মুজাহিদে আহলে সুন্নাত ড. আল্লামা মুফতি আশরাফ আসিফ জালালী (মাঃজিঃআঃ)
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান।
প্রথম পর্ব পড়ুন- https://wp.me/p7H2z7-gE
এখন প্রফেসর সাহেব জিবরাঈল ও মিকাঈল আলাইহিমাস সালামকে কেবল প্রাশাসনিক খলিফা বলবেন অথবা পূর্ববর্তী উম্মতদের নবীগণের উজিরগণ কেবল রাজনৈতিক খলিফা ছিলেন ? সম্মানিত পাঠক! এই মাসআলার অবতারণা করত আপনাদের অবগতির জন্য কুরআন-হাদীস হতে কিছু দলীল উপস্থাপন করছি।
আ’লা হযরত মুজাদ্দিদে দীন মিল্লাত ইমামে আহলে সুন্নাত ইমাম আহমদ রজা ফাজেলে বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এই বিষয়ে একাধিক কিতাব রচনা করেন । তন্মোধ্যে ‘الزلال الأنقى من بحر سبقة الأتقى‘ ‘আল যুলালুল আতক্বা মিন বাহরি সাবক্বাতিল আতক্বা’ (উম্মতের সবচেয়ে বড় পরহেযগারের সমুদ্রের সবচেয়ে পবিত্র, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও সুমিষ্ট পানি) নামক কিতাব । যেটি ক্রমানুসারে আ’লা হযরত আলাইহির রাহমার ১৫তম রচনা । তিনি এতে হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শ্রেষ্ঠত্ব কেবল কুরআন-হাদীস, মুজতাহিদ ইমাম, মুফাসসির মুহাদ্দিস কেরামগণের মত নয় ব্যাকরণ, কালাম, মানতিক ও যুক্তিবিদ্যা দ্বারাও সাব্যস্ত করেছেন ।
উক্ত কিতাব হতে দেখা যাক, রাব্বুল আলামীনের ইরশাদ – وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى (আর তা থেকে অনেক দূরে রাখা হবে যে সর্বাধিক পরহেযগার ।) [১]
আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহ ইজমা দ্বারা প্রমাণ করেন যে, ‘الْأَتْقَى‘ দ্বারা উদ্দেশ্য হলেন হযরত সায়্যিদুনা সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু । এরপর স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণ করেন যে,أتْقَى শব্দটি تقى এর সিফাতে মুশাব্বাহ অর্থে নয় বরং, ইসমে তাফদ্বীল অর্থে ব্যবহৃত হয় । অর্থাৎ সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কেবল পরহেযগার নন উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পরহেযগার বলা হয়েছে । ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (নিশ্চই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু ।) [২]
আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহ বলেন, যখন প্রমাণ হয়ে গেল যে, ‘أتْقَى ‘ দ্বারা সর্বসম্মতভাবে উদ্দেশ্য হল সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাহলে আমরা বলতে পারি, আল্লাহ তা’আলা হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁকে সর্বাধিক খোদাভীরু ঘোষণা দেন এবং তাঁকে সম্মানিত গুণেও গুণান্বিত করেন । এ শব্দদ্বয় হতে এই মর্ম বের হয় যে তিনি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত এবং এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশ্রেষ্ঠও কেননা আফদ্বল বা সর্বশ্রেষ্ঠ তো তিনিই যিনি শ্রেষ্ঠ । এমনিভাবে তাঁর উচ্চমর্যাদায় আসীন হওয়াটাও এসে যায় । এসব শব্দের অর্থের যথার্থতা তাঁকে দিয়েই বোঝানো সম্ভব । [৩]
আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহ এই প্রসঙ্গে ইলমে মানত্বিক তথা যুক্তিশাস্ত্রের আলকে পূর্বে বর্ণিত ভ্রান্ত ধারণা ও আরোপের দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদান করেন । সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণের পর ইমাম আহমদ রজা বেরেলভী ক্বাদেরী রাহমাতুল্ললাহি আলাইহ তাঁকে সবচেয়ে খোদাভীরু , আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে বড় ওলী বা বন্ধু হিসেবে সাব্যস্ত করেন ।
আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহ দুটি আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেন যে, যখন মা’রেফাতের সম্পর্ক অন্তরের সাথে হবে আর তাকওয়ার অবস্থানও অন্তরের সাথে হবে, তখন তাকওয়ার আধিক্য যেমন বেশি হবে তেমনিভাবে আধ্যাত্মিকতাও অধিক হবে –
ইরশাদ হচ্ছে- أُولئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوى
তাঁরা হচ্ছে ঐসব লোক, যাদের অন্তরকে আল্লাহ তা’আলা খোদাভীরুতার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন । [৪]
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, তবে এটা হচ্ছে অন্তরগুলোর পরহেযগারীর লক্ষণ । [৫]
হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন – التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় বক্ষ মুবারকের দিকে তিনবার ইশারা করে বলেন তাকওয়া বা খোদাভীতি হচ্ছে এখানে। [৬]
হজরত দাতা গঞ্জেবখশ হাজবেরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইরশাদ ফরমান:
صفا را اصلی و فرعی است اصلش انقطاع دل است از اغیار و فرعش خلوت دل است از دنیاء غدار و این هر دو صفت صدیق اکبر است، ابوبکر عبداللّه بن ابی قحافه رضی اللّه عنه؛ از آنچه امام اهل ایں طریقت او بود
“صفا” তথা নির্মলতা বা পবিত্রতা (তাসাউফ বা সূফীর মূল ধাতু) আসল বা মূল ও শাখাপ্রশাখা এ দুটি দিক রয়েছে। আসল হলো, অন্তরকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও চিন্তা বা ধ্যান থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা, আর শাখা হলো, দুনিয়ার আসক্তি, ভোগ-বিলাস ও সকল প্রকার প্রবৃত্তি ও ধোঁকা থেকে অন্তরকে মুক্ত ও পবিত্র রাখা। এই দুটি গুণই হজরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাঝে পূর্নরূপে বিদ্যমান ছিল। তাই সকল তরীক্বত পন্থীর ইমাম তিনিই হয়েছেন। [৭]
প্রফেসর সাহেব হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উদ্ধৃতি থেকে আপন মনগড়া মতবাদের সমর্থন লাভের যে আকাঙ্ক্ষা করেন তা অপূর্ন রয়ে গেল। কেননা, প্রফেসর সাহেবের এই গোটা আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, হজরত সায়্যিদিনা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে হজরত সায়্যিদিনা আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর উপর প্রাধান্য ও মাহাত্ম্য প্রমাণ করা। যেখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহ ফরমান-
وَقد أَجْمَعَ مَنْ يُعْتَدَّ بِهِ مِنَ الْأمَّةِ عَلٰى أَنَّ أَفْضَلَ الْأُمَّةِ أَبُو بَكْر الصِّدِّيْقُ ثُمَّ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا
উম্মতের গ্রহণযোগ্য অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ অর্থাৎ হক্কানী উলামা কেরাম এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হলেন হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, অতঃপর হজরত উমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। [৮]
فَالصِّدِّيْقُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ مَعَ المُنَاسَبَةِ التَّامَّةِ لِمَ يَكُوْنُ مَحْرُوْمًا وَلَا يَكُوْنُ مُسْتَفِيْدًا مِنْ كَمَالاتِه. كَيْفَ وَقَدْ رُوِيَ أَنَّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: “ مَا صَبَّ اللَّهُ شَيْئًا فِي صَدْرِي إِلَّا وقد صَبَبْتُهُ فِي أَبِيْ بَكْرٍ” رَضِيَ اللهُ عَنْهُ. وَكُلَّمَا كَانَتِ المُنَاسَبَةُ أَكْثَرَ كَانَتْ فَوَائِدُ الصُّحْبَةِ أَوْفَرَ. وَلِهٰذَا صَارَ الصِّدِّيْقُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَفْضَلَ الصَّحَابَةِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُم. وَلَمْ يُدْرِكْ أَحَدُ مِنْهُمْ دَرَجَتَهُ لِأَنَّهُ كَانَ أَكْثَرَهُمْ مُنَاسَبَةً. قَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ: “مَا فَضَلَ أَبُو بَكْرٍ بِكَثْرَةِ الصَّلَاةِ وَلَا بِكَثْرَةِ الصِّيَامِ وَلٰكِنْ بِشَيءٍ وَقَرَّ فِي قَلْبِهِ
অতঃপর হজরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে পরিপূর্ন সম্বন্ধ রাখা সত্ত্বেও কীভাবে বঞ্চিত হতে পারেন ? কীভাবে সম্ভব যে তিনি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কামালিয়্যাত দ্বারা প্রভাবিত ও উপকৃত হবেন না ? অথচ তাঁর ব্যাপারে বর্ণিত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান: “আল্লাহ তা’আলা যা কিছু আমার বক্ষে অবতীর্ন করেছেন, আমি তা আবু বকরের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বক্ষে প্রদান করেছি।” রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সাথে যার সম্পর্ক অধিক হবে, তিনিই সেই সাহচর্যের দ্বারা বেশি উপকৃত ও প্রভাবিত হবেন। যেহেতু হজরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য ও নৈকট্য সকল সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম হতে অধিক ছিল, সুতরাং প্রমাণিত হয় যে তিনিই সকল সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম হতে শ্রেষ্ঠ এবং কেউই তাঁর সম মর্যাদার নন। হুজুর আঁকা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান: “আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর অধিক নামায ও রোযার কারণে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেনি, বরং তাঁর অন্তরের অগাধ ভালোবাসা ও সাহচর্যের কারণে মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে।” [৯]
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সমুজ্জ্বল ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমের প্রত্যেককেই শরীয়ত-তরীক্বত, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বেলায়াত এবং জাহেরী বাতেনী ফজীলত, মাহাত্ম্য ও সৌকর্যতার মাপদণ্ডে কামিল আখ্যায়িত করা হয়েছে। আ’লা হজরত মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত ইমাম আহমদ রজা ফাজেলে বেরেলভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আনহু ফরমান, চার খলিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম মিল্লাতের সুউচ্চ প্রাসাদের চার প্রধান স্তম্ভ, শরীয়তের চার প্রবাহমান নদী, শরীয়তের বাগানের চার সবচেয়ে মনোরম ও সুগন্ধিযুক্ত ফুলের বৈশিষ্টাবলি ও ফজীলত এমনভাবে রাঙানো ও ছড়ানো রয়েছে যে, তাঁদের মধ্য থেকে যে কোন একজনের ফজীলতের দিকে যদি আলাদাভাবে দৃষ্টিপাত করা হয় তখন এটাই জানা যাবে যে, যা কিছু আছে যত আছে এখানেই আছে, তাঁর চেয়ে অধিক আর কোথায় কার নিকট আছে?
بہر گلے کہ ازیں چار باغ می نگرم بہار دامن دل می کشد کہ جا اینجاست
এই চার বাগানের যেই ফুলের দিকেই আমি তাকাই না কেন, এর সুগন্ধি ও শোভা আমার অন্তরের বিগলিত প্রান্তকে সেদিকে টেনে নিয়ে বলে, আসল জায়গা তো এটাই।
অতঃপর আ’লা হজরত ‘সিদ্দীকে আকবর ও ফারুকে আজম’ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, হজরতে শায়খাইন, সাহেবাইন, ওয়াযিরাইন (প্রধান দুই উজির, যেমনটি হাদীস শরীফে তাঁদের জমিনের উজির উল্লেখ করা হয়।), আমীরাইন (তাঁরা উভয়ই আমীরুল মু’মিনীন ছিলেন), রাফীক্বাইন (সুখে-দুখে একে অপরের সঙ্গী ও হিতাকাঙ্ক্ষী), দজী’আইন (দুই নিত্যসঙ্গী, তাঁরা হুজুরের সঙ্গী ছিলেন, আছেন এবং কিয়ামত দিবসে একসঙ্গে উথিত হবেন), মুশীরাইন (উপদেষ্টা, তাঁরা উভয়ই হুজুরের মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন) সায়্যিদিনা মাওলানা আব্দুল্লাহ আল আতীক আবু বকর সিদ্দীক ও হকের মাপদণ্ড আবু হাফস উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমার বেলায়াতের শান সকল শান হতে আলাদা, আর তাঁদের উভয়ের উপর আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দান সবচেয়ে বেশি। সকল আম্বিয়া ও ফিরিশতা আলাইহিমুস সালামের পর তাঁদের যে মর্যাদা তা আর কেউই লাভ করেননি। জান্নাতে তাঁদের মকাম ও মর্যাদা (উম্মতের) মধ্যে সবার উর্ধ্বে। মর্যাদা, মর্তবা, উত্তম আচরণ ও চরিত্রে তাঁরা উভয়ই অগ্রগণ্য। আমাদের ইমাম ও উলামা কেরামগণ এ ব্যাপারে অসংখ্য কিতাব রচনা করে তাঁদের (লেখক) সৌভাগ্যকে বর্ধিত ও বাধিত করেছেন, এমন অসীম ব্যাপক বিষয়বস্তুর একত্রিতকরণ কার পক্ষে সম্ভব। আল্লাহ্র অপার মহিমা, হাজারো খাতায় তাঁদের ফজীলত ব্যাখ্যা করে রচনা করে হাজারো কিতাব ছাপা হলেও তা শেষ হবে না।
وعلٰی تَفَنُّنِ وَاصِفِیْهِ بِحُسْنِهِ یُغنِی الزَّمانُ وَفِیهِ مَالَمْ یُوْصَف
আর তাঁদের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্যের প্রশংসাকারীর প্রকৃষ্ট বর্ণনার ভিত্তিতে যুগ মালামাল হয়ে যায়, আর তাতে এমন সব মনোহর বিষয় ও সৌন্দর্য রয়েছে যা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না, অবর্ণনীয়।
তবে অসংখ্য ফজীলত ও অশেষ সম্মান ও দয়ার অধিকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ হওয়া এক কথা আর ফজীলত ও কারামাত অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ (আম্বিয়া কেরামের পর) ও আল্লাহর নিকট সকলের চেয়ে অধিক মকবুল ও নৈকট্যপ্রাপ্ত হওয়া আরেক বিষয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্মান মর্যাদা আল্লাহর হাতে তিনি যাকে ইচ্ছা অশেষ প্রদান করেন। ﴿ قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ ﴾ [১০]
আ’লা হজরত ইমামে আহলে সুন্নাত রাহমাতুল্লাহি আলাইহ এক প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট করেন যে সাহাবা কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম সকলেই আল্লাহর ওলী ছিলেন। অতঃপর উল্লেখ করেন, “সাহাবা কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম চার খলিফার পর আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ, মর্যাদাপ্রাপ্ত, নৈকট্যপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁদের বেলায়াত ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম খিলাফতের আদলেই নির্ধারিত। চার হাজরাত অর্থাৎ খলিফা সকলের চেয়ে উচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত ও কামিল ব্যক্তি, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক দায়িত্বে মনোনীত হওয়ার দিক থেকে শায়খাইন এর মর্যাদা ও অবস্থান সবার উর্ধ্বে আর এই চক্রে অর্থাৎ চার খলিফার এই দায়রাকে পরিপূর্ণতা দানকারী মাওলা আলী শেরে খোদা মুশকিল কুশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মর্যাদা অপরাপর সাহাবা হতে উচ্চ। আল্লাহ তা’আলা অধিক জ্ঞাত।” [১১]
অন্যত্র বিস্তারিত দলিলাদি উপস্থাপনের পর আ’লা হজরত আজীমুল বরকত ফরমান, “যখন প্রমাণ হয়ে গেল যে আল্লার ণৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে শায়খাইনের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে তো বেলায়াতের মর্যাদায়ও তাঁদের অবস্থান শীর্ষে।” [১২]
হজরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লা তা’আলা আনহুর বেলায়াতের মকামে শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মাওলা আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সিলসিলা প্রকাশিত হওয়া অর্থাৎ তাঁর থেকে সিলসিলা আরম্ভ হওয়ায় কোনো পার্থক্য তৈরি হয় না। কেননা হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সিলসিলা প্রারম্ভকারী হওয়া এটা জাহেরী অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত (তিনি তরীকতের একজন শায়খ) এদ্বারা কিন্তু হজরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয় না। যেমন, হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খলিফাগণের মধ্যে শহীদে কারবালা ইমাম হুসাইন ও ইমাম হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে সিলসিলা জারি হয়। অথচ সায়্যিদিনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাহ হিসেবে, জ্ঞানে গুনে সন্দেহাতীতভাবে বেলায়াতের উচ্চতর মকামে অবস্থানকারী, কিন্তু তাঁর থেকে সিলসিলা জারি হয়নি (এখানে কি ইমাম বসরীর শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয়?) এমনিভাবে প্রকাশ্যে বিভিন্ন হাদীস দ্বারা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে ইমাম হাসান আল মুজতাবা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা পাওয়া যায়। [১৩]
প্রফেসর সাহেব, তার মুবাল্লিগগণ এবং কতেক উগ্রপন্থী (গালী) রাফেজী মতবাদপুষ্ট (যারা মাওলা আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে খোদা সাব্যস্ত করে) বা তাদের প্রতি আসক্ত, বরং আন্তরিক ও সহানুভতিশীল এদের অবস্থান এখন আর গোপন নয়। এরা সরলমনা সুন্নী মুসলমানদের যারা রাফেজীদের কুফরি আক্বিদার কারণে এদের মজলিস বর্জন করেছে, এদের সাথে সংশ্রব রাখে না, এদের আলোচনা শুনে না, কিতাবাদি ও লেখনি পড়ে না, সর্বতকরনে এদের অপছন্দ করে তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে টোটকা হিসেবে কাজ করছে। এরা সুন্নী অঙ্গনে বিভিন্ন মাহফিল ও সমাবেশে রাফেজী মতবাদ বা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে বেড়াচ্ছে, আর খারেজিয়তের ভয় দেখিয়ে (এটা খারেজী মত, এমন করা খারেজী হওয়ার লক্ষণ ইত্যাদি) লোকেদের রাফেজীয়ত উপহার দিচ্ছে। অথচ অপরদিকে এরাই খারেজী মতবাদকে ইসলামের একটি অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করে একে সাজানো গোছানো দেখতে চায়। আসলে খারেজী ও রাফেজী মতবাদ উভয়ই একটি অচল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এরা রাফেজীদের বা অন্যান্য সাধারণ মজলিসে বা মাহফিলে দিয়ে রাফেজীদের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের উন্নত শির অবনত ও কলঙ্কিত করতে নানা উপায়ে আহলে সুন্নাতের উপর রাফেজী মতবাদের প্রধান্য জাহির করে। এদেরকে যখন বারণ করা হয় বা এ ব্যাপারে জেরা করা হয় অথবা বিরোধিতা করা হয়, তখন এরা বলে বেড়ায় আমরা তো সেখানে দ্বীন প্রচারের খাতিরে, সত্য প্রকাশ ও এর দাওয়াতের খাতিরে গিয়েছি, অথচ যা একেবারেই উদ্ভট ও মিথ্যা। এমন আহাম্মক আছে কি যে কাউকে (বিরোধী) নিজেদের প্লাটফর্মে দাওয়াত দিয়ে বলবে, আসুন আমাদের মাঝে আপনার বক্তব্য তুলে ধরুন, আমার/আমাদের সমাবেশে এসে সত্য প্রকাশ করে আমাদের লোকদের ভাগিয়ে নিয়ে যান? এমনটি একেবারেই সম্ভব নয়, বরং প্রকৃত অবস্থা হলো এসব বক্তাদের সাথে রাফেজীদের পারস্পরিক বোঝাপড়া রয়েছে, আপনি একটু সাহাবা কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমের আলোচনাও করিয়েন, যাতে নিজ অঙ্গনে গিয়ে নিজের সততা জাহির করতে পারেন।
রাফেজীদের কাছে সাহাবা কেরামের এমন যৎসামান্য আলোচনায় কিছু আসে যায় না, কেননা এই বক্তা তাদের হয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সামনে রাফেজী মতবাদকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে পেশ করছে। কুরআন-হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত এই ঈমানী মতভেদকে কতেক কট্টরপন্থী ব্যক্তিদের মানসিকতা, চিন্তাধারা হিসেবে তুলে ধরে এই ঈমানী মতভেদকে ভুলে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এভাবেই উক্ত বক্তা আপন মসজিদে সৎ ও সঠিক অবস্থান ধরে রাখবে, নিজের গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখবে, ধান্দাও চলতে থাকবে। অপরদিকে সরলপ্রাণ সুন্নীদের ঈমানকে আপন শান শওকত ও বক্তব্যের জোরে রাফেজীদের জিম্মায় ছেড়ে দিবে।
এখান থেকেই বুঝা যায় যে তাদের এই কারসাজি সুন্নী অঙ্গনের জন্য কতটা ক্ষতিকারক। তাদের এই কর্মকাণ্ডের দ্বারা একজন রাফেজীও কিন্তু সুন্নীতে পরিণত হয়নি, অথচ এই প্রলয়কাণ্ডে আহলে সুন্নাতের সুশোভিত ও সাজানো গোছানো বাগানের কত পাতাই না ধূসর ও মলিন হতে চলেছে, ব্যস ঝড়ে পড়ার অপেক্ষা।
আমরা আহলে সুন্নাতের অঙ্গনে শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিরতা, ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা, পারস্পরিক সুসম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা রাখি। আমরা ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রচারক, কিন্তু চৌকিদার ও চোরের মধ্যকার ঐক্য ও বোঝাপড়া আমানতে খিয়ানতের দায়রায় চলে আসে। আমরা মতবিরোধ, দলাদলিকে মরনবিষ মনে করি, কিন্তু বাগানের মালীর আপন বাগানে হামলাকারী কাককে প্রতিহত করা, তাদের তাড়িয়ে দিতে গুলতি মারা বিরোধিতা নয়, ফিরক্বাবাজি নয়; বরং এটা হচ্ছে আপন কর্তব্যের প্রতি সৎ থাকা, যথাযথ আপন দায়িত্ব পালন করা। ওয়াখিরু দা’ওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
তথ্যসূত্র:
১. সুরা আল লায়ল আয়াতঃ ১৭ অনুবাদ, আ’লা হযরত রহঃ কৃত কানজুল ঈমান ।
২. সুরা আল হুজুরাত আয়াতঃ ১৩ অনুবাদ, আ’লা হযরত রহঃ কৃত কানজুল ঈমান ।
৩. আ’লা হযরত রহঃ কৃত আল যুলালুল আনক্বা ২৫ পৃষ্ঠা।
৪. সুরা আল হুজুরাত আয়াতঃ ৩ অনুবাদ, আ’লা হযরত রহঃ কৃত কানজুল ঈমান ।
৫. সুরা আল হাজ্জ আয়াতঃ ৩২ আনুবাদ আ’লা হযরত রহঃ কৃত কানযুল ঈমান ।
৬. সহীহ মুসলিম হাদীস নং–২৫৬৪ দারু ইহয়াউত তুরাছিল আরাবী, বৈরুত ।
৭. কাশফুল মাহজুব, বাবুত তাসাউফ, ৩২ পৃষ্ঠা; উর্দু তরজমা কালামুল মারগুব, ১২০ পৃষ্ঠা, জিয়াউল কুরআন পাবলিকেশন্স, করাচি-লাহোর।
৮. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, বাবু হাক্বীক্বাতির রূহ, ২/৩৩৩ পৃষ্ঠা, দারুল জীল, বৈরুত।
৯. আল মুকাদ্দিমাতুস সানিয়্যাহ ফিল ইনতিসারি লিল ফিরক্বাতিস সুন্নিয়াহ, ৩৬ পৃষ্ঠা; মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহঃ কৃত রাসায়িলে রাদ্দুর রাওয়াফিদ্ব, ১২ পৃষ্ঠা (মাকতাবা শামেলাহ)।
১০. ফাতাওয়া রজভীয়াহ, ২৯/ ৩৬৪-৩৬৫ পৃষ্ঠা, রজা ফাউন্ডেশন, লাহোর।
১১. প্রাগুপ্ত ২৯/২৩৩-২৩৪ পৃষ্ঠা।
১২. প্রাগুপ্ত ২৯/৩৭৪ পৃষ্ঠা।
১৩. প্রাগুপ্ত, ২৯/৩৭৪-৩৭৫ পৃষ্ঠা।
Discover more from RoushanDAlil.com
Subscribe to get the latest posts sent to your email.