ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম

আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। এর মধ্যে বিশেষ একটি নেয়ামতের নাম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এর প্রমাণ মিলে বিশ্বমানবতার মুক্তির অগ্রদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা-এর পবিত্র মুখনিসৃত বাণীতে। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানব সন্তান ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে’ (মিশকাত)।

এই ফিত্‌রাত বা প্রকৃতির মধ্যেই স্বাধীনতার মর্মকথা নিহিত রয়েছে।

মূলত স্বাধীনতা একটি ব্যাপক প্রত্যয়, যার প্রকৃতি অবর্ণনীয়। স্বাধীনতাই মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সহায়তা করে। প্রত্যেক মানুষই চায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রসারের মাধ্যমে এ স্বাধীনতা প্রক্রিয়া যখন ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়, তখন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অথবা টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন জাতি যুদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাতন্ত্র্য আবাসভূমি নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছে। যারা জানমাল বাজি রেখে স্বদেশের জন্য, মানুষের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে রত থাকে তাদের এ নৈতিক অধিকারকে পবিত্র ধর্ম ইসলাম সমর্থন করে থাকে।

আর তাই তো দেখা যায়, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা পবিত্র মদিনা নগরীকে স্বাধীন করেছিলেন মুনাফিক চক্র এবং সুদখোর, চক্রান্তবাজ, ভণ্ড ইহুদিদের কবল থেকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা যে কতটা স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন তার পরিচয় মেলে পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধে। মদিনার অভিশপ্ত ইহুদি জাতির প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশরা যখন মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়, তখন নবীজী ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সাহাবি হযরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পরামর্শক্রমে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করেন। মুসলমানরা যাতে সাওয়াবের আশায় এই কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজেও পরিখা খননের কাজে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী পরিখা পার হয়ে মদিনায় আসতে না পেরে কিছু দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ব্যর্থ মনে মক্কায় ফিরে যায়। সে সময় এটা ছিল স্বাধীনতা সুরক্ষায় মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ।

এছাড়াও মদিনার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ওহুদের ময়দানে তার পবিত্র দন্ত মোবারক বিসর্জন দিয়েছেন। অবশেষে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত ও আক্রমণ মোকাবেলা করে অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (সাক্স) মক্কাকে মুক্ত করলেন জালিম, সন্ত্রাসী ও পৌত্তলিকতার পাঞ্জা থেকে। অতঃপর সামান্য সময়ের ব্যবধানে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধিকে বিস্তৃত করে পুরো আরব ভূখণ্ডকে ভরে দিয়েছিলেন অবারিত শান্তি ও নিরাপত্তায়, অভূতপূর্ব শৃংখলায়, অপূর্ব সুষম বণ্টনে, অবর্ণনীয় ভ্রাতৃত্ববোধে এবং স্বপ্নাতীত কল্যাণে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা-এর আদর্শকে অনুসরণ করে আমরাও বহু রক্ত জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে শত শত বছরের অধীনতা আর গোলামির শৃংখল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতার লাল গোলাপ। কিন্তু এ লাল গোলাপ সৌরভ ছড়াতে পেরেছে কি? এত রক্ত, এত প্রাণ ও ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য বা কী ছিল? তখন প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা ছিল, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সার্থক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সবাই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ লাভ করবে। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত জনপদ গড়ে উঠবে, যেখানে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জাতীয় অর্জনের সুফল ভোগ করবে। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর ৪২টি বছরে দেশবাসীর স্বপ্ন আর প্রত্যাশার রূপায়ণ সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কেন? আমাদের কিসের অভাব? ঘাটতি শুধু এক জায়গাতেই। তা হল দেশপ্রেম।

আজ আমাদের জাতীয় দুর্যোগই প্রমাণ করে দেশপ্রেম বিলুপ্তির পথে। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলামে দেশকে ভালোবাসার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান’ বা দেশপ্রেম ঈমানের (অবিচ্ছেদ্য) অংশ। ইসলামের কথাই হল দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক।

ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা-এর জীবনাদর্শ ও স্বভাব-চরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি নিজের মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাই স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারা গৌরবের বিষয়। মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এ শিক্ষাই আমাদের শিখিয়েছেন। অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা যখন বিজয়ী বেশে জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তার স্বগোত্রীয় লোকেরা হেরেম শরিফে অপরাধী হিসেবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। এমনি মুহূর্তে স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন।

যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা দেশের পাই ইঞ্চি সীমানা রক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে তাদের সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বলেছেন, ‘একদিন ও  একরাতের সীমান্ত পাহারা ধারাবাহিকভাবে এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারারাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম।’ (মুসলিম)

অন্যত্র হজরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা-কে বলতে শুনেছি, ‘(আল্লাহর পথে) একদিন সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকা হাজার দিনের মনজিল অতিক্রম অপেক্ষা উত্তম।’ (তিরমিজি)

এছাড়াও দেশপ্রেমকে জাহান্নামের রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বলেছেন, দুই ধরনের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন কখনও স্পর্শ করবে না, (এক) সেই চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, (দুই) যে চক্ষু আল্লাহর পথে (সীমান্ত) পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয়। (তিরমিজি)

প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেম মহত্ত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মহান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে স্বদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে, স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার শিক্ষা দেয়।

দেশের এ ক্লান্তিলগ্নে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশকে কিছু দেওয়ার মনমানসিকতা তৈরি করা, দেশকে ভালোবাসতে শিখা। তাহলেই সুখী সমৃদ্ধশালী, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব। আল্লাহ আমাদের একটি উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুক। আমিন

[প্রবন্ধঃ সংগৃহীত]

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

মাদকাসক্তি ও আমাদের করণীয়

আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আযহারী [বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন ওয়াস সালাতু ওয়াস …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading