মূলঃ আল্লামা ঈ’ছামানে আল্ হিময়ারী
জেনারেল ডাইরেক্টর – ওয়াক্ফ ও ধর্মীয় বিষয়ক দপ্তর, দুবাই, ইউ.এ.ই.
ভাষান্তরঃ আল্লামা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী।
এই গুরুত্ববহ ও মাহাত্মপূর্ণ বিষয়বস্তু “মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বপক্ষে বিস্তারিত দলিলাদি পেশ করার পূর্বে সর্ব প্রথম “মওলুদ” শব্দের অর্থের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এবং এতে যে অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে এ স¤র্কে কিছু আলোকপাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
“মওলুদ” শব্দের শাব্দিক অর্থ
“মওলুদ” এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- “জন্মস্থান বা জন্মগ্রহণের সময়।”
আইম্মায়ে কেরামের পরিভাষায় “মওলুদ” বলা হয়-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ – লোকের সমাগম হওয়া, কালামে পাক থেকে যতটুকু সম্ভব তিলাওয়াত করা, আম্বিয়ায়ে কেরাম অথবা আউলিয়া কেরামের মধ্য থেকে কারো পবিত্র জীবনী আলোচনা করা সাথে সাথে তাদের পবিত্র বাণী ও রেখে যাওয়া কর্মপন্থার গুরত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে (উপস্থিত জনতার সামনে) তাঁদের গুণাগুণ গুরত্ব সহকারে বর্ণনা করা। (ইআ’নাতুত ত্বালিবীন, ৩য় খন্ড, ৩৬১পৃ.)
মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় নবীগণ, তাঁর অলীগণ ও নেকবান্দাহগণের শানমান ও মর্যাদা তুলে ধরা, যাতে করে আল্লাহ্ তায়ালার পাক বাণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা যায়। যেমন, তিনি ফরমান-
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থাৎ – কথা হচ্ছে এই যে, যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করে, তবে এটা হচ্ছে অন্তরগুলোর পরহেজগারীর লক্ষণ।-(সূরা হজ্ব, ৩২)
নিঃসন্দেহে আম্বিয়ায়ে কেরামগণ উক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত, কেননা তাঁরা আল্লাহর উত্তম নিদর্শনাবলীর অন্যতম। যা অকাট্য দলিলাদি দ্বারা সাব্যস্ত বলেই সর্বজন স্বীকৃতরূপে পরিগণিত। উল্লেখ্য যে, এটা দ্বারা আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে “মীলাদ” উদ্যাপনের নির্দেশ পাওয়া যায়। যেভাবে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানমান ও মর্যাদার কথা কালামে পাকে ও হাদীস শরীফে বিস্তারিত বিদ্যমান।
মীলাদুন্নবী উদ্যাপনের উপকারিতা
হুজুরে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মীলাদ উদ্যাপনে অনেক উপকারিতা নিহিত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে আয়োজিত মিলাদ মাহফিলে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত অলৌকিক ঘটনাবলী ও উত্তম চরিত্রের বিভিন্ন দিক স্থান পায় যার ফলশ্রুতিতে তাঁর গুণাগুণ বর্ণনার একটি সুন্দর পন্থা সৃষ্টি হয়।
এর মাধ্যমে সমবেত জনতাকে নিয়ে কোরআন তিলাওয়াতের, হাদীস শরীফ পাঠের, জীবনী আলোচনার ও গরীব-দুঃখীদের মাঝে তাবারুক বিতরণের সুযোগ ঘটে।
মিলাদুন্নবী মাহফিলের উল্লেখযোগ্য উপকারিতার মধ্যে এটাও অন্যতম যে, এ উপলক্ষে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মবৃত্তান্ত ও বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ ঘটনাবলী স্মরণ করা হয়। যেমন- হাফেজ সুয়ুতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর উল্লেখযোগ্য “আল্ হা-উয়ী লিল ফাতাওয়া” নামক গ্রন্থের ২৫৬৮নম্বরে উল্লেখ করেছেন-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ – মিলাদ মাহফিলের প্রকৃত আমল হচ্ছে এতে অসংখ্য লোকের সমাগম ঘটে, সাধ্যানুসারে কোরআনে পাকের তিলাওয়াত হয়, প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনের ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক হাদীস শরীফ ও নিদর্শনাবলীর স্মরণ হয়, মূলতঃ এটা বিদআতে হাসানাহ্। (১) যে ব্যক্তি এটা পালন করে থাকেন তাকে অধিক সাওয়াব প্রদান করা হয়, কেননা এটার মাধ্যমে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মান মর্যাদা বর্ণিত হয় এবং এই ধরণীতে তাঁর আবির্ভাবের আনন্দ প্রকাশ করা হয়।
ইমাম শিহাবুদ্দীন আবু শামা শাফিয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত “আল্ বা’য়িছ আলা ইনকারিল বিদঈ ওয়াল হাওয়াদিছ” নামক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের ২৩পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ – বর্তমান যুগের মঙ্গলজনক আমলের মধ্যে এটা এক উত্তম আমল যে, মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে প্রতি বছর মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করতঃ কতগুলো মঙ্গজলনক আমলের ব্যবস্থা করা। যেমন- দান-খয়রাত, পূণ্য আমল, উত্তম ভূষণ ও আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা, বিশেষতঃ দরিদ্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম নিদর্শন। আর এই উত্তম আমলকারীদের অন্তরে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রেম ও ভক্তির সঞ্চার হয়। এই সুবাদে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে মনযোগ সৃষ্টি হয়, যে তাঁর প্রিয় বস্তুকে সৃষ্টি করে তিনি কত বড় দয়াশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, যাঁকে তিনি সমগ্র জগতের “রহমত” স্বরূপ প্রেরণ করেছেন।
উক্ত কিতাবটি আমি চারটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত করেছি। যেমন-
১) প্রথম অনুচ্ছেদ- কোরআনে করীমের দলীলাদি।
২) দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ- হাদীস শরীফের দলীলাদি।
৩) তৃতীয় অনুচ্ছেদ- ইজমায়ে উম্মতের দলীলাদি এবং
৪) চতুর্থ অনুচ্ছেদ- সকল প্রকারের সন্দেহের অবসান।
প্রথম অনুচ্ছেদঃ কোরআনের আলোকে
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করার সমর্থনে কোরআনে পাকে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তবে কোথাও সরাসরি আর কোথাও ইঙ্গিত দ্বারা সাব্যস্থ রয়েছে। নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আয়াতে পাকের ব্যাখ্যা সহকারে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
প্রথম দলীল
মহান দয়ালু খোদা তাঁর কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থাৎ – “আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত।” (সূরা ইউনুসঃ ৫৮)
তাই স্পষ্ট হয়ে গেল আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের উপর যে বিশেষ করুণা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে খুশী ও আনন্দিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর ঐ রহমত বা করুণাই হচ্ছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যেমনিভাবে তিনি কালামে পাকে এরশাদ করেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
“এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের রহমত ব্যতীত।” (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত “আদ্ দূররুল মনছুর” নামক বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে ৩৬৭পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-
— আরবী ইবারত —
“ফাদ্বলুল্লাহ” দ্বারা জ্ঞান এবং “রহমত” দ্বারা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কে বুঝানো হয়েছে। যেমনিভাবে অন্য আয়াতে পাকেও তাঁকে রাহ্মাতুল্লিল আলামীন দ্বারা ভূষিত করেছেন।
উপরোল্লিখিত আয়াতে পাকে “রহমত” শব্দটি “ফাদ্বল” শব্দের পরে উল্লেখ রয়েছে। যা ব্যাপকতার পর নির্দিষ্ট করণের হেকমত পূর্ণ পন্থার আওতায় পড়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য গুরত্ব، সঠিকভাবে অনুধাবন করা। এ ছাড়াও আয়াতে পাকে ইঙ্গিত সূচক শব্দটি খুশী ও আনন্দ প্রকাশে উৎসাহিত করার প্রতি ইঙ্গিত বহনের খুবই দৃঢ় দলীল। কেননা, উক্ত স্থানে সর্বনামের স্থলে প্রকাশ্য ইঙ্গিতসূচক বাক্য ব্যবহার দ্বারা রহমত বা করুণার প্রতি গুরুত্বশীল হবার কথা বুঝানো হয়েছে।
তাই আল্লামা মাহমুদ আলছী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “রূহুল মায়ানী” নামক নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থের ১ম খন্ড ১৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ,আয়াতে পাক দ্বারা এরই দৃঢ়তা বুঝানো হয়েছে যে, “রহমত”নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে “রাহমাতুল্লিল আলামীন” তাঁর গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি গুণ। পবিত্র কোরআনে পাকে এর স্বাক্ষ্যস্বরূপ বর্ণিত হয়েছে-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
আরো বিস্তারিত জানার জন্য “তাফসীরে আবিস সা’উদ” নামক গ্রন্থে’র ৪র্থ খন্ডে ১৫৬পৃষ্ঠা দেখে নেয়ার পরামর্শ রইল।
আল্লামা ইমাম রাযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রচিত “তাফসীরে কবীর” নামক বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থের সপ্তদশ খন্ডের ১২৩পৃষ্ঠায় আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন এটা আরবী ব্যাকরণের একটি পরিভাষা এর উপকারিতা প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ জগৎবাসী শুধুমাত্র একে কেন্দ্র করে আনন্দিত হওয়া বাঞ্চনীয়।
দ্বিতীয় দলীল
মহান আল্লাহ্ কোরআন মজীদে এরশাদ ফরমান-
وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِي هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ – এবং সবকিছু আমি আপনাকে রাসূলগণের সংবাদই শুনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করবো। (সূরা হুদ ঃ ১২০)
উক্ত আয়াতে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী বর্ণনা করার একমাত্র কারণ হচ্ছে যে, এর দ্বারা অন্তরের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে নবীকুল সম্রাট এবং শ্রেষ্ঠ রাসূল হলেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সেই মিলাদ মাহফিলে তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণাবলী বর্ণনার সুযোগ ঘটে, আর তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্মরণের মাধ্যমে মুমিনদের অন্তর দৃঢ় হয়। তাই এটা মানুষের জীবনে বারংবার গুরত্ব সহকারে উদযাপনে উৎসাহ্ সৃষ্টি হয়। তাই আমি আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলবো-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ – “হে মাহবুব! আমি আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী আপনার নিকট এ কারণেই পেশ করলাম, যেগুলো স্মরণের মাধ্যমে আমি আপনার নূরানী অন্তর দৃঢ়তার শেষ স্তরে পৌঁছে দিয়ে থাকি।”
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরের দৃঢ়তার বেলায় যেরূপ ঐ সমস্ত ঘটনাবলী ভিত্তি স্বরূপ, তদ্রুপ তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রশংসা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি স্বরুপ।”
তৃতীয় দলীল
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
অর্থাৎ – হে প্রতিপালক! আমাদের উপর আকাশ থেকে একটা (খাদ্য) খাঞ্চা অবতরণ করুন, যা আমাদের জন্য ঈদ (আনন্দ উৎসব) হবে আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য এবং আপনারই নিকট থেকে নিদর্শন এবং আমাদেরকে রিযিক দান করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সূরা মায়েদাহ্ ঃ ১১৪)
বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীরকারক আল্লামা ইছমাঈল হক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ “রূহুল বয়ান” গ্রন্থের ২য় খন্ড ৪৪৬ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-
— আরবী ইবারত —
অর্থাৎ – “অবতীর্ণের দিন ঈদ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে তাই আমরা এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। খাদ্য খাঞ্চার প্রতি এজন্য সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে এর বদৌলতে এদিনের মর্যাদা বৃদ্ধি হয়।”
অন্য আয়াতে করীমায় এর চেয়ে আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যা হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর বাণী কালামুল্লাহ্ শরীফে এভাবে শোভা পায়-
وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
অর্থাৎ “এবং শান্তি আমার প্রতি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং যেদিন আমার মৃত্যু হবে আর যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরত্থিত হবো।” (সূরা মারয়ামঃ ৩৩)
উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতসহ অন্যান্য আরো আয়াতে পাকে (যেমন সূরা আল ইমরানের ৩৫-৪৪নং আয়াতে) হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ তথা জন্মবৃত্তান্তের বিস্তারিত বর্ণনা স্থান পায়। সাথে সাথে এ সমস্ত আয়াতে করীমায় তাঁর প্রশংসা ও গুরত্ব ফুটে উঠে, যা আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাস্তবিক পক্ষে কোরআন মজীদের এই সমস্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে মাহফিল মিলাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদ শরীফের গুরত্ব হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ শরীফের গুরত্বের চেয়ে কম নয়, বরং সায়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদে পাকের মর্যাদা ও গুরত্ব সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ও অধিক। কেননা তিনিই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই তাঁর মিলাদ শরীফও অত্যন্ত ফজিলত মন্ডিত। মহান সৃষ্টিকর্তার অমীয়বাণী-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ
অর্থাৎ – “এবং নিশ্চয় আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাদি সহকারে প্রেরণ করেছি আপন সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলোতে আনয়ন কর এবং তাদেরকে আল্লাহ্র দিবস সমূহ স্মরণ করে দাও।” (সূরা ইবরাহীমঃ ৫)
অপর বাণীতে রয়েছে-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيمَ
“এবং তাদের নিকট পাঠ করো ইবরাহীমের সংবাদ” (সূরা শু’আরাঃ ৬৯)
উক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য তাঁদের স্মরণ এবং ঐ সমস্ত নেয়ামতের স্মরণ যা আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদের দান করেছেন। আর ঐ সমস্ত নেয়ামতরাজির স্মরণ যেগুলো তাঁরা পৃথিবীর বুকে শুভাগমনের সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। যেমন- হেদায়ত, নূর বা আলো, শরীয়ত, হুকুম-আহকাম, উত্তম নছিহত এবং অলৌকিক ঘটনাবলী। যে সমস্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে বান্দাহর উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত করুণার দিকে অন্তর ও জ্ঞান ধাবিত হয়। যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালার হক্ব আদায়ের প্রতি সচেষ্ট হওয়া যায়, যার ফলে তাঁর করুণা প্রত্যাশী হওয়া যায় এবং ভয়ানক শাস্তির ব্যাপারে ভীতির সঞ্চার হয়। সাথে সাথে সর্বাবস্থায় তাঁকে ডাকার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এ ধরণের উত্তম গুণাবলী আম্বিয়ায়ে কেরামের শুভ পদার্পন থেকে পরজগতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটে। যাতে মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা রয়েছে আর যা দ্বারা মহান আল্লাহ্ পাক মানুষের অন্তর সুদৃঢ় করেন, হৃদয়সমূহ আলোকিত করেন, আত্মামূহকে উচ্ছাসীন করেন, হৃদয়চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দান করেন, ধর্মীয় বিষয়াদিতে সুগভীর চিন্তাভাবনা ও ত্যাগ করার জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করণের সহায়তা প্রদান করে অবাধ্য আত্মাসমূহ সহজে আয়ত্বে এসে পৌঁছেছে যা মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার দিকে এগিয়ে আসে সাথে সাথে এর উপর মনোবল সৃষ্টি হয় ও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
উপরোল্লিখিত নেয়ামত-রাজির বর্ণনা ঐ সমস্ত মিলাদ মাহফিলে খুবই চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়, যাতে বার বার ঐগুলোর কথা স্মরণে আসে। তাই এই ধরণের বরকত মাহফিলে সকলকে আহবান করা খুবই পূণ্যের কাজ। এভাবে আহবানের মাধ্যমে সকলকে জমায়েত করা এবং এর প্রতি উৎসাহ্ প্রদানের মাধ্যমে ধাবিত করাও খুবই উত্তম আমল। এ ধরণের মাহফিলে এমন সব সত্ত্বার আলোচনা স্থান পাওয়া উচিত যাঁদের আলোচনা শুনতে লোকেরা অধিক আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ও সুমহান আদর্শের আলোকপাত করার দিকে মনোনিবেশ করা যে সমস্ত উত্তম আদর্শ তাঁদের জীবনে প্রতিফলন ঘটেছে। অধিকাংশ লোক এই ধরণের ব্যক্তিত্বের জীবনী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁদের অন্তরে এর প্রভাব পড়ে। কারণ, ঐ ধরণের ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁদের পরিচিতি নিবিড়। আর তাঁদের প্রতি ভালবাসাও রয়েছে অকৃত্রিম। তাই ঐ সমস্ত মহা মনীষী তাঁদের অন্তরে খুবই সমুন্নত এবং শ্রদ্ধার সাথে স্থান পায়। আর যখনই তাঁদের সুনাম শুনা যায় তখনই তাঁদের বাস্তবজীবনের চিত্র চোঁখে ভেসে উঠে। ঠিক সে মুহুর্তে তাঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে আরো জ্ঞান হওয়া যায়, যাতে করে তাঁদের অমীয়বাণী এবং বাস্তবমুখী কর্মাদি নিয়ে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়।
বাস্তবিক পক্ষে তাঁদের অনুসরণ-অনুকরণ সকলেরই চাওয়া আর পাওয়া অধীর আগ্রহ ও আনন্দচিত্তে তাঁদের জীবনী আলোচনা করা হয়। হায় বর্তমানে কতেক মুসলমানের কী দুর্ভাগ্যের ব্যাপার! তারা তাদের পূর্ববর্তী মহা মনীষীদের আদর্শভরা জীবনী ভুলে যেতে বসেছে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই- এমন লোকেরও আবির্ভাব ঘটেছে যারা সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র জীবনী আলোচনা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। অথচ পবিত্র কোরআনে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের আলোচনা অনেকস্থানে শোভা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের জন্মলগ্ন থেকে পরজগতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত সুবিশাল জীবনের বিভিন্ন গুরুত্ব পূর্ণ দিক এতে খুবই গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে।
চতুর্থ দলীল
হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ শরীফের ঘটনা কোরআনে করীমে সুবিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আলাইহিমাস্ সালাম)এর জন্ম বৃত্তান্ত এতে রয়েছে। এছাড়া অসংখ্য আয়াতে পাকের মাধ্যমে হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম এর জন্মের (অলৌকিক) ঘটনাবলীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এভাবে উম্মে রউমের দোয়ার স্মরণ পক্ষান্তরে যা মিলাদ শরীফের অন্তর্ভুক্ত, যাতে ভয়-ভীতির সাথে হযরত মারয়াম (আলাইহাস্ সালাম)এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন হযরত যাকারিয়া (আলাইহিস্ সালাম) কে হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম এর অভিভাকত্ব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন অমৌসুমী ফলফলাদি প্রদানের মাধ্যমে তাঁর অভিভাকত্বের আকর্ষণ এমনভাবে বৃদ্ধি করেছেন, সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা এক পর্যায়ে লটারী দ্বারা তাঁর অভিবাভক নির্ণয়ের পন্থা নির্ধারণ করেছেন। উক্ত ঘটনা সূরা আল্ ইমরানের ৩৪ – ৪৪ নং আয়াতে বিদ্যমান।
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রেরিত নবী হযরত ইয়াহিয়া আলাইহিস্ সালাম ও হযরত যাকারিয়া আলাইহিস্ সালাম এর শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কথাও আলোকপাত হয়েছে। তাছাড়া সূরা আল্ ইমরান, সূরা মায়েদাহ্ ও সূরা মারয়ামে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ্ ও রাসূল হযরত ঈসা ইবনে মারয়াম (আলাইহিস্ সালাম)এর মিলাদ শরীফের বিভিন্ন ঘটনা প্রতীয়মান হয়।
এখন আমি বলবঃ উপরোক্ত অকাট্য দলীলাদি মহা নেয়ামতের স্মরণ তথা মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বৈধতার প্রমাণ নয় কি? আর ওটা ঐ নবীকুল সম্রাটের (মিলাদের ক্ষেত্রে) তাকিদ সহকারে প্রযোজ্য যা সর্বসম্মতভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.