوا ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله
অর্থাৎ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেন, আমি এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছি, যেন মানবজাতি এ কথার সাক্ষ্য না দেয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন মা’বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা আল্লাহ তা‘আলার রাসূল”।

ঙ. বিশ্ববরেণ্য হাদীস বিশারদ কাযী ‘আয়াদ্ব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মুহাম্মাদুর রাসূল্লাল্লাহ (محمد رسول الله) অংশটির কুরআনুল কারীমের –ورفعنا لك ذكر আয়াত দ্বারাও প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন-
ورفعنا لك ذكرك قال يحيى بن آدم بالنبوة وقيل اذا ذكرت ذكرت معي قول لا اله الا الله محمد رسول الله و قيل في الاذان
অর্থাৎ (আমি আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি)। হযরত ইয়াহয়া ইবনে আদম বলেন, নুবূয়াতের মাধ্যমে রাসূলের স্মরণকে সমুন্নত করা হয়েছে। কারো কারো মতে,আয়াতের অর্থ হলো- কালিমা তাইয়্যিবায় অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র মাধ্যমে যেমনিভাবে আমি আলোচিত হয়েছি, সাথে সাথে আপনিও আলোচিত হয়েছেন।
দ্বিতীয়ত কালিমা তাইয়্যিাবার বিরোধীরা আমাদের প্রতি দ্বিতীয় আপত্তি উত্থাপন করে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর পাশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লিখা ছিল না; বরং একটু নিচে লিখা ছিল। প্রিয় পাঠক! এ প্রশ্নের মধ্যে তারা কিন্তু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (لا اله الا الله محمد رسول الله) কে কালিমা তাইয়্যিবা হিসাবে মেনে নিয়েছে। তবে তারা আরেকটি প্রশ্ন যোগ করল- ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অংশটি পাশাপাশি লিখা ছিল না, বরং নিচে লিখা ছিল। আসলে তাদের এ প্রশ্নও অবান্তর ও ভিত্তিহীন। কারণ ইতোপূর্বে উল্লিখিত দলিলসমূহ এ কথাই প্রমাণ করে, তাফসীর ও হাদীসের কোন গ্রন্থের মধ্যে কালিমা তাইয়্যিবার উভয়ের অংশের মাঝখানে যেভাবে কোন দূরত্বের কথা উল্লেখ নেই তেমনি উপর-নিচের কথাও উল্লেখ নেই।

তৃতীয়ত রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নুবূয়াতের মোহরটি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে নবী ও রাসূল হওয়ারই উজ্জ্বল প্রমাণ ও সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর এতে লিখা ছিল ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ যা কালিমা তাইয়্যিবার মূল অংশ। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অংশ মোহরে উল্লেখ না থাকার কারণ হলো- যেহেতু একমাত্র প্রিয় রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাই আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা প্রদানকারী আর এ ঘোষণা প্রদানকারীই হলেন সেই সত্তা যার মুবারক পৃষ্ঠদেশে অংকিত আছে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। তাছাড়া, হুযূর-ই আক্রামের বিশ্বস্থ মোহরটি তিন লাইনে বিন্যস্থ ছিল। ১ম লাইন- আল্লাহ (الله) ২য় লাইন ছিল-রাসূলুন (رسول) এবং ৩য় লাইন ছিল- মুহাম্মাদুন (محمد)। আমরা জানি রাষ্ট্রিয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে স্বদেশীয় প্রতীকী হিসেবে মোহরের ব্যবহর অনস্বিকার্য। তাই ব্যবহারের সুবিধার্থে এর আকার ও অবয়ব দৈর্ঘ্য না হয়ে গোলাকারই করা হয়। এরই কারণে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অংশটিকে উপরে-নিচে করে লিখা হয়েছে; তবে তা এ আশংকায় নয় যে,আল্লাহ শব্দের পাশাপাশি রাসূলের নাম লিখলে ও সংযোজন করলে শির্ক হয়ে যাবে।

পরিশেষে বলতে চাই, কালিমা তাইয়্যিবার বিরোধীদের নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করার কোন যুক্তি নেই। তারা সরলমনা মুসলমানদেরকে ঈমানহারা করতে চায়। এমন ষড়যন্ত্রকারীদের এমন খোড়াযুক্তি মোঘল সম্রাট আকবরের ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ ও স্বভাবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্রাট আকবর তাঁর সাম্রাজ্য পাকাপোক্ত করার জন্য ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ নামক ধর্মহীনতার জন্ম দিয়েছিলো। তিনি কালিমা তাইয়্যিবাকেও সম্পূর্ণ বিকৃত করেছেন। তাঁর কালিমার স্বরূপ ছিল- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবারু খলীফাতুল্লাহ’। অর্থাৎ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অংশকে বাদ দিয়ে তদস্থলে যোগ করে দেন আকবারু খলীফাতুল্লাহ, (আকবার আল্লাহর খলীফা) না‘আউযু বিল্লাহ! এ কালিমাটি ইসলামবিরোধী হওয়ায় তৎকালীন বিশ্ববরেণ্য আলিম মুজাদ্দিদ-ই আলফি ছানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন ফলে সম্রাট আকবরের রাজ প্রাসাদ প্রকম্পিত হয়ে উঠে এবং তিনি তাঁর ইসলামবিরোধী কালিমা পরিবর্তন করে মূল কালিমা মেনে নিতে বাধ্য হন। অত:পর ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কে তিনি ইসলামের কালিমা তাইয়্যিবা হিসেবে মেনে নিয়ে ছিলেন।। তাই কালিমা তাইয়্যিবার বিরোধীদের এ কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে এখনো মোজাদ্দিদ- ই আলফি ছানীর অনুসারীরা অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বেঁচে আছেন। তাঁদের দীপ্তিময় ঈমানের হুংকারে এ দেশের ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ‘দ্বীন-ই ইলাহী’র বাতুলতা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কালিমা তাইয়্যিবার উপর অবিচল আস্থা রেখে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুক। আমীন।

লেখক: প্রভাষক, আল্-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া, চট্টগ্রাম।


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

বইঃ নবীগণ সশরীরে জীবিত (ফ্রী ডাউনলোড)

নবীকূল সর্দার, রাসূলগণের ইমাম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এবং অন্যান্য নবী রাসূলগণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading