অধ্যক্ষ মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৮৫৬ খিষ্টাব্দে বেরেলী শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত আল্লামা নক্বী আলী খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি । ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের পরিবার ইলমে দ্বীন ও রূহানিয়্যাতের কেন্দ্র ছিল । মাত্র ১৪ বছর বয়সেই আ’লা হযরত ফতওয়া প্রণয়ন সূচনা করেন । তাঁর রচিত সহস্রাধিক গ্রন্থাবলী ইসলামী জগতের এক মহান অমূল্য সম্পদ । ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায় ।
- (ক) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ।
ইমাম আহমদ রেযার দৃষ্টিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপঃ
১. ধর্মের মর্ম অনুধাবন ২. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
তিনি বলেন- রিয্ক বা জীবিকা ইলমে নয় রিয্ক তো রায্যাক তথা রিয্ক দাতার নিকট পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষিত। বান্দার রিযকের জন্য তিনি নিজেই জিম্মাদার ।
২. তিনি আরো বলেন- পার্থিব জ্ঞান যদি এ নিয়তে অর্জন করা হয় যে , তা দ্বারা দ্বীন তথা ধর্মের কল্যাণ সাধন করা হবে । তখন তা ধর্মীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে ।
৩. সৎ নিয়ত ও উত্তম আমল ধারণ করা । তিনি বলেন- নিয়্যত পরিশুদ্ধ হলে অসংখ্য বিধান পরিবর্তন করা যায়। নিয়ত মহৎ না হলে অনেক উত্তম কাজও দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে যায় ।
৪. মারিফাতে ইলাহী তথা আল্লাহর পরিচয় ।
৫. রিসালাতের পদমর্যাদা ও শান-মান অনুধাবন ।
৬. ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ধারণে যোগ্যতা অর্জন ।
৭. কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপন ।
- (খ) পাঠ্যনীতি ।
১. কল্যাণ অর্জন ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণে ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সকল প্রকার আধুনিক ও প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান বুদ্ধিভিত্তিক হোক অথবা তত্বভিত্তিক , শিক্ষা গ্রহণ করাকে বৈধ মনে করেন ।
২. জ্ঞানী মুসলমান যদি খৃষ্টদের অসারতা প্রমাণ ও খৃষ্টমতবাদের খন্ডনের নিয়তে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করে অবশ্যই সাওয়াবের অধিকারী হবেন ।
৩. পার্থিব উন্নতির জন্য হিসাব বিজ্ঞান, জ্যামিতি, ভূগোল, অর্থনীতি সহ যেকোন প্রকার ভাষা শিক্ষা করা ও যেকোন বৈধ জ্ঞান অর্জন করতে কোন আপত্তি নেই ।
৪. চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিদ্যাসহ অন্যান্য আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সে সব বিষয়, যা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার সহায়ক তা অর্জনের অনুমতি রয়েছে ।
৫. যে বৈধ জ্ঞান ইহকাল-পরকালে কোন কাজে আসবেনা তা উপকারী নয় । এ সব বিষয়াদি সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া নিতান্তই অপরিহার্য ।
৬. নিন্দিত ও সমালোচনাযোগ্য জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ । কেননা এতে সৃষ্টিরাজির ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান ।
- (গ) শিক্ষার অবলম্বন
ইমাম আহমদ রেযা বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শিক্ষার তিনটি অবলম্বন তথা উৎস বর্ণনা করেন, যা নিম্নরূপ-
১. আল্ কোরআন ২. আল্ হাদীস ৩. ইজমা ৪. কিয়াস
এ প্রসঙ্গে ইমাম বেরেলভী একটি হাদীস শরীফ উদ্ধৃত করেন “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ইলম তিনটি- কোরআন, হাদীস অথবা এমন জিনিস , যা আমল অপরিহার্য করনে তার পর্যায়ভুক্ত , এর দ্বারা এজমার দিকে ইঙ্গিতবহ এ ছাড়া সব ধরণের ইলম অতিরিক্ত।
- (ঘ) শিক্ষা দর্শন।
১. প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশঃ অপরাপর মুসলিম চিন্তাবিদ ও পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের মত ইমাম আহমদ রেযাও প্রাথমিক শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেন এবং এ পর্যায়ে প্রতিভা বিকাশের পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন । তিনি বলেন- নরম কাঠ যেদিকে ফিরাও সেদিকে ঝুঁকে পড়বে । আরো বলেন, শিশু সন্তানের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দানই তাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করবে । এ পর্যায়ে তিনি শিশু কিশোরদের প্রতি কঠোরতার পরিবর্তে কোমলতা প্রদর্শনের পরামর্শ দেন ।
২. প্রশান্তি ও ভালবাসা সৃষ্টিঃ জীবনে মর্যাদা ও প্রশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাদানকালে শিশু সন্তানের অন্তরাত্মায় প্রশান্তি— ও ভালবাসা জাগ্রত করতে হবে । মানবতাবোধ ও মমতাবোধ এর স্ফুরণ ঘটাতে হবে তাদের মনন-মেধা ও মানসে ।
৩. শারীরিক প্রশিক্ষণঃ শিক্ষার্থীদেরকে খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ পূর্বক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে । এ ক্ষেত্রে শিক্ষার মূল টার্গেট যেন ব্যহত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে ।
৪. শিক্ষার মাধ্যম সহজকরণঃ শিক্ষার মাধ্যম সহজ ও প্রাঞ্জল হওয়া উচিৎ । কেননা, কঠিন ভাষায় শিক্ষাদান ও বিদেশী ভাষায় পাঠদান দু’টোই শিক্ষার উন্নতি সাধনে বড় অন্তরায় ।
তবে এ ক্ষেত্রে বিদেশী ভাষাকে মাতৃভাষায় ব্যাখ্যা সাপেক্ষে সহজ পদ্ধতি অবলম্বন অপরিহার্য । অন্যথায় এর প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে ।
৫. মাতৃভাষায় পাঠদানঃ প্রতিটি শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক শিক্ষাদানকালে তার মাতৃভাষায় বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠদান করা অতীব প্রয়োজন।
৬. বিদেশী ভাষায় পাঠদানঃ উচ্চমানের শিক্ষাদানে কঠিন ভাষা প্রয়োগ ও বিদেশী ভাষায় পাঠদানের ব্যবস্থা করা যায়।
৭. নারী শিক্ষাঃ জীবনের কোন স্তরে সহশিক্ষা বৈধ নয় । নারী সমাজের জন্য তাদের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা অনুপাতে স্বতন্ত্র সিলেবাস প্রণয়ন উচিত । মহিলাদের জন্য এমন বিষয় ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন প্রয়োজন যা পর্দা সহকারে তারা অর্জন করতে পারে ।
প্রফেসর আবদুল গাফ্ফার গাওহর কর্তৃক লিখিত ‘ইমাম আহমদ রেযা কা নযরিয়ায়ে তালিম’ প্রবন্ধ অবলম্বনে অনূদিত।
সূত্রঃ মারিফে রেযা, করাচি, দারুল উলূম মানযারুল ইসলাম শত বার্ষিকী সংখ্যা, (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০১) পৃষ্ঠা- ২০৮, ২০৯। প্রধান সম্পাদক- ছাহেবজাদা ওয়াজাহাত রসূল কাদেরী,তরজুমান ১৪২৫ হজিরী সফর।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.