বর্তমানে পাপ ও পতনের চরমে পৌঁছেও মানব সভ্যতা প্রতি মুহূর্তে নানান বিপর্যয়ের মুখোমুখী। এইডস্, ডেঙ্গু, ইবোলা, নিপা, জিকা, কতো নাম-জাতের রোগেই না আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বর্তমান সময়ে এমনই একটি রোগের নাম করোনা । করোনা রোগের বিস্তারের গতি দেখলে যে কোনো মানুষ থ হয়ে যাবে। করোনা মোকাবিলার জন্য এখন সেনাবাহিনী তলব করতে হচ্ছে। দেশে দেশে সমস্ত কিছু অচল করে মানুষকে ঘরের ভেতর দিনরাত কাটাতে বাধ্য করছে। সরকার তার মোকাবিলার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিচ্ছে। সরকার প্রধানরা সারাক্ষণ টেলিভিশনের সামনে এসে মানুষকে প্রতিটি পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করছে। পার্লামেন্টে সকল দল একমত হয়ে আইন পাশ করছে। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছে। সারা দুনিয়া ক্রিকেটের স্কোর বোর্ডের মত করোনার স্কোর বোর্ড দেখছে।
অতীতে কোনো বিশ্বযুদ্ধও মানুষকে এত ভাবিয়ে তুলতে পারেনি। অথচ মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার। দুনিয়ার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে কোটি কোটি মানুষকে সে কাবু করে ফেলেছে। সে যে দেশেই ঢুকছে সে দেশকেই নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। চীনসহ বিশ্বের দেশে দেশে বর্তমান আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই বিশ্ব জুড়ে জারি করেছে সতর্কতা।
আসলে ‘করোনা’ হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার এক পরীক্ষার নাম । মহান আল্লাহর শ্রেষ্টতম সৃষ্টি মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে যায়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখনই আল্লাহর গজব নেমে আসে শান্তির পৃথিবীতে। মানব সভ্যতায় অনাচার অশ্লীলতার বৃদ্ধির ফলে নেমে আসছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বলেন “যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ্যভাবে চলতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ এবং এমন অভিনব দুরারোগ্য ব্যাধি দেওয়া হয়, যা তাদের পূর্বপুরুষেরা কখনো শোনেনি” (মুসনাদে দায়লামি)
করোনা প্রসঙ্গে আজো আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র বাণী তাৎপর্যপূর্ণ। রোগ-শোকের মাধ্যমে মু’মিনকে পরীক্ষা করা হয়, এতে তার ঈমানিশক্তি বৃদ্ধি পায়। রোগের মধ্যেও পাওয়া যায় কল্যাণের বার্তা। যেমন: একদা প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হযরত আবু হুরাইরাকে রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সঙ্গে নিয়ে জ্বরের রোগী দেখতে যান। তিনি সেখানে গিয়ে বলেন “সুসংবাদ গ্রহণ করো ! আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘আমার আগুন দুনিয়াতে আমি আমার মু’মিন বান্দার ওপর প্রবল করি, যেন তা আখিরাতের আগুনের বিনিময় হয়ে যায়’” (তিরমিযি)।
মহামারি সাধারণত বান্দাকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে অন্যতম একটি গযব। এই গযব হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রিয় রাসূল (ﷺ)’র পক্ষ হতে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে- মহামারির সময় আযান প্রদান করা। প্রিয় দর্শক ! আযান ইসলামের এক মৌলিক ইবাদত। আযান এর মাধ্যমে নামাজের দিকে আহবান করা হয়। তাছাড়া আযানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার রহমত অবতীর্ণ হয়, বিপদ ও আযাব দূরীভূত হয়। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে হুযুর (ﷺ) এরশাদ করেন- “اِذَا اُذِّنَ فِیْ قَرِیَةٍ اٰمَنَھَا اللہُ مِنْ عَذَابِهٖ فِیْ ذٰلِكَ الْیَوْمِ” যখন কোন গ্রামে আযান দেয়া হয়, তখন মহান আল্লাহ (ﷻ) সেদিন ওই গ্রামকে তার আযাব থেকে নিরাপদে রাখেন। [আল-মু’জামুল কবীর-১/২৫৭ হাদিস ৭৪৬ ]
এছাড়াও মহামারীর সময় আযান দেয়া একটি মুস্তাহাব আমল। ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রদ্দুল মুখতার বা ফতোয়ায়ে শামীতে আযানদানের ১০টি মুস্তাহাব সময় বলা হয়েছে । সেই ১০টি জায়গা হচ্ছে যথাক্রমে-
১. সন্তান জন্ম নিলে
২. কোন মহামারী দেখা দিলে
৩. আগুন লাগলে
৪. জ্বিন দূরীভূত করা
৫. মানসিক রোগী
৬. কেউ রাস্তা হারিয়ে ফেললে।
৭. কোন হিংস্র জানোয়ার এর আক্রমণ রোধ করার জন্য।
৮. কেউ অতিরিক্ত রাগান্বিত হলে
৯. কোন এলাকায় মহাদূরভিক্ক দেখা দিলে
১০. ইন্তেকালের পর কবরের পাশে।
প্রিয় পাঠক ! এখানে যেই ১০ টি সময়ে আযান দেয়া মুস্তাহাব, তার মধ্যে মহামারীর সময়েও আযানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
মহামারির সময়ে আযান প্রসঙ্গে চতূর্দশ শতাব্দির মহান মুজাদ্দিদ ইমামে আহলে সুন্নাত, শাহ ইমাম আহমদ রেজা খান রাহিমাহুল্লাহ লিখেন- ”وبا کے زمانے میں اذان دینا مستحب ہے“ – মহামারীর সময় আযান দেয়া মুস্তাহাব। [ফতোয়ায়ে রযভীয়্যা ৫/৩৭০ ]
মহামারির সময় আযান দেয়ার কারণ হচ্ছে- এই সংকটপূর্ণ অবস্থার কারণে জনমনে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন থাকে, ভীতি ও ত্রাসের শিকার হয়, এমন অবস্থাতে আযান আত্নার প্রশান্তি ও ভয়-ত্রাস দূর করার এক অন্যতম মাধ্যম। আবু নাঈম ও ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর (ﷺ) ইরশাদ করেন, نَزَلَ آدَمُ بِالْھِندِ فَاسْتَوْحَشَ فَنَزَلَ جِبْرَئِیْلُ عَلَیْه الصَّلَاۃُ وَالسَّلَام فَنَادیٰ بِالْاَذَاَنِ- যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে ভারতবর্ষে অবতরণ করলেন,ভীত-সন্ত্রস্থ হলেন,তখন জিবরাইল আলাইহিস সালাম আসমান থেকে নেমে (ভয় দূর করার জন্য) আযান দিলেন। [হিলয়াতুল আউলিয়া ২/১০৭ হাদিস: ২৯৯]
মুসনাদুল ফিরদৌসে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী আল-মুরতাদ্বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- قَالَ رَایٰ النَّبِیُّ صَلّٰی اللہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَسَلَّم حُزِیْناً فَقَالَ یَا ابْنَ اَبِیْ طَالِبٍ اِنِّیْ اَرَاكَ حُزِیْناً فَمُرْ بَعْضَ اَھْلِكَ یُؤَذِّنُ فِیْ اُذُنِكَ فَاِنَّهٗ دَرْءُ الْھَّمِ -তিনি বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আমাকে চিন্তিত অবস্থায় দেখে বললেন, হে আলী! আমি তোমাকে উদ্বিগ্ন অবস্থায় দেখছি, তোমার পরিবারের কাউকে তোমার কানে আযান দিতে বলো, কেননা তা চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা দূরকারী। [মিরকাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, আযান পর্ব ২/১৪৯ ]
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারি থেকে রক্ষায় অন্যান্য আমলের পাশাপাশি আযান দেয়া একটি শরীয়ত সমর্থিত মুস্তাহাব আমল। এটার জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। তাই এই মহামারি থেকে পরিত্রাণ লাভে ও আল্লাহর রহমত কামনায় আমাদের উচিত দৈনিক অন্তত একবার করে হলেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে আযান প্রদান করা। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এই আমলের তাওফিক নসীব করুন। এবং উনার প্রিয় হাবীব (ﷺ)’র উসীলায় মুসলিম মিল্লাতকে সকল প্রকার বিপদাপদ ও মহামারী থেকে হেফাজত করুন। আমীন। বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.