খতিবে পাকিস্তান, শাইখুল হাদিস আল্লামা শফি উকাড়ভী রাহিঃ
ভাষান্তরঃ মাওলানা মুহাম্মদ মহিউদ্দীন
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার নাজরান অঞ্চলের খ্রীস্টানদের একটি প্রতিনিধিদল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের খেদমতে বহস করার উদ্দেশ্যে হাজির হল। তারা এসে আরজ করল, আপনি হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম সম্বন্ধে কি বলেন?
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমালেন, “তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর বাণী যা সতি-সাধ্বী কুমারী মারয়ামের প্রতি পাঠানো হয়েছিল।” তারা বলল, তিনি তো আল্লাহর পুত্র। তিনি ফরমালেন, তা কিভাবে? তারা বলল, আপনি এমন কোন বান্দাও দেখেছেন যে পিতা ছাড়া জন্মগ্রহণ করেছে? হুজুর ফরমালেন, যদি তিনি আল্লাহর পুত্র হওয়ার এটাই দলীল হয়ে থাকে তা হলে সর্বাগ্রে আদম আলাইহিস্ সালাম সম্বন্ধে তোমাদের এই আক্বীদা পোষণ করা উচিৎ। কেননা তিনি তো মাতা-পিতা দু’জন ছাড়াই সৃষ্ট হয়েছিলেন আর ঈসা আলাইহিস্ সালামের তো মা হলেও ছিল। তাদের নিকট এর যুক্তিসঙ্গত কোন উত্তর ছিল না। তা সত্ত্বেও তারা একগুঁয়েমি করতঃ তর্ক করতে লাগল। তখন তিনি তাদেরকে মুবাহালা (দু’পক্ষের পরস্পরের জন্য বদ-দোয়া) করার জন্য আহ্বান জানান। আল্লাহ তায়া’লা ফরমায়েছেন:
فقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَابْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَانْفُسَنَا : وَانْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ.
হে আমার হাবীব! আপনি তাদেরকে বলুন, ‘এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে; অতঃপর আমরা মুবাহালা করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা’নত(অভিসম্পাত)। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৬১)
তারা তিন দিনের সময় চাইল। তিন দিন পর তারা খুবই উন্নতমানের পোশাক পরে তাদের বড় বড় পাদ্রীগণকে সাথে নিয়ে এল। একদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম এইভাবে তশরীফ আনলেন যে, বাম পার্শ্বের কোলে রয়েছেন শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ডান পার্শ্বে হস্ত মোবারক ধারণ করে আছেন ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু । খাতুনে জান্নাত সৈয়দা ফাতেমা যাহরা ও খায়বার বিজেতা শে’রে খোদা হযরত আলী আল-মুরতাজা রাদিয়াল্লাহু আনহুন্না। এই দু’জন রয়েছেন পিছনে পিছনে। বিশ্বকুল সরদার হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বলছিলেন- “যখন আমি দোয়া করব তখন তোমারা সবাই আমীন, আমীন বলবে”। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে আরজ করলেনঃ
اللَّهُمَّ هَؤُلَاءِ أَهْلُ بَيْنِي
হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত।
খ্রীস্টানদের সবচাইতে বড় পাদ্রী যখন এই সুদর্শন ও অনুপম দৃশ্য দেখল তখন বলে উঠল, হে খ্রীস্টানগণ-
اني لأرى وُجُوهَا لَوْ سَأَلُوا اللهَ أَنْ يُزِيلَ جَبَلًا لَا زَالَهُ مِنْ مكَانِهِ فَلَا نَبْتَهِلُوا فَتَهْلِكُوا وَلَا يُبْقَى عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ نَصْرَانِي إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَقَالُوا يَا أَبَا الْقَاسِمِ قَدْرَأَيْنَا أَنْ لَا نبَاهِلَكَ وَأَنْ نتْرُكَكَ عَلَى دِينِكَ وَنَتْرُكَنَا عَلَى دِيننا
নিঃসন্দেহে আমি এমন কিছু চেহারা দেখছি যদি তারা আল্লাহ তায়ালার নিকট কোন পর্বতকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করেন, তা হলে আল্লাহ তায়া’লা তাঁদের দোয়ায় পর্বতকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দিবেন। আল্লাহর ওয়াস্তে তাঁদের সাথে মুবাহালা কর না, নচেৎ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ভূপৃষ্টে কিয়ামত পর্যন্ত কোন খ্রিস্টান অবশিষ্ট থাকবে না। অতঃপর তারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, হে আবুল কাসেম(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম)! আমরা আপনার সাথে মুবাহালা করছি না। আপনি আপনার ধর্মে থাকুন এবং আমাদেরকে আমাদের ধর্মে থাকতে দিন।
অতঃপর তারা জিযয়া(অমুসলিম কর) ইত্যাদি দেয়ার স্বীকৃতি দিয়ে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামার সাথে সন্ধি করে নেয়।
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন, খোদার কসম! আল্লাহর আযাব তাদের নিকটে এসে পৌঁছে ছিল। যদি মুবাহালা হয়ে যেতো, তা হলে এরা সবাই বানর ও শূকরে পরিণত হতো। তাদের জনপদে আগুন জ্বলে উঠতো এবং নাজরানের পশু-পাখি পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেতো। (তাফসীরে কবীর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা- ৪৮৮ খাযিন ও মাদারিক, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৪২)
এই আয়াত নবী পরিবারের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার অনেক বড় দলীল। কিন্তু এই আয়াত থেকে এটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল, জ্ঞানহীনতা ও বিদ্বেষপ্রসূত যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লামের একটি মাত্র কন্যাই ছিলেন হযরত ফাতেমা যাহরা রাদিয়াল্লাহু আনহা; যদি তিনি ছাড়া আরো থাকতেন তা হলে তারাও মুবাহালায় শরীক হতো। তাছাড়া যদি সাহাবায়ে কেরামও কোন মাহাত্ম্য ও মর্যাদার অধিকারী হতেন তা হলে হুজুর তাদেরকেও সাথে আনতেন। কেননা এটা অনস্বীকার্য সত্য যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ছিলেন চারজন। যেমন শিয়া মাযহাবের প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ যথা নাহজুল বালাগাহ, উসূলে কাফী, হায়াতুল কুলুব, তোহফাতুল আওয়াম ইত্যাদিতে তার দ্ব্যর্থহীন বর্ণনা রয়েছে যা ওয়াকিফহাল মহলের অজানা নয়। বাকী এই বিষয়- তাহলে তারা মুবাহালায় কেন শরীক হন নি? এই সম্বন্ধে বক্তব্য হল এই যে, মুবাহালার ঘটনার পূর্বেই তাঁদের ইন্তেকাল হয়েছিল। হযরত রোকাইয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহা দ্বিতীয় হিজরীতে, হযরত যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা অষ্টম হিজরীতে এবং হযরত উম্মে কুলছুম রাদিয়াল্লাহু আনহা নবম হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। আর মুবাহালা দশম হিজরীর ঘটনা।
আর এই উক্তি- “হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে সাথে আনেন নি।” এ সম্বন্ধে বক্তব্য হল এই যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম যদি মুবাহালায় তাঁর সাহাবীগণকে সাথে আনেন নি, তা হলে এতে বিরাট রহস্য নিহিত ছিল। যদিও কোন কোন বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত যে, হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম স্ব স্ব পুত্রগণসহ মুবাহালায় এসেছিলেন। যেমন হযরত ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকের রাদিয়াল্লাহু আনহু এই মুবাহালার আয়াত প্রসঙ্গে বলেনঃ
فَجَاءَ بِأَبِي بَكْرٍ وَوَلَدِهِ وَبعْمَرَ وَوَلَدِهِ وَبِعْثْمَانَ وَوَلَدِهِ وَبِعَلِي وَوَلَدِهِ –
অতঃপর হযরত আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী স্ব স্ব পুত্রগণসহ আগমন করেছেন। (ইবনে আসাকির, তাফসীরে দূররে মানসূর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪০)
এ তো স্বয়ং আহলে বায়তের ঘরের সাক্ষ্য। যদি কেউ এটাও অগ্রাহ্য করে, তা হলে প্রশ্ন হল- মদীনা তৈয়বার দশ বছরের জীবনে কাফির ও মুশরিকদের সাথে যত যুদ্ধ হয়েছে সেগুলোতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম কাদেরকে সাথে নিয়ে কাফিরদের মোকাবেলায় বের হয়েছেন? সারা বিশ্বের সত্যানুরাগী মানুষের স্বীকৃতি রয়েছে যে, তারা ছিলেন তাঁরই সাহাবায়ে কেরামগণ। যারা বড় বড় রণাঙ্গনে সেই অনুপম কুরবানী ও আত্মত্যাগ প্রদর্শন করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে যার তুলনা পাওয়া যায় না। আজও ইসলামের ইতিহাসের অধ্যায়গুলো তাঁদের অমর কীর্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। যদি এই মহাত্মাগণকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুবাহালায় সাথে নিয়ে যান নি তা হলে এ থেকে তাদের অবজ্ঞা ও দোষ ধরার কোন দিক বের হয় না এবং তাদের মাহাত্ম্য ও মর্যাদায়ও কোন তারতম্য হয় না।
বরং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল তাঁর আহলে বায়তকে নিয়ে যাওয়া তাঁর নবুওয়াত ও সত্যতার অনেক বড় দলীল। এভাবে যে, ওখানে হবে মিথ্যাবাদীদের জন্য লা’নত ও ধ্বংসের বদ্-দোয়া। যদি তিনি কেবল তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে যেতেন, তা হলে খ্রীস্টানগণ এটা বলার সুযোগ পেয়ে যেতো যে, সম্ভবতঃ আল্লাহর আযাব ও নিজের ধ্বংসের ভয় তাঁর ছিল। এইজন্য তিনি তাঁর সন্তানদেরকে আনেন নি, তাদেরকে রক্ষা করে চলেছেন অথচ এটা তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশ।
এইজন্য তিনি কেবল তাঁর আওলাদকেই মুবাহালার মাঠে নিয়ে এসেছেন। যাতে মানুষ জানতে পারে যে, তাঁর নবুওয়াত ও সত্যতার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস তাঁর রয়েছে। যদি সামান্যতম সন্দেহও থাকতো তা হলে তাঁর নিজের এবং তাঁর সন্তানদের প্রতি লা’নত ও ধ্বংসের দোয়া করার জন্য তৈরি হতেন না। আর এটাও প্রতীয়মান হয়ে গেল যে, খ্রিস্টানদের আক্বীদার সত্যতার প্রতি তাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল না। নচেৎ মুবাহালা থেকে পিছপা হতো না।
[প্রবন্ধ্টি আল্লামা শফী উকাড়ভী রাহিমাহুল্লাহ’র উর্দু ভাষায় লিখিত “সফীনা-ই নূহ” এর বাংলা অনুবাদকৃত কিতাব হতে সংকলিত]
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.