ইসলামে পিতা-মাতার সেবার গুরুত্ব

পিতা-মাতা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আপনজন। পিতা-মাতার খেদমত করতে পারা বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। মেরাজ রজনীতে যে ১৪টি বিষয় স্থির হয়, তার প্রথমটি হলো আল্লাহর হক তাওহিদ বা একত্ববাদ এবং শির্ক তথা অংশীবাদিতা থেকে মুক্তি। দ্বিতীয়টি হলো পিতা-মাতার হক বা অধিকার এবং সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং করণীয় ও পালনীয়।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ্ (বিরক্তিসূচক ও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দেবে না; তাদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছে।’ (সুরা-১৭ [৫০] ইসরা-বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)।

আরও বলা হয়েছে: ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো। (সুরা-৪ [৯২] নিসা, আয়াত: ৩৬)।

  • পিতা-মাতার সেবা

নিজ পিতা-মাতার খেদমত সন্তানের (ছেলে-মেয়ে উভয়েই) ওপর প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ফরজ ও ওয়াজিব। পুত্রবধূর ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা নফল। নফল ইবাদতে কাউকে বাধ্য করা যায় না বা জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। যেহেতু সংসারের রীতি অনুযায়ী নারীদের নিজ পিতা-মাতা ছেড়ে স্বামীর সংসারে যেতে হয় এবং তার পিতা-মাতার সংসারে অন্য আরেকজন নারী বধূ হয়ে আসেন; তাই প্রত্যেক নারী যদি শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতা জ্ঞান করে সেবা ও খেদমত করেন, তবে সব পিতা-মাতা ও সব শ্বশুর-শাশুড়ি সমানভাবে সেবা ও খেদমত পাবেন। কারণ সব শ্বশুর-শাশুড়িই পিতা-মাতা এবং সব পিতা-মাতাই শ্বশুর-শাশুড়ি। পিতা-মাতার সেবা ও খেদমত ছেলে ও মেয়ে সবার প্রতি সমান দায়িত্ব। শ্বশুর-শাশুড়িরও উচিত পুত্রবধূকে মেয়ে মনে করা এবং সেইরূপ আচরণ করা।

  • শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা 

সাধারণত শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা ও খেদমত বলতে আমরা পুত্রবধূর দ্বারা স্বামীর পিতা-মাতার সেবা ও খেদমত করাকেই বুঝি। স্ত্রীর পিতা-মাতাও যে স্বামীর শ্বশুর-শাশুড়ি, সে কথা খেদমত ও সেবার ক্ষেত্রে আমরা বেমালুম ভুলে যাই। শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত একটি নফল ইবাদত। আত্মীয়তা ও বংশীয় সম্পর্ক রক্ষা করাও ইবাদত। আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন: ‘আর তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন পানি হতে; অতঃপর তিনি তার বংশগত সম্পর্ক ও বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। আপনার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান।’ (সুরা: ২৫ ফুরকান, আয়াত: ৫৪)।

পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক হলো রক্তের সম্পর্ক। এর পরেই দুনিয়ার নিকটতম সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক যেমন আল্লাহর নিয়ামত; তেমনি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও আল্লাহর দান। পিতা-মাতার কল্যাণেই স্বামী পেয়ে থাকেন গুণবতী স্ত্রী এবং স্ত্রী পেয়ে থাকেন উপযুক্ত স্বামী। সুতরাং, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একে অন্যের পিতা-মাতাকে যথাযথ সম্মান করা কর্তব্য। কারণ, তাঁরা উভয়ে আজীবন তাঁদের শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে চিরঋণী।

পিতা-মাতার খেদমত যেমন ইবাদত, তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমবয়সীদের খেদমত করাও অনুরূপ ইবাদত। যেহেতু মেয়েরা স্বামীর সংসারে গেলে পিতা-মাতার সরাসরি খেদমত করার সুযোগ কম থাকে, তাই শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করলে পিতা-মাতার খেদমতের নেকি বা সওয়াবের অধিকারী হবেন।

  • স্নেহ ও সম্মান সুন্দর সমাধান

ভালোবাসা দিয়ে সবকিছুই জয় করা যায়। ভালোবাসা প্রকাশের দুটি রূপ-স্নেহ করা ও সম্মান করা। হাদিস শরিফে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বলেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে সম্মান করে না; সে আমার উম্মত নয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

সকল পিতা-মাতাই আপন আপন সন্তানকে স্নেহ করেন। পুত্রবধূ বা মেয়ের জামাইও কারও না কারও সন্তান, তাই তাদের প্রতিও স্নেহ ও সদয় আচরণ করা প্রত্যেক শ্বশুর-শাশুড়ির কর্তব্য। সব সন্তানই নিজ নিজ পিতা-মাতাকে সম্মান করে, শ্বশুর-শাশুড়িও কারও পিতা-মাতা, তাই তাঁদের প্রতি সম্মান, ভক্তি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সব বধূ ও জামাতার দায়িত্ব।

সবাই সবার আপন আপন দায়িত্ব পালন করলেই সবার নিজ নিজ অধিকার সংরক্ষিত হয়। মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। স্নেহ করলে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া যায় আর সেবা ও খেদমত করলে স্নেহাশীষ হওয়া যায়। এভাবেই সংসারজীবন ও দাম্পত্য জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে, সমাজ স্থিতিশীল হবে।

  • সন্তানেরা শিখবে আমাদের দেখে

আজ যাঁরা সন্তান, আগামী দিনে তাঁরাই হবেন পিতা-মাতা। আজ যাঁরা বধূ বা জামাতা, আগামীকাল তাঁরাই হবেন শ্বশুর বা শাশুড়ি।

সুতরাং, আজকের সন্তানেরা যদি তাঁদের পিতা-মাতার খেদমত করেন, তবে তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের থেকে দেখে শিখবে কীভাবে পিতা-মাতার খেদমত করতে হয় এবং তাঁদের বার্ধক্যেও তাঁরা তাঁদের সন্তানের কাছ থেকে অনুরূপ খেদমত পাবেন।

আজকের বধূ ও জামাতারা যদি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হন, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখে শিখবে এবং তাঁরা যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হবেন, তখন সেইরূপ সেবা ও সম্মান পাবেন।

এভাবেই গড়ে উঠবে সুখী, সুন্দর ও আনন্দময় পারিবারিক পরিবেশ। জান্নাতি সুখে ভরে উঠবে দুনিয়ার পরিবেশ।

 

লেখকঃ মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী।

বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম-এর সহকারী অধ্যাপক


Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ জালালুদ্দীন সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমি আজ আলোচনা করব এমন একটি বিষয়ে,প্রতিটি মানুষ যার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from RoushanDAlil.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading